বিক্ষিপ্ত সহিংসতায় শেষ হলো পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় ধাপের ভোটগ্রহণ

টানটান উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে আজ বৃহস্পতিবার শেষ হলো পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোটগ্রহণ। দ্বিতীয় ধাপে পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার ৩০টি আসনে ভোটগ্রহণ হয়।
এদিন সবার নজর ছিল নন্দীগ্রাম আসনে। এই আসনেই তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন দলটির প্রধান মমতা বন্দোপাধ্যায় ও তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ বিজেপির শুভেন্দু অধিকারী। ছিলেন সিপিআইএম সমর্থিত সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী মীনাক্ষি মুখার্জিও।
কোভিড-১৯ স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলে। কিন্তু ভোট শেষ হওয়ার পরেও গোটা দিন ধরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল নন্দীগ্রাম।
নির্বাচন কমিশনের মতে, নন্দীগ্রামের মতো হাইপ্রোফাইল কেন্দ্রের প্রতিটি বুথই স্পর্শকাতর। তাই ভোট শান্তিপূর্ণ ও অবাধ করতে কমিশনের তরফে সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। গোটা নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্র জুড়েই জারি করা ছিল ১৪৪ ধারা। যদিও তার মধ্যেও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু বিক্ষিপ্ত সহিংসতার ঘটনা ঘটে।
কপালে তিলক কেটে, গলায় গেরুয়া উত্তরীয় চাপিয়ে ভোটের দিন সকালেই নন্দীগ্রামের নন্দনায়েক বাড় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথে গিয়ে ভোট দেন বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারী।
ভোট দিয়ে বাইরে বেরিয়েই বিজয় চিহ্ন দেখিয়ে শুভেন্দু বলেন, ‘পরিবর্তনের পক্ষে ভোট হচ্ছে। উন্নয়নই জিতবে, তোষণের রাজনীতির পরাজয় হবে।’
প্রতিপক্ষ মমতাকে কটাক্ষ করে শুভেন্দুকে বলতে শোনা যায়, ‘আন্টি কো থোড়া শান্ত রাখ না চাহিয়ে (আন্টিকে এখন কিছুটা শান্ত থাকা উচিত)।’
এদিন দুপুরে হঠাৎ করেই নন্দীগ্রামের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ওই বিধানসভা কেন্দ্রের বিভিন্ন বুথে বিজেপি কর্মীদের বিরুদ্ধে ভোটদানে বাধা, ভয় দেখানো, জাল ভোটসহ কিছু অভিযোগ ওঠার পরই সব বুথ পরিদর্শনের জন্য রেয়াপাড়ার ভাড়া বাড়ি থেকে বের হন মমতা।
দুপুর ২টা নাগাদ নন্দীগ্রাম বিধানসভার বয়ালের ৭ নম্বর বুথে যান মমতা। অভিযোগ ছিল ওই বুথে তৃণমূলের পোলিং এজেন্টকে বসতে দেওয়া হচ্ছে না। এরপর হুইলচেয়ারে বসে নজরদারি চালাতে থাকেন তিনি।
তখন বিজেপি কর্মী-সমর্থকরা মমতাকে ঘিরে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিতে থাকেন বলে অভিযোগ ওঠে। তৃণমূলের তরফে পাল্টা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়া হয়। এ সময় তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে কার্যত সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি হয়।
বুথের ভেতরই প্রায় দেড় ঘণ্টার বেশি সময় আটকে পড়েন মমতা। সেখান থেকেই রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়কে ফোন করে মমতা বলেন, ‘ওরা সকাল থেকে কাউকে ভোট দিতে দেয়নি। আমি আপনার কাছে আবেদন করছি, বিষয়টি দয়া করে দেখুন।’
ফোন পাওয়ার কথা স্বীকার করে রাজ্যপালের তরফ থেকেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের আশ্বাস দেওয়া হয়। নন্দীগ্রামের পরিস্থিতি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
এরপরই কমিশনের নির্দেশে বয়ালে যান বিশেষ পুলিশ পর্যবেক্ষক নগেন্দ্র ত্রিপাঠীসহ বিশাল বাহিনী। এরপর কেন্দ্রীয় বাহিনীর সহায়তায় বয়ালের ওই বুথ থেকে মমতাকে বাইরে বের করে আনা হয়।
এরপর সাংবাদিকদের সামনে শুভেন্দুকে নিশানা করে মমতা বলেন, ‘এই ভোটে বিজেপির যিনি প্রার্থী হয়েছেন তিনি গতকাল রাত থেকেই বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে গুণ্ডামি ও তাণ্ডব করেছেন। কমিশনে আমরা ৬৩টি অভিযোগ জানিয়েছি। আমি নন্দীগ্রাম নিয়ে চিন্তিত নই, আমার চিন্তা গণতন্ত্র নিয়ে। নন্দীগ্রামে মা-মাটি-মানুষের আশীর্বাদে আমিই জিতব। মানুষ আমাকে মিস করছে, তার অর্থ মানুষ আমাকে ভোট দিয়েছে। আপনারা সবাই দেখেছেন সকাল থেকে বন্দুক নিয়ে বসে আছে কাউকে ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু এখানে ভোটটা চিটিং বাজি হয়েছে।’
এরপর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে কটাক্ষ করে মমতা বলেন, ‘আমি কেন্দ্রীয় বাহিনীকে দোষ দেব না। কারণ তারা আমাদের বন্ধু। কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই বিজেপিকে সহায়তা করার জন্য জওয়ানদের নির্দেশ দিয়েছেন। এখানে যারা আছেন তাদের মধ্যে বেশির ভাগই বহিরাগত। তারা বাংলাও বলতে পারেন না।’
নির্বাচন কমিশনের নীরব ভূমিকা নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেন মমতা। তিনি বলেন, ‘কমিশনের কাছে আমার আবেদন, দয়া করে নজর দিন। নন্দীগ্রামে আপনারা যা করেছেন, অন্যত্র এ ধরনের আচরণ করবেন না। আপনারা যতই চেষ্টা করুন না কেন, বিজেপি নির্বাচন জিততে পারবে না। এমনকি নন্দীগ্রামে তৃণমূল কংগ্রেস ৯০ শতাংশ ভোট পাবে।’
মমতা বেরিয়ে যাওয়ার পর বয়ালে যান শুভেন্দু অধিকারীও। সেখানে তিনি বলেন, ‘সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শুভেন্দুময় ছিল গোটা নন্দীগ্রাম। মমতা দিদি হেরে গেছেন। উনি মানুষের সমর্থন হারিয়েছেন।’
শুভেন্দু আরও বলেন, ‘বয়ালের বুথে গিয়ে তিনি ভোটারদের অপমান করেছেন। নন্দীগ্রামের মানুষকে অপমান করা ওর অভ্যাস হয়ে গেছে।’
এদিকে বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় ধাপেয় ভোটের উত্তপ্ত আবহের মধ্যেই দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার জয়নগরের সভা থেকে মমতাকে নিশানা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেন, ‘জনমত জরিপ হয়ে গেছে। দিদি ভবানীপুর ছেড়ে নন্দীগ্রামে গেলেন। ভোটের গতিবিধি বলছে দিদির হার নিশ্চিত। এখন পর্যন্ত ভোটদানের গতি প্রকৃতিতে স্পষ্ট, বাংলার হয়ে কাজ করে দিচ্ছে নন্দীগ্রাম। আমি আসল পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। চারদিকে কেবল বিজেপিই দেখছি। বিজেপির ঝড় চলছে। এবার বাংলায় বিজেপি ২০০ আসন ছাড়িয়ে যাবে।’
মোদি আরও বলেন, ‘প্রথম ধাপের ভোটের পর দিদির হতাশা আরও বেড়ে গেছে। সহায়তা চেয়ে দেশের কিছু নেতাকে তিনি চিঠি লিখেছেন। যদি গত ১০ বছর বাংলার জন্য কাজ করতেন, তবে এক জায়গায় তিনদিন থাকতে হতো না।’
তবে নন্দীগ্রাম ছাড়াও এদিন সকাল থেকেই একাধিক বিক্ষিপ্ত সহিংসতার ঘটনা ঘটে। নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপেও ইভিএম ও ভিভিপ্যাট বিভ্রাট নিয়ে কিছু জায়গা থেকে অভিযোগ আসে। কেশপুরের মহিষদাল এলাকায় বিজেপির নারী এজেন্টকে মারধরের অভিযোগ তৃণমূলের বিরুদ্ধে। বাঁকুড়ার কোতুলপুর বিধানসভা কেন্দ্রের ইসমাইল চক ধান্যঘোরি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথে বিজেপির নির্বাচনী এজেন্টকে বুথে প্রবেশ করতে না দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। বাঁকুড়ার তালডাংরা বিধানসভা কেন্দ্রের ভালুকবাসা গ্রামে ভোটগ্রহণ কেন্দ্র তৈরি করার দাবিতে ভোট বয়কটের ডাক দেওয়া হয়।
ডেবরায় বহিরাগত লোক নিয়ে বুথে ঘোরার অভিযোগ ওঠে বিজেপি প্রার্থী আইপিএস কর্মকর্তা ভারতী ঘোষের বিরদ্ধে। এই অভিযোগ তৃণমূলের বিক্ষোভের মুখেও পড়তে হয় তাকে। বুথ জ্যামের অভিযোগ পেয়ে কেশপুরে বিজেপি প্রার্থী প্রীতিশ রঞ্জন কুয়ার কেশপুরের গুণহারা গ্রামে গেলে তার গাড়ি ঘিরে ধরে ইঁট, বাঁশ, লোহার রড দিয়ে হামলা চালানো হয়। আক্রান্ত হয় গণমাধ্যমের গাড়িও। আবার বাঁকুড়ার ভৈরব মন্দিরে পুজো দেওয়ার পর ভোটারদের রুপি বিলিয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করার অভিযোগ উঠেছে বাঁকুড়ার তৃণমূলের প্রার্থী সায়ন্তিকা ব্যনার্জির বিরুদ্ধে।
অন্যদিকে নির্বাচন শুরুর পরই দুইটি মৃত্যুকে ঘিরে সরগরম হয়ে ওঠে রাজ্যের রাজনীতি। বৃহস্পতিবার সকালে দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরুর আগেই বুধবার রাতে মেদিনীপুর জেলার কেশপুরে এক তৃণমূল কর্মীর খুন হয়। ৪০ বছর বয়সী উত্তম দলুই নামে ওই তৃণমূল কর্মীর বাড়ি কেশপুরের ৪ নম্বর অঞ্চলের হরিহরচক এলাকায়। তৃণমূলের দাবি, বুধবার রাতে তিনি নিজের বাড়িতে বসে যখন খাবার খাচ্ছিলেন, তখন অতর্কিতভাবে বিজেপির লোকজন তার ওপর হামলা চালায়। ছুরি নিয়ে পেটে ক্ষতিবিক্ষত করে দেওয়া হয়। রাতেই প্রথমে কেশপুর গ্রামীণ হাসপাতাল পরে মেদিনীপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে তার মৃত্যু হয়। ঘটনার জেরে উত্তেজনা তৈরি হয় ওই এলাকায়। কেশপুরের ওই তৃণমূল কর্মী খুনের ঘটনায় আটজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
উল্লেখ, প্রথম ধাপের ভোট শুরুর ঠিক আগে পশ্চিম মেদিনীপুরে কেশিয়ারিতে এক বিজেপি কর্মী খুন হয়েছিল। অন্যদিকে নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রের বাখুয়াবাড় গ্রামের ২৮ নং বুথের বাসিন্দা স্থানীয় বিজেপি কর্মী উদয়শংকর দোবের অস্বাভাবিক মৃত্যুতে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে। পরিবারের দাবি, তৃণমূলের হুমকির ভয়ে উদয়শঙ্কর আত্মহত্যা করেছেন। এদিন ভোরে তার ঘর থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করা হয়। এই ঘটনায় এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। লাশ বাড়িতে রেখেই বিক্ষোভ দেখাতে থাকে বিজেপি কর্মীরা।
এই ধাপে বাংলায় মোট ভোটার ছিল ৭৫ লাখ ৯৪ হাজার ৫৪৯ জন। ৩০টি কেন্দ্রে ১৭১ জন প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারিত হল। এর মধ্যে পুরুষ প্রার্থী ১৫২ জন ও নারী প্রার্থী ১৯ জন। এই দফায় গুরুত্বপূর্ণ আসনগুলোর মধ্যে রয়েছে নন্দীগ্রাম, ডেবরা, খড়গপুর সদর, পাঁশকুড়া পশ্চিম, সবং, কেশপুর প্রমুখ। এ ধাপে হেভিওয়েট প্রার্থীদের মধ্যে ছিলেন তৃণমূলের প্রার্থী সাবেক আইপিএস কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর, বিজেপির সাবেক আইপিএস কর্মকর্তা ভারতী ঘোষ।
খড়গপুর সদর কেন্দ্রে বিজেপির তারকা প্রার্থী হিরণ চ্যাটার্জি, সবং কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী রাজ্যের সাবেক মন্ত্রী মানস ভুঁইয়া, কেশপুর কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী বর্তমান বিধায়ক শিউলি সাহা, পাঁশকুড়া পশ্চিম কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী ফিরোজা বিবি, ময়না কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী সাবেক ক্রিকেটার অশোক দিন্দা, চন্ডীপুর কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী অভিনেতা সোহম চক্রবর্তী প্রমুখ।
পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে এদিন আসামেও দ্বিতীয় ধাপের ভোটগ্রহণ হয়। এই ধাপে রাজ্যটির ৩৯টি আসনে ভোট নেওয়া হয়। গত ২৭ মার্চ পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে প্রথম দফার ভোটগহণ হয়। পশ্চিমবঙ্গে ২৯৪টি আসনে মোট আট দফায় ভোট নেওয়া হবে। অন্যদিকে ১২৬ আসন বিশিষ্ট আসামে তিন ধাপে ভোট নেওয়া হবে। গণনা আগামী ২ মে।