আধুনিক ও প্রাচীন দাসের পার্থক্য : তুলনামূলক বিচার

সমসাময়িককালে বিভিন্ন পক্ষ থেকে ‘দাসপ্রথা’র অস্তিত্বের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু ‘আধুনিক দাস’ হিসেবে উল্লেখ যাদের কথা আসছে বারবার, আসলে তারা কারা, এর দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে সেটা তত্ত্বতালাশ করার সচেষ্ট প্রয়াস এই লেখা। প্রাচীন ও মধ্যযুগের দাসদের সঙ্গে বর্তমান যুগের দাসদের তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে।
২০১৮ সালের জুলাইয়ে ওয়াক ফ্রি ফাউন্ডেশন নামে অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক একটি সংগঠন গ্লোবাল স্লেভারি ইনডেক্স (বিশ্ব দাসত্ব সূচক) প্রকাশ করেছে। এতে ১৬৭টি দেশে তারা জরিপ চালিয়ে দেখেছে, এসব দেশে আধুনিক দাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের নাম রয়েছে।
ওয়াক ফ্রি ফাউন্ডেশন জানায়, ৪০ দশমিক ৩ মিলিয়ন (চার কোটি তিন লাখ) মানুষ ‘আধুনিক দাস’ হিসেবে জীবনধারণ করছে। বাংলাদেশে এ ধরনের দাসের সংখ্যা পাঁচ লাখ ৯২ হাজার, যুক্তরাষ্ট্রে চার লাখ তিন হাজার, যুক্তরাজ্যে এক লাখ ৩৬ হাজার, ভারতে ৭৯ লাখ ৮৯ হাজার, চীনে ৩৮ লাখ ৩৬ হাজার।
কোন কোন অবস্থায় বা কোন কারণে মানুষ আধুনিক দাস ব্যবস্থার শিকার হয়েছে, সেগুলো বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন : ভৌত ও ভাষাগত কারণে বিচ্ছিন্নতা, সাংস্কৃতিক পরিচয় সম্পর্কে অজ্ঞানতা, ঋণের বোঝার কাছে নতি স্বীকার এবং নিজের অধিকার সম্পর্কে ধারণা না থাকার মতো বিষয়গুলো উল্লেখ করেছে ওয়াক ফ্রি ফাউন্ডেশন।
প্রাচীনকালের দাসদের সম্পর্কে ‘প্রাচীন ভারতে দাসপ্রথা’ বইয়ে কথা বলেছেন ভারতবিদ ও ইতিহাসবিদ দেব রাজ চানানা। ‘দাস’-এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তিনি বলছেন, ‘প্রভুর দ্বারা নিরঙ্কুশভাবে অধিকৃত এবং প্রভু যাকে নিজের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করেন এমন যেকোনো মানুষ।’(প্রাচীন ভারতে দাসপ্রথা, পৃষ্ঠা-১)
বৌদ্ধযুগে, ঋগ্বেদের সময়ে দাসপ্রথা চালু ছিল বলে জানিয়েছেন চানানা। বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটকে বলা হয়েছে, ‘দাস তাঁর নিজের প্রভু নন, অপরের ওপর নির্ভরশীল এবং ইচ্ছামতো যেখানে-সেখানে যেতে পারেন না।’(প্রাচীন ভারতে দাসপ্রথা, পৃষ্ঠা-৯১)
ত্রিপিটকের প্রথম ভাগ, অর্থাৎ বিনয় পিটকে চার ধরনের দাসের কথা বলা হয়েছে। যথা : ১. গৃহে জাত দাস, ২. ক্রীতদাস, ৩. যুদ্ধদাস ও ৪. স্বেচ্ছাদাস।
আধুনিক দাসের ‘চালচলন’ বা বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে ত্রিপিটকে উল্লিখিত শেষোক্ত ধরনের দাসের মিল রয়েছে। ‘স্বেচ্ছাদাস’ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘এই ধরনের দাসত্ব পুরোপুরি স্বেচ্ছাপ্রসূত ছিল না। এসব ক্ষেত্রে কতক পরিস্থিতির চাপে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো। সেখানে পরিস্থিতির বলি ব্যক্তিটি বাধ্য হয়ে স্বাধীনতা বিসর্জন দিতেন।’ (প্রাচীন ভারতে দাসপ্রথা, পৃষ্ঠা-৯৩)
আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে ভারতে আর্যদের আগমন। এখানে তারা স্থানীয় উপজাতিগুলোর বিরোধের মুখে পড়ে। তারা একে অপরকে শত্রু মনে করত। এই ‘শত্রুদের’ মধ্যে ‘দাস’ নামের একটি উপজাতিও ছিল, যার অন্য নাম পনি। আর্যদের প্রধান সম্পদ ছিল গরু আর দাস উপজাতির লোকজন গবাদিপশু অপহরণ করত। ফলে এদের মধ্যে লড়াই বা যুদ্ধ লেগেই থাকত। বাংলা একাডেমির অভিধানেও এই দাসদের অনার্য উপজাতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ সম্পর্কে ভারতীয় ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার বলছেন, “তবে যুদ্ধে আর্যরাই যে বিজয়ী হয়েছিল, তা পরিষ্কার। কেননা ‘দাস’ শব্দের অর্থ হয়ে দাঁড়াল গোলাম। গায়ের কালো রং ও নাকমুখের ভোঁতা ভাবের দরুণ এই দাসদের নিচুশ্রেণি বলে ধরা হলো। আর্যদের গায়ের রং ছিল ফরসা ও নাকমুখ তীক্ষ্ণ।” (ভারতবর্ষের ইতিহাস পৃষ্ঠা-১৮) দেখা যাচ্ছে, যুদ্ধ জয়ের ফলে একটা শব্দের অর্থ বদলে গেল। এ রকম ঘটনা অত্যন্ত নিকট ইতিহাসেও দেখা গেছে। শুধু অর্থই বদলায় না, ইতিহাসে এদের ভূমিকাও পাল্টে যায়।
এদিকে, আধুনিক যুগের দাসপ্রথা অবসানের আহ্বান জানিয়েছে ‘এন্ড স্লেভারি নাও’ নামে একটি সংগঠন। তারা ছয় ধরনের ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করেছে, যেখানে কোনো না কোনোভাবে দাসদাসী জোরপূর্বক নিয়োজিত। এগুলো হলো : ১. গৃহস্থালি কাজে, ২. যৌনকর্মে, ৩. ফোর্সড লেবার (হুমকির মুখে পারিশ্রমিক ছাড়া কাজ), ৪. বন্ডেড লেবার (ঋণ পরিশোধের জন্য কাজ), ৫. শিশুশ্রম, ৬. জোরপূর্বক বা অসম্মতিতে বিয়ে।
শতকের পর শতক দাসপ্রথার প্রচলন ছিল ইউরোপ-আমেরিকায়। আফ্রিকা থেকে ধরে দাস বেচাকেনা হতো। এই বাণিজ্য ছিল অত্যন্ত লাভজনক। ইউরোপ-আমেরিকার হাজার হাজার পরিবার এ থেকে উপকৃত হয়েছে। এ ব্যবসা থেকে জাত ধনদৌলত বংশপরম্পরায় উত্তরসূরিরা ব্যবহার করছে। ব্রিটেনে দাসপ্রথার অবসান হয় ১৮৩৩ সালে। সে বছর স্লেভারি অ্যাবলিশন অ্যাক্ট (দাসত্ব নির্মূল আইন) প্রবর্তন হয়। যুক্তরাষ্ট্রে হৃদয়হীন এই প্রথা নির্মূল করা হয় ১৮৬৫ সালে, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে।
২০১৫ সালে দাসপ্রথা নিয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান। এতে জনপ্রিয় অভিনেতা ও পরিচালক বেন অ্যাফ্লেকের পূর্বপুরুষদের দাস ব্যবসার কথা বলা হয়েছে। গার্ডিয়ান জানায়, অ্যাফ্লেকের প্রপ্রপ্রপিতামহ (গ্রেট গ্রেট গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার) আলেকক্সান্ডার এল কোল ১৮৫৮ সালে ২৪ দাসদাসীর মালিক ছিলেন। ব্রিটেনে দাসপ্রথা নির্মূল আইন প্রচলনের পরও যে এই প্রথা চালু ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া গেল। এ ঘটনার বছরখানেক আগেই (১৮৫৭) ব্রিটিশ সেনারা ভারতের বিদ্রোহী সিপাহিদের পরাজিত করে—সিপাহি বিদ্রোহকে অনেকেই ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবেও দেখে থাকেন।
যাই হোক, বেন অ্যাফ্লেক তাঁর পূর্বপুরুষের এই কৃতকর্মের জন্য জনসমক্ষে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। তিনি এ জন্য বিব্রত বোধ করছেন বলেও জানিয়েছেন।
যেকোনো রূপেই দাসপ্রথা চালু থাক, আধুনিক সভ্য সমাজে কেউ এখন আর চায় না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের উন্নত, উন্নয়নশীল, অনুন্নত সব দেশেই কম আর বেশি দাসপ্রথা তার আধুনিক আঙ্গিক নিয়ে টিকে রয়েছে। আর হ্যাঁ, প্রাচীনকালে বা মধ্যযুগে যে দাস ব্যবস্থার প্রচলন ছিল, তা সেটা গ্রিস, যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, যেখানেই হোক না কেন, তার পক্ষে আইন ছিল। অর্থাৎ অমানবিক এই প্রথা ছিল আইনসম্মত। বর্তমানে কোনো দেশের আইনেই তার স্বীকৃতি নেই।
লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
তথ্যনির্দেশ
১. থাপার, রোমিলা (১৯৮০), ভারতবর্ষের ইতিহাস, কলকাতা : ওরিয়েন্ট লংম্যান, অনু. কৃষ্ণা গুপ্তা
২. চানানা, দেব রাজ (১৯৯৫), প্রাচীন ভারতের দাসপ্রথা, কলকাতা : কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি, অনু. জয়তী দত্ত
৩. https://www.theguardian.com/world/2015/jul/12/british-history-slavery-bu... (Last accessed 10 August 2018)
4. https://www.walkfreefoundation.org/ (Last accessed 09 August 2018)
5. https://www.globalslaveryindex.org/2018/findings/regional-analysis/overv... (Last accessed 09 August 2018)
6. http://www.endslaverynow.org/learn/slavery-today?gclid=Cj0KCQjwzK_bBRDDA... (Last accessed on 9 August 2018)
7. https://www.nationalgeographic.org/interactive/slavery-united-states/(Last accessed on 9 August 2018)