নরসিংদীতে সংঘর্ষে নিহত ৪

আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার চরাঞ্চল নীলক্ষা ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান এবং সাবেক চেয়ারম্যানের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় চারজন নিহত হয়েছে।
আজ সোমবার দুপুরে উপজেলার নীলক্ষা, হরিপুর, সোনাকান্দি, আমিরাবাদ, বীরগাঁও গ্রাম এবং তার আশপাশে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে বলে এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছেন জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) আমেনা বেগম। তিনি বলেন, ‘সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে একজনের মৃতদেহ আমরা পেয়েছি।’
এ সময় রায়পুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজহার উদ্দিন, তিনজন উপপরিদর্শক (এসআই), দুজন কনস্টেবলসহ কমপক্ষে ৩০ জন আহত হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে আটক করা হয়েছে ১৩ জনকে। এর মধ্যে সন্ধ্যার দিকে ওসিকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে।
নিহতরা হলেন উপজেলার আমিরাবাদ গ্রামের মৃত আলতু মিয়ার ছেলে মানিক মিয়া (৪৫), সোনাকান্দি গ্রামের মঙ্গল মিয়ার ছেলে মামুন মিয়া (২৫), একই গ্রামের মারফত আলীর ছেলে খোকন সরকার (৩৫), সালামত মিয়ার ছেলে শাহজাহান (৩৫)। এঁরা সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হকের সমর্থক বলে জানা গেছে।
আব্দুল হক গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেন, সংঘর্ষে প্রতিপক্ষের হামলায় তাঁর চার সমর্থক নিহত হয়েছেন।
আহত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে রায়পুরা থানার ওসি ছাড়াও রায়পুরা থানার কর্মকর্তা আজহারুল ইসলাম সরকার, উপপরিদর্শক (এসআই) আসাদ মিয়া, এসআই মোজাম্মেল হক, এসআই জিয়াউর রহমান ও কনস্টেবল জিল্লুর রহমান রয়েছেন বলে জানা গেছে। তারা সদর হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে যান পুলিশ সুপার আমেনা বেগম, জেলা প্রশাসক আবু হেনা মোরশেদ জামান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাসিবুল আলম, এএসপি রেজুয়ান চৌধুরী, গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা (ওসি) সাইদুর রহমান, সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম মোস্তফা।
পুলিশ ও এলাকাবাসী জানায়, এলাকার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পর থেকে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল হক এবং বর্তমান চেয়ারম্যান তাজুল ইসলামের সমর্থকদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
এর জের ধরে গত শনিবার থেকে থেমে থেমে দুইপক্ষের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। আজ সকালে উভয় পক্ষ আবার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালায়।
এ সময় পুলিশ নির্বাহী হাকিমের উপস্থিতিতে ফাঁকা গুলি ছুড়ে। অপরদিকে দুই পক্ষের সমর্থকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল ও দেশীয় অস্ত্র টেঁটা নিক্ষেপ করে। এ সময় রায়পুরা থানার ওসি আজহার উদ্দিনসহ ছয় পুলিশ সদস্য আহত হন। এ ছাড়া আরো অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছে। তারা নরসিংদী ও পাশের জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা নিচ্ছে।
জেলার সহকারী পুলিশ সুপার বশির উদ্দিন এনটিভ অনলাইনকে জানান, প্রায় সাতটি গ্রামের লোকজন একত্রিত হয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালায়। সেখানে নির্বাহী হাকিম উপস্থিত ছিলেন। হামলার মুখে একপর্যায়ে নিজেদের বাঁচাতেই গুলি ছুড়ে পুলিশ।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাসিবুল আলম বলেন, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। তাদের বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য দুই পক্ষের নেতাদের মধ্যে আলোচনা চলছিল। এর মধ্যে দুই পক্ষের সমর্থকরা পুনরায় সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। পুলিশ তাতে বাঁধা দিলে তারা পুলিশের উপর হামলা চালায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে।
ঘটনাস্থল থেকে ফিরে গণমাধ্যমকর্মীরা জানিয়েছেন, নীলক্ষা ইউনিয়নের হরিপুর এলাকায় বাতাসে ভেসে আসছে পোড়া গন্ধ। অনেক জায়গায় দেখা গেছে পোড়া বাড়ির দৃশ্য। ঘরগুলোর ভিতরে কিছুই নেই। শুধু পোড়া কাঠ, কয়লা আর ছাই। টিনগুলিও পুড়তে পুড়তে ভঙ্গুর হয়ে দলামোচা হয়ে গেছে। ঘরে আগুন দেওয়ার আগে ইচ্ছেমতো লুটপাট চালানো হয়েছে। অনেক বাড়ির সামনে খড়ের পালায় দাও দাও করে আগুন জ্বলছে। বাড়ির মোটা লোহার গ্রিল ভেঙে বাইরে ফেলে রাখা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানায়, নির্বাচনের পর থেকে গত সাত মাসে দুই পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে কমপক্ষে ১৫ বার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে কমবেশি তিন শতাধিক লোক হতাহত হয়। ভাঙচুর করা হয় শতাধিক বাড়িঘর। লুট করা হয় গোয়ালের গরু, ধানসহ বিভিন্ন মূল্যবান জিনিসপত্র। ক্ষয় ক্ষতি হয় কোটি টাকার মালামাল।
এ সব ঘটনায় সাবেক চেয়ারম্যন আব্দুল হক সরকার গ্রেপ্তারও হন। এর পর পুলিশ ওই এলাকায় বিভিন্ন সময়ে সাঁড়াশি অভিযান চালায়। এসব তৎপরতার ফলে সাময়িকভাবে গ্রামবাসীর সংঘর্ষ বন্ধ ছিল।
কিন্তু গত শনিবার সকাল থেকে আবার দুই পক্ষের সমর্থকরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। দিনের বেলায় দফায় দফায় চলতে থাকে সংঘর্ষ। গত দুদিনের সংঘর্ষে উভয় পক্ষের প্রায় শতাধিক লোক আহত হয়। অর্ধশতাধিক বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।