বিজ্ঞান, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চা

১.
সফদর আলী নামের জনপ্রিয় কল্প-বিজ্ঞান চরিত্রটি থেকে মজার একটা উপলব্ধি পেয়েছিলাম কম বয়েসে, স্মৃতি থেকে বলি : বিজ্ঞানী সফদর আলী পোকাখেকো গোত্রের একটা গাছকে শিকার করার সুবিধার জন্য বানিয়ে দিয়েছে একটা বৈদ্যুতিক চাবুক, আর শিকারের অপেক্ষায় বসে না থেকে গাছটা নিজেই যেন পোকাটাকে তাড়া করতে পারে, সে জন্য তাকে স্থাপন করতে চাইছে চার চাকার একটা পাটাতনের ওপর। মুশকিল হলো শিকারী গাছটা যতবারই পোকার দিকে এগোবার চেষ্টা করে, চাকাগুলো কেন যেন ঠিক তার উলটো দিকে দৌড় দেয়! সফদর আলীর লেখক বন্ধু লাগসই একটা বুদ্ধি দিলেন, যন্ত্রের একটা কলকবজা উলটো করে ঘুরিয়ে দিলেই তো সমস্যাটা মিটে যায়। সফদর আলী তখন লেখককে সেই অদ্ভুদ বাক্যটা বললেন, ওতে সমাধান হয় বটে, কিন্তু বিজ্ঞান হয় না। বিজ্ঞানের কাজ হলো সমস্যটাকে খুঁজে বের করা, তাকে বোঝার চেষ্টা করা।
২.
বছর কয়েক আগে একুশে ফেব্রুয়ারি সংখ্যার ডেইলি স্টারে ‘Doing science in Bangla’ নামে মুহম্মদ জাফর ইকবাল বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানকে প্রকাশ করার যে সমস্যাটি চিহ্নিত করেছেন, তা এখানকার মূলধারার অনেকেরই মতামতকে প্রতিফলিত করে। ঝটপট অনুবাদে তার রচনাটি থেকে কিছু অংশ তুলে দেই :
এবারে একই রকমের একটা উদাহরণ নেওয়া যাক একটা বিজ্ঞানের পাঠ্যবই (রবার্ট রেসনিক ও ডেভিড হ্যালিডে রচিত পদার্থবিদ্যা— স্নাতক শিক্ষার বছরগুলোতে বইটিই আমি পড়েছি) থেকে। যথাইচ্ছা একটা বাক্য বাছাই করি : ‘'We can show that there are two kinds of charge by rubbing a glass rod with silk and hanging it from a long thread as in fig. 26-1'. আমি নিশ্চিত যে এই বাক্যটার অর্থ প্রায় সবার কাছেই স্থির, এমনকি বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী নন এমন যে কারো কাছেও। বাক্যটা এমন ভাবে গঠিত হয়েছে যে আমরা তথ্যগুলো সঠিক ধারাক্রমে পাই। প্রথমত এটা বলে যে (১) দুই ধরনের আধান আছে, তারপর (২) এটা নির্ণয় করার জন্য যে পরীক্ষণটি করা যেতে পারে এবং তারপর (৩)যদি বা কারও কাছে পরীক্ষণের বর্ণনাটি যথেষ্ট বলে মনে না হয় তার জন্য একটা চিত্রের বরাত উল্লেখ।
এবার আমি একই তথ্যগুলো বাংলায় দেওয়ার চেষ্টা করব। সেটা করার একটা সুনিশ্চিত উপায় হলো বাক্যটিকে বাংলায় অনুবাদ করে ফেলা এবং খুব দ্রুতই আমি আবিষ্কার করলাম যে কাজটা খুব সোজা না। এটাকে একটা বাক্যে সীমিত রাখতে চাইলে সবচে ভালো যে অনুবাদটি আমি করতে পারি সেটা হলো : ‘একটা কাচের দণ্ডকে সিল্ক দিয়ে ঘষে ২৬-১ ছবিতে দেখানো উপায়ে একটা লম্বা সুতা দিয়ে ঝুলিয়ে রাখলে আমরা দেখাতে পারি যে চার্জ দুই রকমের।’ আপনারাও চেষ্টা করতে পারেন, কিন্তু আমার বিশ্বাস যে এর চেয়ে খুব ভালো কিছু করতে পারবেন না। বাক্যটা ঠিকই আছে, কিন্তু তথ্যগুলো ধারাক্রমে গুবলেট পাকিয়েছে—তথ্যগুলো যথাযথ ক্রমানুসারে আসেনি। আমি যদি এটা ঠিকমতো করতে চাই এবং একইসাথে বাক্যটাকে সরলও রাখতে চাই তাহলে আমাকে বাক্যটাকে ভেঙে তিনটি আলাদা বাক্য বানাতে হবে, যেমন (১)আমরা দেখাতে পারি যে চার্জ দু রকমের।(২)একটা কাচের দণ্ডকে সিল্ক দিয়ে ঘষে একটা লম্বা সুতা দিয়ে ঝুলিয়ে রাখলে সেটা দেখানো যায়। (৩) ২৬-১ নম্বরের ছবিতে সেটা দেখানো হয়েছে। এবার ভাষা সরল এবং বোধগম্য হয়েছে—কিন্তু আমাকে আকৃতি বিষয়ে ছাড় দিতে হয়েছে, পাঠ্যবস্তু এখন তাৎপর্যপূর্ণ রকমের বড়সড়।
আমি এই সমস্যা নিয়ে আগে সচেতন ছিলাম না। বাংলায় বিজ্ঞানের পাঠ্যবই পড়তে গেলে সর্বদাই আমি ভাষার দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি বোধ করি—এটা কখনোই সরল না, কখনোই সরাসরি না—সব সময়েই ভাষাটা একটু জটিল। ভেবেছিলাম বিজ্ঞান লেখকদের ভাষা নিয়ে পর্যাপ্ত দখলের অভাব আছে। বছর কয়েক আগে আমি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য পদার্থবিজ্ঞানের একটা পাঠ্যবই বাংলায় লিখতে শুরু করি এবং সাথে সাথেই আমি সমস্যাটা বুঝতে পারি। আমি উপলদ্ধি করি কবিতা রচিবার তরে বাংলা একটা সুন্দর ভাষা কিন্তু বিজ্ঞান লেখার জন্য একটু কঠিন। আমি জানি না কেন বা কিভাবে এটা ঘটল, কিন্তু এটা সত্যি।“ (Muhammed Zafar Iqbal, Doing science in Bangla sat, February 21, 2004, the daily star)
না, এটা সত্যি না। কারণ বাংলা বা আর কোনো ভাষার ক্ষেত্রে এমন কোনো অক্ষমতার কোনো কারণ ঘটেইনি, ঘটার সুযোগও কম। বরং আমরা আশ্চর্য হই বাংলা ভাষায় জনপ্রিয়তম কল্পকাহিনীর লেখক কেন আলোচ্য পাঠ্যপুস্তকটির ওই নির্দিষ্ট বাক্যটির এমন আড়ষ্ট তর্জমা প্রস্তাব করে তারপর সেটির দায়ে বাংলাভাষার অক্ষমতাকে শাস্তি দেওয়ার মনস্তাপে ভুগছেন। বাংলায় বিজ্ঞানের পাঠ্য হওয়ার জন্য যদি বাক্যটার অনুবাদ এমন একটা কিছু হতে হবে যেটা বোধগম্য এবং যথাযথ ক্রমানুযায়ী তথ্যগুলোকে সাজানো, তেমন একটা বিকল্প তর্জমা তো এক্ষুণি চেষ্টা করে দেখানো যেতে পারে, “আধান যে দুই রকমের তা দেখানো যেতে পারে একটা কাচের দণ্ডকে রেশমি কাপড় দিয়ে ঘষে সেটাকে একটা লম্বা সুতোয় ঝুলিয়ে যেমনটা দেখানো হয়েছে ২৬-১ চিত্রে।” প্রস্তাবিত বাক্যটিতে আশা করি অর্থগুলো নিশ্চিত, তথ্যগুলোও সম্ভবত বিদ্যুতের ধর্ম শিক্ষার উপযুক্ত ক্রমেই একের পর এক এসেছে। এমনকি নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায় যে এই বাক্যটিকে আরো সাবলীল, মজার ও কার্যকর করে উপস্থাপনের মতো জ্ঞানী মানুষ আমাদের আশপাশে অনেকই আছেন।
৩.
কিন্তু এটা তো খুব সরল একটা নমুনা হলো। মুহম্মদ জাফর ইকবাল জনপ্রিয় ধারার সাহিত্যিক এবং তিনি হয়তো জটিল বিষয়টাকে বোধগম্য করে আনবার চেষ্টাতেই এই ভুলটি করেছেন- এমনও তো হতে পারত! যদি হয় আরো জটিল, আরো সুক্ষ্ম এবং অভিজ্ঞতার বাইরের কোনো বিষয়, ভাষা কি একই ভাবে সাড়া দিতে পারবে? আমরা তাহলে একটা জটিলতর উদাহরণেই যাওয়ার চেষ্টা করি।
বছর দুয়েক আগে বিজ্ঞান শিক্ষার ভাষা বিষয়ে এমনি একটা বিতর্ক হচ্ছিল বিডিনিউজ২৪-এর মতামত বিশ্লেষণ নামের স্তম্ভে। এর অন্যতম উসকানিদাতা ছিলেন সুহৃদ এবং পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে স্বাদু, প্রায় কবিতার মতো বাংলা গদ্যে নিয়মিত লিখে চলা ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী। আমি ভাষাবিদও নই, বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীও না। ইতিহাস আর সাহিত্য বিষয়ে কিছু জানাশোনার সূত্রে এক একটা জাতির ঐতিহাসিক বিকাশের পর্বগুলোতে অনুবাদ কিভাবে জাতি গঠনে বিপ্লবাত্মক ভূমিকা পালন করেছিল, সেটা গ্রিক-লাতিন-আরব-ইংরেজ-রুশ হয়ে হালের জাপান-চিন-কোরিয়া সবার জন্যই কেন সাধারণ সত্য, সেই বিষয়ে আলাপ করেছিলাম। তার সাথে ভিন্নমত পোষণ করে ফাহাম আবদুস সালাম নামের অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী একজন বাঙালি বিজ্ঞানী একটা গবেষণাপত্রের সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরে দেখিয়ে দিতে বলেন ওটা বাংলাভাষীর বোধগম্য করা সম্ভব কি না। তাঁর সিদ্ধান্তও তিনি জানিয়ে দেন, এই বস্তু বাংলায় আনাটা অসম্ভব কর্ম। এর উত্তরে ফাহাম আবদুস সালামেরই একজন সাবেক ছাত্র, তিনিও একজন প্রবাসী গবেষক, রজিউদ্দীন রতন ‘বিজ্ঞানের ভাষা ইংরেজি নয়’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ লেখেন ওই একই স্তম্ভে। তার একটা অংশ তুলে দেওয়ার লোভ সম্বরণ করাটা কঠিন, বাংলাদেশে বাংলাকে উচ্চশিক্ষার বাহনে পরিণত করার কাজটা যত দিন চারপাশের মূঢ়তার সুযোগে শাসকদের চাতুরিতে আটকে থাকবে, এই উদাহরণগুলো আমাদের বারবার ব্যবহার করতে হবে।
“বিজ্ঞান বাংলায় অনুবাদ করা কী রকম অসম্ভব সেটা বোঝাতে লেখক (ফাহাম আবদুস সালাম) একটি গবেষণা প্রবন্ধের ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট’ দিয়েছেন এবং পরিভাষাগুলো বাদ রেখে হলেও সেটার অনুবাদ করে দেখতে বলেছেন। আমি নিজে ইংরেজি কাজ চালানোর মতো জানি। পারতপক্ষে বলি না, লিখিও না। আমার কাছে ইংরেজির তেষ্টা মেটানো গরম পানি পান করার মতো। তাতে জীবন বাঁচে, কিন্তু তৃপ্তি হয় না। ইংরেজি ভালো না জানলেও আমি বিজ্ঞানের ছাত্র বলে লেখকের দেওয়া অ্যাবসট্রাক্টটি বুঝতে পারলাম। অন্তত আমার তাই মনে হলো। তারপরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য একজন বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করলাম যার মাতৃভাষা ইংরেজি। তাকে লেখকের দেওয়া অ্যাবস্ট্রাক্টের প্রথম অংশটি দিলাম। সেটি এ রকম :
( and the shared human beta common subunit (hβc). This thesis explores IL-3 and GM-CSF receptor binding and activation mechanisms.aThe cytokines interleukin-3 (IL-3), interleukin-5 (IL-5), and granulocyte-macrophage colony stimulating factor (GM-CSF) exhibit overlapping activities in the regulation of hematopoietic cells. All these cytokines signal via a specific alpha receptor )
অ্যাবসট্রাক্টটি পড়ে আমার বন্ধুর চেহারাটি হয়েছিল দেখার মতো! প্রতিক্রিয়ায় সে আমাকে যা বলেছিল সেটি কেবল বন্ধুদেরই বলা যায়। ভদ্রমহলে তার একটা অনুবাদ করতে পারি কেবল। আমার বন্ধুটি বলল, “ক্ষেপেছ নাকি! এটি কীসের ঘণ্ট! আমি কীভাবে এই জিনিস বুঝব! তোমার কী মাথা খারাপ হয়েছে…!’ তখন আমি তাকে আমার ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, বুঝলে হে, পরিবেশে যত ক্ষতিকর জীবাণু কিলবিল করে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের শরীরে থাকে রক্ষীকোষ। তারা নানা উপায়ে জীবাণুদের ঘায়েল করে। রক্ষীকোষ অনেক রকমের হতে পারে। তাদের মধ্যে একটা হচ্ছে ম্যাক্রোফেজ। এই ম্যাক্রোফেজরা কী করে জানো? তাদের কাজ জীবাণুদের ধরে ধরে খেয়ে ফেলা আর শরীরের অন্য যেসব বিশেষ রক্ষীকোষ আছে তাদের সংকেত দেওয়া। শরীরের রক্ষীকোষদের মধ্যে একটা দল আছে যাদের বলে গ্রানিউলোসাইট। গ্রানিউল মানেতো জানই, ওই গুঁড়ো গুঁড়ো অথবা দানাদার জিনিস। আর সাইট এসেছে সাইটো শব্দটা থেকে যার মানে হলো গিয়ে কোষ। সব মিলিয়ে এরা হচ্ছে সেই কোষ যাদের মধ্যে দানাদার বস্তু থাকে। এসব কোষ বিশেষ ধরনের বিষ দিয়ে শরীরে অণুপ্রবেশ করা জীবাণুকে মারতে পারে।
আজকাল যে হর-হামেশা ‘স্টেম সেল’-এর নাম শোন, তারা কী জান? ‘স্টেম সেল’ মানে স্টেম কোষ; ‘স্টেম কোষ’ হলো শরীরে অনেক প্রয়োজনীয় কোষের প্রাচীন অবস্থা। মানে হলো, ধর তুমি যেমন ময়দার কাই বা খামির দিয়ে রুটিও বানাতে পারো বিস্কুটও বানাতে পারো সে রকম। ‘স্টেম সেল’ নিজে সংখ্যায় বৃদ্ধি পেয়ে আরো ‘স্টেম সেল’ যেমন বানাতে পারে তেমনি অন্য অনেক ধরনের কোষও বানাতে পারে। যেসব ‘স্টেম সেল’ পরবর্তীতে ‘ম্যাক্রোফেজ’ অথবা ‘গ্রানিউলোসাইট’দের মতো শরীরের রক্ষীকোষ তৈরি করে তাদের বলে ‘হেমাটোপোয়েটিক স্টেম সেল’ অথবা ‘হেমাটোপোয়েটিক’ কোষ। ‘স্টেম সেল’ বৃদ্ধি পেয়ে অন্য কোনো ধরনের বিশেষ কোষে রূপান্তরিত হবে সেটা নির্ভর করে এসব কোষ কী ধরনের সংকেত পাচ্ছে তার ওপর। কোষেরা সংকেত পায় কীভাবে জান তো? কোষেরা সংকেত পায় বিভিন্ন রকমের প্রোটিন কণা দিয়ে। এসব সংকেত দেওয়ার প্রোটিন কণাকে বলে ‘সাইটোকাইন’। ‘সাইটো’ মানে ‘কোষ’, আর ‘কাইন’ এসেছে ‘কাইনোস’ থেকে যার মানে ‘গতি’। এসব কিন্তু গ্রিক শব্দ, তোমরা ইংরেজরা নিজের বলে চালাচ্ছ এখন! সে যাকগে, যা বলছিলাম, এই অ্যাবসট্রাক্টে যে লেখা ‘ইন্টারলিউকিন-৩’ (আইএল-৩), ‘ইন্টারলিউকিন-৫’ (আইএল-৫) আর ‘গ্রানিউলোসাইট-ম্যাক্রোফেজ কলোনি স্টিমুলেটিং ফ্যাক্টর’ (জিএম-সিএসএফ)–এসবই হলো একেক ধরনের কোষকে সংকেত দেওয়ার প্রোটিন মানে ‘সাইটোকাইন’।
এখন পড়ে দেখ তো, অ্যাবস্ট্রাক্টের প্রথম লাইনটা খুব বিস্তারিত না হলেও খানিকটা বুঝতে পার কি না! আমি তো স্পষ্ট বুঝতে পারছি, এতে বলছে, , “‘আইএল-৩’, ‘আইএল-৫’ এবং ‘জিএম-সিএসএফ’ নামের এই তিনটি ‘সাইটোকাইন’ ‘হেমাটোপোয়েটিক স্টেম সেল’কে তার বৃদ্ধি অথবা ভবিষ্যৎ নির্ধারণে যে সংকেত দেয়, সেই সংকেত দেওয়ার প্রক্রিয়ায় খানিকটা মিল রয়েছে।” এখন তোমার যদি এই বিষয়ে আগ্রহ থাকে তাহলে পুরো প্রবন্ধটা পড়ে বিস্তারিত জেনে নিতে পার। এত কিছু বুঝিয়ে বলার পরও অবশ্য আমার বন্ধুটি খুব খুশি হতে পারেনি। কারণ সে বিজ্ঞানের ছাত্র নয়। বিজ্ঞানের প্রাথমিক জ্ঞান তার নেই। নিজে ইংরেজিভাষী হলেও ‘সাইটোকাইন’, ‘ইন্টারলিউকিন’, ‘গ্রানিউলোসাইট’ অথবা ‘ম্যাক্রোফেজ’-এর মতো শব্দ তার পরিচিত নয়। এক লাইনে বুঝিয়ে বললেও সে এসব খুব বিস্তারিত জানবে না। একটি গবেষণা প্রবন্ধের একটি লাইনের আসল মানে কী, তার তাৎপর্য কতটুকু সেটা সে সহজে বুঝে উঠতে পারবে না। সেটি বুঝে উঠতে তাকে নির্দিষ্ট বিষয়ে বিস্তারিত পড়াশোনা করতে হবে। অন্য বিষয়ের ছাত্র হলে তো দূরের ব্যাপার, একজন ইমিউনোলজি অথবা রোগপ্রতিরোধবিদ্যার ছাত্রও তো তার পড়াশোনার প্রথম অথবা মধ্যভাগে এই গবেষণা প্রবন্ধ ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারবে না! আমরা কী একটি ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীকে জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাটিতে কবি কী বলতে চেয়েছেন সেটি জিজ্ঞাসা করব? সে নিজে বাংলাভাষী হলেও সেই কবিতাটি বুঝে ওঠার জন্য তার যথেষ্ট বেড়ে ওঠার প্রয়োজন রয়েছে! (রজিউদ্দীন রতন, বিজ্ঞানের ভাষা ইংরেজি নয়, নভেম্ভর ২৬, ২০১১)
রজিউদ্দীন রতন খুব অল্প কথায় এবং অনবদ্য বাংলায় যে জরুরি বিষয়গুলো ফয়সালা করেছেন, সেগুলো হলো, ১. উচ্চশিক্ষার ভাষা পরিভাষায় কণ্টকিত থাকে বলে সেই ভাষাভাষী ব্যক্তিরাও অনেক সময় বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের অভাবে আলোচ্যবিষয়টাকে নাও বুঝতে পারেন, ২. কিন্তু যিনি বিষয়টির সাথে সম্পর্কিত, তিনি যথাযথ ভাষাজ্ঞান থাকলে অন্য কোনো ভাষাতেও তা তর্জমা করতে পারবেন। এই কথাগুলোকেই আসলে এক কথায় প্রকাশ করেছিলেন আমাদের বরেণ্য পূর্বসূরী সত্যেন বোস তাঁর সেই বিখ্যাত বাক্যটিতে : বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা সম্ভব না বলে যিনি মনে করেন, তিনি হয় বিজ্ঞান জানেন না, নয়তো বাংলা জানেন না।
ভাষা সম্পর্কেই একটা সত্য উপলব্ধি এখানে আমরা আসলে পাই। ভাষার অযোগ্যতা বলে কিছু থাকতেই পারে না। ভাষা প্রকাশের মাধ্যম, ফলে সামাজিক-রাজনৈতিক-বৈজ্ঞানিক-সামরিক যেকোনো প্রয়োজনে কোনো সমাজের অনেক মানুষ যদি কোনো বিষয় প্রকাশের সংকটে পড়েন, নতুন শব্দ নির্মাণ করে কিংবা পুরনো শব্দের নতুন কোনো অর্থ আরোপ করে অথবা অন্যভাষা থেকে শব্দ ধার করে মানুষ তার প্রকাশের সংকট অতিক্রম করে। এই কারণেই আমরা দেখব সমাজের এক একটা ঘটনাবহুল যুগে ভাষাতেও অজস্র নতুন শব্দ যুক্ত হয়েছে, নতুন নতুন পরিভাষা নির্মিত হয়েছে। ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, বাংলার ঊনিশ-বিশ শতকের আলোড়ন প্রতিটিই ভাষাকে নতুনভাবে গড়েপিটে নিয়েছে, এমনকি গত ১০০ বছরেও বাংলা ভাষায় নতুন নতুন শব্দ ও মানে যুক্ত হয়েছে, কেননা নতুন নতুন ভাব ও ভাবনাকে প্রতিফলিত করতে হয়েছে তাকে। কিন্তু একই সাথে ভাষার মূল সুরটিও অটুট থেকেছে, সেটা একই বাংলাভাষার ধারাবাহিকতা। ভাষার মাঝে আমরা তাই স্বাতন্ত্র রক্ষা করে চলা এক প্রবহমানতাই দেখতে পাই।
দশম শতকে হিন্দু জাতির সাথে পরিচিতির সুযোগের অনন্য ঘটনাটিতে মুগ্ধ আল বেরুনি তাঁদের ভাষা থেকে প্রাচীন সব দর্শন-গণিত আর অন্যসব বিজ্ঞানের বই আরবিতে অনুবাদ করতে গিয়ে অজস্র সংস্কৃত শব্দ চালিয়ে দিয়েছেন আরবিতে। এমনটাই হয়। এমনকি দর্শন বোঝাতে আরবিতে ব্যবহৃত ‘ফালাসিফা’ শব্দটাই গ্রিক থেকে যাওয়া। ফরাসি বিপ্লবের বেশকিছু কাল পর ক্ষমতা দখল করা সমরপতি নেপোলিয়নের বর্ণনায় সমকালীন এক অস্ট্রীয় কূটনীতিবিদ মেটারনিখ বলছেন : বিষয়ের মর্মাংশটা আয়ত্তে নিয়ে, অপ্রয়োজনীয় ডালপালাগুলো ছেঁটে নিয়ে, নিজের চিন্তা নির্মাণ করতে থাকতেন এবং সম্পূর্ণ রকমের পরিষ্কার এবং চূড়ান্ত করে না আনা পর্যন্ত সেটা বিস্তারিত করতে থাকতেন, সর্বদাই কোনো বিষয়ে যথাযথ শব্দ হাতড়াতেন, অথবা ভাষার দৃশ্যকল্পে তা আগেই সৃষ্টি না হয়ে থাকলে নতুন একটা উদ্ভাবন করতেন। এই যে শব্দ হাতড়ানো, খুঁজে পাওয়া কিংবা অভাববোধে নতুন শব্দের নির্মাণ, তা কেবল দরকার পড়ে সমাজে নতুন অনুভূতির প্রকাশের দায় থাকলে। শুধু নেপোলিয়নই নন, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরাও তাই নতুন ভাবনাকে প্রকাশ করার জন্য ভাষাকে গড়েপিটে নিয়েছেন, বলা উচিত নিতে বাধ্য হয়েছেন।
৪.
বহুদিন আগে বদরুদ্দীন উমরের একটি স্মরণীয় আলোচনা শুনেছিলাম বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান চেতনা বিষয়টি নিয়ে। প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন, বিজ্ঞান চেতনা মানে পদার্থবিজ্ঞান কি অন্য কোনো বিজ্ঞানের কতগুলো তথ্য না। এটা হলো একটা দৃষ্টিভঙ্গি, যে দৃষ্টিভঙ্গিটা নিয়ে আপনি ইতিহাস কি দর্শন কি শিক্ষাপদ্ধতি কিংবা জ্ঞানের আর যেকোনো শাখার কোনো সমস্যার গোড়া খুঁজতে যাবেন, তাকে পাঠ করবেন এবং সম্ভাব্য সমাধানগুলো খুঁজে বের করবেন। ফাহাম আবদুস সালাম কিংবা মুহম্মদ জাফর ইকবালের ভাষাবিষয়ক সিদ্ধান্তটি বিজ্ঞানসম্মত নয়, সেটি আমরা দেখতে পেলাম রতনের চমৎকার লেখা থেকে। এরা তিনজনেই তো বিজ্ঞান করা লোক, তাহলে দুজনেই বিজ্ঞান শিক্ষার বেলায় এমন অবৈজ্ঞানিক ও ত্রুটিপূর্ণ সিদ্ধান্ত কেন নিচ্ছেন? এর উত্তরও রতনই দিয়েছেন, ফাহামের একটা উদাহরণের জবাবে। ফাহাম অমুক অমুক বিজ্ঞানীর নাম করে বলেছেন তাঁরা জার্মান হলেও ইংরেজিতেই বিজ্ঞান চর্চা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। উত্তরে যা রতন জানালেন, সংক্ষেপে তা এই : জার্মানির বেশির ভাগ বিজ্ঞানীই মাতৃভাষাতেই বিজ্ঞান চর্চা করেন। দুজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর এই বিষয়ক মতামত নেওয়ার চেয়ে বরং বেশি কার্যকর হবে শিক্ষার প্রক্রিয়া এবং ভাষা বিষয়ে যারা বিশেষষজ্ঞ, সেই ভাষাবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদদেরই মতামত।
দুনিয়াজুড়ে সম্ভবত কোনো গূরুত্বপূর্ণ শিক্ষাবিশেষজ্ঞ ও ভাষাবিজ্ঞানীকে পাওয়া যাবে না যাঁরা একটা দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য পরভাষায় শিক্ষা দেওয়ার পরামর্শ হাজির করবেন অথবা দাবি করবেন অমুক জনগোষ্ঠীকে বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়ার চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু সেই ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষা অসম্ভব। যে প্রক্রিয়ায় সমাজে আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাটি যখন হাজির হয়, সেই একই প্রক্রিয়াতেই ভাষাটি বিজ্ঞান শিক্ষার উপযুক্তও হয়ে উঠতে থাকে। কিন্তু অনুবাদে তো অনেক কিছু হারিয়েও যায়।
অনুবাদে যা হারায়, তা বিজ্ঞানের আলোচ্যসূচি সম্ভবত না। হারানো অংশটুকু এক একটা জাতি তার নিজ মাতৃভাষায় যেভাবে যাপন করে, তাই। সে জন্য দুঃখ করার কিছু নেই, অনুবাদে আমরা যা পাব, তা জাতিগুলোর মাঝে লেনদেনযোগ্য অংশটুকু, বাকিটার জন্য সম্ভবত সেই জাতির জীবনই যাপন করতে হবে। কোনো গানের অনুবাদেও সেটুকুই কেবল সম্ভব হবে যেটুকু মানবজাতির সর্বজনীন অনুভূতির গোচর। এর বাইরের বিশিষ্ট অংশটুকু শুধু অন্যভাষাতেই হারায় না, সত্যি বলতে কি, বাংলাভাষীদের মাঝের বড় অংশও লালনের গানের পুরোটার মর্ম নিতে পারবেন না। কারণটা শ্রোতার ব্যক্তিগত যোগ্যতা নয়, কারণ তার পরিভাষাগুলো একেবারে বাউল-জীবনের সাথে সম্পর্কিত। ফলে রস শুধু যে ভাষান্তরে জাতিতে জাতিতে হারায় তাই না, শ্রেণি-সম্প্রদায়-ধর্মবিশ্বাসের ঐহিত্যগত অবস্থানের কারণেও তা হারায়। এ নিয়ে বিলাপ করে অনুবাদে যা পাওয়া সম্ভব, তাকে কেন থামিয়ে রাখি?
বরং মাতৃভাষার নিজস্বতাকেও যদি প্রবলতর করতে হয়, নিত্যনতুন পুষ্টিই তাকে দিতে হবে। প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার যা কিছু নিজস্ব অবদান, তার সূত্রপাত ঘটেছিল মিসরীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের জাতিগুলোর থেকে রসদ আহরণ করেই। আজকে পর্যন্ত সভ্যতার এই ধারা অব্যাহতই আছে, বাইরে থেকে যত বেশি রস আমরা মাতৃভাষাকে দেব, তত বেশি তার বিকাশটা ঘটবে, তার চাহিদা আর ক্ষুধাও বাড়বে, তার স্বাতন্ত্র্যও কিন্তু একইসাথে আরো প্রবলই হবে বাড়তি পুষ্টির গুণে।
৫.
আমাদের সফলতর সাহিত্যিকদের বড় অংশের ছেলেমেয়ে-নাতিনাতনিরা বাংলা ভাষায় আর কিছু শেখে না, যাপনও করে না। ফলে এই ভাষার সাথে তাদের বর্তমান স্বার্থের খানিকটা যুক্ত থাকলেও তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় এর ঠাঁই সামান্যই। তাদের বেশির ভাগই বাংলায় সাহিত্য রচনা করেন কেবল দুটো কারণে, একদিকে সাহিত্যকর্ম তাঁদের জন্য লাভজনক, অন্যদিকে বিদেশি ভাষায় তাদের সাহিত্যকর্মের মূল্যায়ন কেউ করবে না। শিক্ষার বাহন কি হওয়া উচিত, সেটা নিয়ে বেশির ভাগ আলোচনায় মধ্যবিত্তের এই দুই মেরুর বাস্তবতার বৈপরিত্য দেখা যাবে। বাকি গোটা জাতির স্বার্থের কথা ভুলে কেবল মধ্যবিত্তের সুবিধা-অসুবিধা দেখার এই ব্যতিব্যস্ততা আমাদের মধ্যবিত্তের একটা অদ্ভুদ প্রবণতা, যেখানে আপনি দেখবেন মাতৃভাষার মাধুর্য নিয়ে বিস্তর আহা উহু, কিন্তু আনুষ্ঠানিক ব্যবহারের সকল পরিসর থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া। ফাহাম আবদুস সালাম আর মুহম্মদ জাফর ইকবাল রাজনৈতিক চিন্তায় দুটি ভিন্ন তরিকার অনুসারী, কিন্তু শিক্ষার বাহন বিষয়ে উভয়ের সাদৃশ্যটি নিতান্তই শ্রেণিগত।
ডুয়িং সায়েন্স ইন বাংলা নামের এই প্রবন্ধটিতে তারপরও মুহম্মদ জাফর ইকবালের বাংলাপ্রেম পস্ট, মুগ্ধ হয়ে তিনি লিখছেন ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ এ্ই বাক্যটা ইংরেজিতে মাত্র একভাবেই বলা যেতে পারে, কিন্তু বাংলায় শব্দগুলো যেভাবেই সাজান না কেন তা শুদ্ধ হবে। তারপরই জানাচ্ছেন অপারগ রায়টি, এই কারণেই হয়তো বাঙলায় কবির সংখ্যা এত বেশি, কিন্তু বিজ্ঞান হওয়াটা কঠিন। মুহম্মদ জাফর ইকবাল আজকে না হলেও অতিদূর ভবিষ্যতে একদিন বাংলাভাষার বিজ্ঞানচর্চার উপযোগী হয়ে ওঠার সম্ভাবনার কথা ওই লেখাতেই বলেছেন : আমার ধারণা আমরা বিজ্ঞানের বই লেখার জন্য বাংলা ব্যবহার করিনি এবং ভাষাটিও বিজ্ঞানকে সংক্ষিপ্ত আকারে ব্যাখ্যা করার জন্য এখনও প্রস্তুত নয়। তাই যতবার আমরা বাংলায় বিজ্ঞান করতে যাই, বইগুললোর ভাষা জটিল এবং বিস্তারিত হয়ে যায়। আমার মনে হয় না এই সমস্যার কোন সরল সমাধান আছে। অনন্যোপায় একমাত্র সমাধানটি শ্রমসাধ্য এবং সময়ক্ষেপক। বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করে বিজ্ঞানগ্রন্থ লেখা চালিয়ে যেতে হবে এবং খুব ধীর গতিতে আমাদের ভাষা বিজ্ঞানের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠবে।
মুহম্মদ জাফর ইকবালের প্রবন্ধের এই অংশটি ইংরেজিতে পাঠ করতে গেলেও পাঠক সম্ভবত লেখকের মনের দ্বিধাটি ধরে ফেলবেন। বর্তমানে বাংলা যদি বিজ্ঞানের উপযুক্ত না হয়ে থাকে, সেটাকে বিজ্ঞানের উপযুক্ত করতে গেলে যদি এতদিন পরও দূর ভবিষ্যতে বহুবহু চর্চার জন্য অপেক্ষা করতে হয়, তাহলে আজ কিংবা অদূর ভবিষ্যতে যারা বিজ্ঞান পড়তে চান, তাদের কি হবে? সমাধান তারা ইংরেজিতেই বিজ্ঞান করবে। এবং ক্রমাগত ইংরেজিতেই যদি আমরা বিজ্ঞানে (এবং আর সবকিছুতে) উচ্চশিক্ষা দিতে থাকি, সমাজে কি ইংরেজি ভাষীদের একটা দখলদারিত্ব ও প্রভূত্ব সৃষ্টি হবার কথা না, যারা নিজেদের সুবিধার জন্য ভাষার এই আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে চাইবে এবং সে জন্য প্রয়োজনীয় বন্দোবস্ত রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি, আমলাতন্ত্র, সামরিক বাহিনী ও শিক্ষাব্যবস্থায় করে ফেলবে? বস্তুত সেটাই ঘটেছে এবং ফলে বাংলায় বিজ্ঞান বা আর কোনো উচ্চতর গ্রন্থ রচনা মরুভূমিতে পানি ছিটানোর মতো নগণ্য পর্যায়ে চলে গেছে।
অথচ এই ধারণার সারবত্তা নিয়েই তো কথা ওঠা উচিত। কিছু সীমাবদ্ধতা হয়তো আছে, কিন্তু তারপরও বাংলা বিজ্ঞানের জন্য এখনো উপযুক্ত না, এই সিন্ধান্ত নেওয়ার জন্য মুহম্মদ জাফর ইকবালও যে যথাযথ ব্যক্তি নন, সেটা আমরা বর্তমান রচনার দ্বিতীয় পর্বেই তো দেখিয়েছি, যেখানে তিনি যথাযথ অনুবাদে ব্যর্থ হয়েছেন নিজেই। আরেকবার তাড়াহুড়ার কারণেই হয়তো তিনি লেখাটির একস্থানে ‘চার্জ’-এর বাংলা করেছেন বিভব এবং বলেছেন, কেন সারাজীবন চার্জ বলতে হবে এমন একটা কিছুকে পদার্থবিদ্যার ছেলেমেয়েরা বিদ্যালয়ে ‘বিভব’ নামে শিখবে? বটেই, বিভব নামে না, চার্জ-এর যথাযথ বাংলা ‘আধান’ হিসেবেই শেখানো দরকার শিশুদের। ‘বিভব’ শিখুক তারা পটেনশিয়ালের বাংলা হিসেবে। এই আধান কিংবা বিভব শব্দগুলোর বিশেষ মহিমা আছে, সেগুলোও শিখুক। এমনকি রড-এর বাংলা রডই চালু হলেও শিখুক দণ্ডই; এবং রাজদণ্ড, বোকামির খেসারত হিসেবে দণ্ড, শাস্তি হিসেবে কারাদণ্ডসহ বাংলাভাষায় দণ্ডের আরো অজস্র ব্যবহারের তাৎপর্য নিয়ে সচেতন হোক, অন্তত অচেতনে অভ্যস্ত হোক। ভাষা হলো জাতির চৈতন্যের বাহন, এই কারণেই চিন, কোরিয়াসহ আরো যারা আমাদেরও বহু পরে পশ্চিমা জ্ঞানের সাথে পরিচিত হয়েছে, তারা যথাসম্ভব প্রতিটা শব্দের নিজস্ব প্রতিশব্দ বানিয়ে নেয়। আমাদের দেশেই বোধ করি পরিচিত পরিভাষাগুলোকে ব্যবহার না করার আর অর্ধপরিচিতগুলোকে চালু করার চেষ্টা না করে ঝেটিয়ে দেওয়ার এই তোড়জোড় শক্তিশালী।
তবে সত্যি সত্যিই এই সংকটের কালটা আমাদের ছিল ঊনিশ শতকে এবং আমাদের পূর্বসূরীরা আধুনিক বিজ্ঞান-দর্শনের মুখোমুখি হয়ে এই সংকটকে অনেকখানিই অতিক্রম করেছেন তাদের হিমালয়সদৃশ নির্মাণযজ্ঞ দিয়ে। কিন্তু ওই ঊনিশ শতকেও কারো বাংলাকে বিজ্ঞানের অনুপযুক্ত বলাটা যথাযথ হতো না, বড়জোর সংকটটাকে চিহ্নিত করে করণীয় নির্ধারণ করা যেতে পারত। কেননা তারা যে পেরেছিলেন, তারও একটা পূর্বপ্রস্তুতি আগে থেকেই হয়ে ছিল কবিতা, দর্শন আর জ্ঞানচর্চার ধারায়। ঔপনিবেশিক নীতিনির্ধারকরা বরং বরাবরই আগ্রহী ছিল প্রভুদের ভাষাতেই উচ্চশিক্ষাকে চাপিয়ে দিতে। ফলে সমাজ মাতৃভাষায় বিজ্ঞানের উপযুক্ত হলেও অন্য বাস্তবতায় তা করা সম্ভব হয়নি। ব্রিটিশরা চলে গেছে বটে, কিন্তু তাদের সৃষ্ট মধ্যবিত্ত স্বার্থ আজও অটুট শুধু নেই, স্বদেশবাসীর ওপর নিজেদের সুবিধাগুলোকে সাধ্যমতো চাপিয়ে দিয়ে বিভাজনটাকে আরো তিক্ত করেছে। ভারতবর্ষ জুড়ে আঞ্চলিক বিরোধকে ধামাচাপা দেওয়ার মাধ্যম হিসেবেও ইংরেজি কাজ করেছে, এতে হিন্দি-উর্দুর বাইরে কোনো স্থানীয় ভাষাই যেন আধিপত্য না বিস্তার করতে পারে, তার জন্য উচ্চশ্রেণির যোগাযোগের মাধ্যম করা হয়েছে ইংরেজিকে। উপনিবেশের আমলে স্বার্থের সংঘাত আর জাতীয়তাবাদী চেতনা মধ্যবিত্তকে বাধ্য করেছিল সাধারণ মানুষের কাছে যেতে। আর আজ সেই মধ্যবিত্ত প্রাণপণে চেষ্টা করছে এই সাধারণ মানুষকেই দমন করতে, অজ্ঞ বানিয়ে রাখতে। মধ্যবিত্ত সচেতন ও অচেতন নানা প্রয়াসে তাই দেখা যাবে নিজের সামাজিক সুবিধাটি টিকিয়ে রাখতে সর্বত্র ইংরেজির আধিপত্যকে জারি রাখার চেষ্টা।
৬.
উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে আইনের ভাষা নিয়ে বিশেষ হাসাহাসির চল আছে। যে ভাষায় ওই পাঠ্যপুস্তকগুলো রচিত, তাতে এই পরিহাস অসংগত নয়। কিন্তু এ কারণে শিক্ষার্থীদেরও একটা বড় অংশের ধারণা হয়েছে যে মানসম্পন্ন আইন-শিক্ষা বাংলায় সম্ভভ না, অথবা বাংলা অকারণ জটিল। অথচ যেকোনো যথাযথ বাংলা জানা লোক আইনের পুস্তকগুলো হাতে নিলে বুঝবেন ওই কিতাবগুলো যারা লিখেছেন তারা আইন যাই জানুক, বাংলা আদৌ জানেন না। এর ভাষা এতটা বিভীষিকাময় বলেই আধো আধো ইংরেজি জানা শিক্ষার্থীও এই ভীতিকর বাংলা পড়ার চেয়ে ইংরেজিতে মুখস্ত করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। মোটামুটি ইংরেজি জানা অংশটা এইভাবে বাড়তি সুবিধা পায় শিক্ষাগত ও পেশাগত জীবনে এবং সঙ্গত কারণেই সেটা টিকিয়ে রাখাই তার স্বার্থ হয়ে দাঁড়াবার কথা। আর সব বিষয়েও পাঠ্যবইগুলোর একই দশা। তাহলে কে উদ্যোগ নেবে বাংলায় বইগুলো লেখার?
এই কাজই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর করার কথা। সেখানে যেমন আছে (বা থাকার কথা ছিল) বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতাসম্পন্ন পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ, তেমনি ভাষাবিদ। তেমনি শিক্ষণ প্রক্রিয়ার বিশেষজ্ঞরা। তাদের সম্মিলিত যৌথ প্রয়াসে নিমেষেই আপনার আমার চালু বাংলায় আইনের কেতাব রচনা সম্ভব; গণবোধ্য না হোক, উৎসুকদের জন্য বোধগম্য ভাষায় বিজ্ঞানের পুস্তক রচনা সম্ভব। এইটুকু প্রস্তুতি বাংলাভাষার বহু আগে থেকেই আছে। আমরা কি জানি আশির দশকেই ভাষাসৈনিক আহমদ রফিকের নেতৃত্বে একটা দল চিকিৎসাবিজ্ঞানের দু-দুটো পাঠ্যপুস্তক বাংলায় তর্জমা হয়েছিল? চিকিৎসাবিদ আর সাহিত্যামোদীদের যৌথ প্রয়াসের একটা অনন্য দৃষ্টান্ত ছিল সেটা। ভাষা আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রকাশ তো আসলে এই-ই। সেই অনুবাদের ভাগ্যে ঘটেছিল করুণ এক পরিণতি, আমাদের আরো বহু কিছুর মতোই। চিকিৎসাশিক্ষার কর্তৃপক্ষ সেটাকে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে অনুমোদন দিতে অসম্মত হয়। আমরা আরো বহু বছরের জন্য রয়ে যাই সেই হতভাগা দেশগুলোর একটাতে যেখানে শিক্ষার্থীরা প্রধানত মুখস্ত করে এবং সামান্যই আত্মস্থ করে চিকিৎসক হন।
৭.
সোফির জগতের অনুবাদক জি এইচ হাবীব ভাই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন একটা দারুণ প্রবন্ধের সাথে, ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ইন দ্য এজ অব শেকসপিয়র। সেখানে শেকসপিয়রের আমলে ইংল্যান্ডে ইংরেজিতে কেন শিক্ষা দেওয়া হতো না, তার কারণগুলো বিষদে বলা আছে। ইংরেজদের মাতৃভাষা ইংরেজিতে জ্ঞানচর্চার বিরুদ্ধে আপত্তিগুলো খুব চেনা ঠেকবে, মনে হবে একালে বাংলাতে উচ্চশিক্ষা প্রদানের বিরুদ্ধে যে ধারণাগুলো মধ্যবিত্তের বাঙালি সমাজে আজও চালু আছে, সেগুলোতেই ভাষার নামটা শুধু কেটে ইংরেজি বসান হয়েছে। উচ্চশ্রেণির চিন্তায় “ইংরেজি ব্যবহারের বিরুদ্ধে আপত্তি বহুবিধ”, যেমন : শিক্ষা উচ্ছন্নে যাবে, কেননা ধ্রুপদী ভাষাশিক্ষার জন্য আর প্রণোদনা থাকবে না। ইতর লোকজনের মাঝে শিক্ষার বিস্তার তো বিপজ্জনক। পাণ্ডিত্যপূর্ণ কাজের জন্য ইংরেজি ভাষা অসুবিধাজনক, কারণ এটাতে প্রয়োজনীয় পারিভাষিক শব্দগুলোর ঘাটতি আছে। ইংরেজি একটা ‘স্থূল’ আর ‘বর্বর’ স্বভাবের ভাষা, নিদারুণ এর প্রকাশের ক্ষমতার অভাব। ভাষাটা অসুবিধাজনক আর অস্থিরমতি, বিপরীতে ধ্রুপদী গ্রিক আর ল্যাতিনে অর্থ সর্বদা ‘স্থিরকৃত’। ব্রিটেনের বাইরে এই ভাষা সাধারণভাবে কেউ জানে না, আর লাতিন একটা আন্তর্জাতিক ভাষা।
বুঝুন দশা, সেই ইংরেজিরই চিরস্থায়ী গোলামে আমাদের পরিণত করার একদম চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চলছে এই দেশে একদম শুরু থেকেই, তাতে গোপন বা প্রকাশ্য সায় আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের বহু মানুষেরই আছে।
বিজ্ঞান ইত্যাদি কাঠখোট্টা বিষয়ে অনেক আলাপ হলো। এবার আসি একটা অবৈজ্ঞানিক আবেগপ্রবণ বিষয়ে। বাংলা চার আর সাতের সাথে ইংরেজি আট আর নয়ের গোলমালে প্রায়ই উৎপাত হয়, মুহম্মদ জাফর ইকবাল ওই লেখাটিতেই জানিয়েছেন তিনি এমনকি তাঁর বিজ্ঞানবিষয়ক বাংলা লেখাতেও ইংরেজি সংখ্যা ব্যবহার শুরু করেছেন। সন্তোষভরে তিনি জানাচ্ছেন আরো অনেকেই নাকি তাই করছে। তিনি তাই প্রস্তাব করেছেন অন্তত গণিত আর বিজ্ঞানের বইতে হিসেবের জন্য যেন ইংরেজি সংখ্যাগুলোই ব্যবহার করা হয়, এটাকে আনুষ্ঠানিক সরকারি রীতি বানিয়ে ফেলা হোক। এই রকম উদাহরণ মানব ইতিহাসে আছে বটে, এমনকি এক একটা আস্ত জাতি পরাধীনতার কারণে পীড়নের বশবর্তী হয়ে তার মাতৃভাষার হরফই বিসর্জন দিয়ে পরের হরফে লিখেছে। কিন্তু সে তো বলপ্রয়োগের ফল, স্বেচ্ছায় এমন উদাহরণ বিরল। বেশির ভাগের সুবিধা বিবেচনা করে আমাদের উচিত ছিল বাংলাদেশের গণনাযন্ত্রগুলোকে বাংলা সংখ্যা ব্যবহারে বাধ্য করা, সেটা না করে এই অত্যল্প লোকের একটা ঝক্কি এড়াবার জন্য সংখ্যাগুলোকেই বদলে ফেলব! পাউন্ড আর কেজির গোলমালে অনেক বড় বড় দুর্ঘটনা জগতে ঘটেছে, কিন্তু ব্রিটিশরা ওজন ছাড়েনি। এই নিয়ে বিদ্যালয়বয়েসে পড়া একটা আলাপচারিতার কথা মনে পড়ছে।কোনো এক জাপানি সাহিত্যিকের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন সম্ভবত মার্কিন এক সাংবাদিক, পরিচয়ের শুধু এটুকুই মনে আছে। সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করছেন, জাপানি হরফ এত জটিল যে তা শিখতে ইংরেজভাষীদের তুলনায় জাপানি শিশুদের অনেক বেশি সময় লাগে।সাহিত্যিক জবাবে বলেছিলেন, কিন্তু এই হরফ শিখেই তো একটা শিশু জাপানি হয়ে ওঠে। বাংলাভাষীরা নতুন সাহিত্যের জন্যই অপেক্ষা করছি, নতুন কবি আর সাহিত্যিকের জন্যও, যাঁরা ভাষা জোগাবেন ভাষার মুক্তির এই লড়াইয়ে।
ফিরোজ আহমেদ: কেন্দ্রীয় সদস্য, গণসংহতি আন্দোলন। সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন।