কলিম খান : বাংলার এরিক ফন দানিকেন

কলিম খান হলেন বাংলা ভাষার এরিক ফন দানিকেন। কলিম খান মনে করেন, ভারতীয় উপমহাদেশে যা কিছু ভালো, মহান সৃষ্টি, চিরকল্যাণকর তা আর্যাবর্তের দান। ভারতীয় সংস্কৃতি-সভ্যতার যাবতীয় গর্বধনের উৎপত্তির মূলে এই বৈদিক সভ্যতা। ভারতবর্ষের যা কিছু বিচ্যুতি, তা সেই প্রাচীন ভারতের সঙ্গে বিচ্ছেদের কারণে। আর বাংলা হলো সেই মহান ভারতের বড় তরফের উত্তরাধিকার।
তাঁর মতে, বাংলা ভাষা হলো সংস্কৃত ভাষার একমাত্র ও অবিকৃত দুহিতা। কিন্তু আর্য-ঔপনিবেশিক এই তত্ত্বটি বহু আগে বাতিল হয়ে গেছে। দীনেশচন্দ্র সেন, এনামুল হক, আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদ প্রমুখ পণ্ডিত এ তত্ত্বের অসারতায় যারপরনাই বিরক্ত ছিলেন। উক্ত পণ্ডিতদের মতে, প্রাণ, গঠন ও প্রবণতায় সংস্কৃতের চেয়ে বাংলাভাষা স্থানীয় সাঁওতাল-মুণ্ডার কাছে বেশি ঋণী। হুমায়ুন আজাদ সংস্কৃতপন্থীদের এই ভয়ংকর অপরাধমূলক দাবির বিরুদ্ধে বাংলা ভাষার একটি বিশুদ্ধ ব্যাকরণ গ্রন্থের প্রয়োজনীয়তার কথা বলতেন। উপযুক্ত প্রণোদনা পেলে তিনি তা লেখার দায়িত্বও নিতে চেয়েছিলেন।
কলিম খানের সমগ্র তত্ত্ব দাঁড়িয়ে আছে এই মহান মিথ্যার ওপরে যে, বাংলা ভাষার জন্ম সংস্কৃতের গর্ভ থেকে। যে মিথ্যার পথ দিয়ে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা ভাষার বলাৎকার ঘটে, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বিকৃতির সূত্রপাতও এই রন্ধ্র দিয়ে (চর্যাপদের নেপাল পলায়ন, অন্ধকার যুগ, রোসাঙ্গের বাংলা সাহিত্যকে মূলধারায় স্থান না দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি)। এমনকি হিন্দু-মুসলমানের নিরিখে ভারতভাগও এই আর্য ভারতীয় চিন্তার ফলাফল।
সিস্টেমেটিক শ্রমিক-শোষণ আবিষ্কারটি হলো মার্কসীয় চিন্তার দরজা। এই সত্যের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে গোটা মার্কসবাদ। শ্রম-শোষণ ব্যাপারটি ভুয়া প্রমাণিত হলে যেমন মার্কসবাদের আলোচনা আগাতে পারে না। তেমন প্রাচীন পৃথিবীতে বুদ্ধিমান মহাকাশচারীদের অস্তিত্ব অস্বীকৃত হলে এরিখ ফন দানিকেনের দেবতত্ত্বটি দাঁড়ায় না। তেমনি সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলার জন্মের প্রস্তাবটি মিথ্যা হলে কলিম খানের পরমা ভাষার তত্ত্বটিও 'সহস্র এক ভারতীয় রজনী'র গল্পের বেশি কিছু হয় না।
প্রাচীন ভারতীয় আর্যসংস্কৃতিকেন্দ্রিক এই হিন্দুত্ববাদের জন্ম কলোনি ভারতে। গোলাম মুরশিদ ‘হাজার বছরের বাঙালি’ বইয়ে লিখেছেন, ‘এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্যদের গবেষণার ফলে ইংরেজ রাজত্ব স্থাপনের ষাট-সত্তর বছরের মধ্যে ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে ভারতবাসীর মনে এক অসাধারণ সচেতনা জেগে ওঠে। এশিয়াটিক সোসাইটির গবেষণা অন্যভাবেও এই স্বাতন্ত্র্যবোধকে চাঙ্গা করেছিল, কোম্পানির গবেষক-কর্মকর্তা কেবল ভারতের প্রাচীন যুগকে গৌরবোজ্জ্বল বলে চিহ্ণিত করেই ক্ষান্ত হননি, সেই সঙ্গে মুসলিম আমলকে চিহ্ণিত করেছিলেন অন্ধকার যুগ হিসেবে। এই তথ্য এবং বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ভারতের গৌরবোজ্জ্জ্বল অতীত ধ্বংস করার জন্য নব্যশিক্ষিত ভারতীয়রা মুসলিম আমলকে দোষারোপ করে এক ধরনের তৃপ্তি লাভ করতে আরম্ভ করেন।’
এশিয়াটিক সোসাইটি ও ফোর্ট উইলিয়ামের এই হিন্দুত্ববাদী চেতনাই পরবর্তী বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি সমাজের গতিপথ প্রভূত নিয়ন্ত্রণ করে। এই আলোকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা ভাষা পুনর্গঠন করা হয়। সংস্কৃত পণ্ডিতেরা বাংলা ভাষা থেকে শল্যচিকিৎসার মতো আরবি-ফারসি শব্দ সরিয়ে সেখানে সংস্কৃত ও তদ্ভব শব্দ যুক্ত করে। বাংলা ভাষার ব্যাকরণাদিও লিখিত হয় সংস্কৃত ব্যাকরণের ছাঁচে। এমন উপর্যুপরি সংস্কৃত অনুপ্রবেশের ফলে একপর্যায়ে বাংলা ভাষার চেহারা ও পরিচয় হয়ে যায় সংস্কৃতির কন্যা হিসেবে! কলিম খান তার পরমাভাষা তত্ত্বটি দাঁড় করিয়েছেন এই কৃত্রিম ও আরো সংস্কৃত-করণাকাঙ্ক্ষী এক বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে।
হিন্দু মহাসভা থেকে হালের আরএসএস-বিজেপি হলো এই নব্য ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের সোল এজেন্ট। গত শতাব্দীর শেষ দশকে যখন ভারতে নব্য হিন্দুত্ববাদ তথা বিজিপি-আরএসএসের উত্থান ঘটে, কলিম খানের ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি বা পরমাভাষা তত্ত্বের উদ্ভবও কাছাকাছি সময়ের ঘটনা। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস, ১৯৯৬ সালে বৃহত্তর দল হিসেবে বিজেপির আবির্ভাব, ১৯৯৮ সালে বিজেপির টেকসই সরকার গঠন, ২০০১ সালে আমেরিকায় আলকায়দার টুইন টাওয়ার হামলা, ২০০২ সালে গুজরাটে মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা—এই কালপর্বটি হলো কলিম খানের তত্ত্বের উদ্ভব ও উৎকর্ষতার কাল। ভারতের নব্য হিন্দুত্ববাদের এই স্বর্ণসময়ে ১৯৯৯ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত পড়াশোনার সুবাদে আমি কলকাতায় ছিলাম। এই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যখন ভূপেন হাজারিকারা যোগ দিচ্ছেন বিজেপিতে। মহাশ্বেতা দেবীরা সিপিএম ছেড়ে যাত্রা করছেন তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিজেপিপ্রেম তখন তুঙ্গে। দিল্লির দোর্দণ্ড প্রতাপে ২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জ্যোতি বসুর ‘পরাজয়’ নিশ্চিত ধরে ‘বদলে দিন-পাল্টে দিন’ আওয়াজে পশ্চিম বাংলার পিলে চমকে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই প্রপাগান্ডায় অংশ নিয়ে কলিম খান ২০০০ সালের অক্টোবরে প্রকাশ করেন তার ‘জ্যোতি থেকে মমতায়’ বইটি। তথাপি দুই মেয়াদ ক্ষমতায় থাকলেও বাংলায় তখন আক্ষরিক অর্থে ভেঙে পড়ছে চৌত্রিশ বছরের বাম রাজত্ব। এই নতুন হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় সমাজের উত্থানের আওয়াজই কলিম খানের তত্ত্বে ধ্বনিত হতে দেখা যায়।
ঋগবেদে বেজ আর সুপারস্ট্রাকচারের সন্ধান তাই কলিম খান একা আবিষ্কার করেন না; গণেশের মাথায় হাতির মুণ্ডু স্থাপনে নরেন্দ্র মোদি কসমিক সার্জারি, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ধৃতরাষ্ট্র-সঞ্জয়ের কথোপকথনে বিপ্লব দেব ইন্টারনেট-স্যাটেলাইট ও রামায়নের পুষ্পকরথে সত্যপাল সিংহও বিমানের অস্তিত্ব খুঁজে পান। এই ঐক্য নেহাত কাকতাল নয়।
অবশ্য এত করেও কলিম খান বিজেপি বা আরএসএসের মনোযোগ কাড়তে পারেননি। কারণ প্রথমত, আর্যভারতের বিশুদ্ধ রক্তের অগ্নিপরীক্ষায় তিনি ধরাশায়ী হন। ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের বিশুদ্ধতার তত্ত্বটি বহুআগে রবীন্দ্রনাথ ‘গোরা’ উপন্যাসে গোচর করলেও কলিম খান আমলে নিতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, তাঁর তত্ত্ব-তালাশের তূরীয়-সময়ে ২০০৪ সালে ১০ বছরের জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় শাসন থেকে বিজেপি জমানার অন্তর্ধান ঘটে। ২০১১ সাল পর্যন্ত পশ্চিম বাংলার তখতে ছিল বিজেপিবিরোধী সিপিএম সরকার। ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস বাংলায় সরকার গঠন করলেও তত দিনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিজেপির সম্পর্ক সাপে-নেউলে। মুসলমান ভোটব্যাংকের একক তহশিলদার তখন খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই সিপিএমের পতনেও আর্যভারতের শ্রেষ্ঠত্ব-বাহক পরমাভাষা তত্ত্বটি সরকারি আনুকূল্য লাভে ব্যর্থ হয়। তবে বস্তুতপক্ষে কলিম খানের তত্ত্বটি আর্যতর সমাজের চেতনা পরিপন্থী হওয়ায় তা বাংলা ভাষার বড় স্বত্বাধিকারী বাংলাদেশসহ ভারতের বাঙালি জনগোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। বাংলা ভারতবর্ষের প্রধান শঙ্করভূমি, আর্য-প্রতিরোধের সবচেয়ে দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ ইতিহাসও বাংলার। নব্য হিন্দুত্ববাদ উৎসারিত কলিম খানের তত্ত্বের ট্র্যাজিক পরিণতির কারণ এখানেই।