বঙ্গবন্ধুকে পাঠের পর

‘রেণু কয়েকটা খাতা কিনে রেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছে। রেণু আরো একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে বসলাম।’ সহধর্মিণী যাঁকে তিনি রেণু বলে ডাকতেন, তাঁর অনুপ্রেরণায় বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতির কবি উঠতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিজে বাংলাদেশ নামের এই জাতিরাষ্ট্রের সুবর্ণ ইতিহাস রচনা করেছিলেন। আর তাঁর রেণুর অনুপ্রেরণায় সেই ইতিহাসের গ্রন্থিকও হয়ে ওঠেছিলেন তিনি। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ রাজনীতির শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান গবেষক, সাহিত্যিক কিংবা একজন সাধারণ পাঠকের কাছেও এখন শেকড়ের অনুসন্ধান কিংবা দেশাত্মবোধ জাগানিয়া মহাকাব্যিক উপাখ্যান। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শিল্পচর্চা করা, কবিতা বা উপন্যাস রচনা করা, চলচ্চিত্র নির্মাণসহ গবেষণামূলক সকল জ্ঞানানুসন্ধানে বঙ্গবন্ধুর এই পাঠ তাই অনিবার্য।
কোনোরূপ রেফারেন্স বা রেকর্ডের ওপর ভরসা না করে কেবলমাত্র নিজের অসাধারণ বিশ্বস্ত স্মৃতির ওপর নির্ভর করে বঙ্গবন্ধু তাঁর শ্রমসাধ্য রচনা কর্মে যেভাবে মানুষের যাপিত জীবনের আখ্যান ও বাংলাদেশ বিনির্মাণের পূর্বাপর ইতিহাস তুলে ধরেছেন এক কথায় তা অবিস্মরণীয়। জীবনগল্পের গাঁথুনিটা যখন সত্যনিষ্ঠ হয় তখন তা এরূপ মহত্তম শিল্পই হয়ে ওঠে।
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ৯২(ক) ধারা জারি করে মন্ত্রিসভা বরখাস্ত করেছে। মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জাকে পূর্ব বাংলার গভর্ণর করা হয়েছে। শেখ মুজিব তাই আর মন্ত্রী নন। সরকারি গাড়ি ছেড়ে দিয়ে রিকশায় বাসায় ফিরে স্ত্রীর কাছে শুনলেন, পুলিশ বাসায় এসেছিল তাঁকে অ্যারেস্ট করতে।
‘রেণু আমাকে খেতে বলল, খাবার খেয়ে কাপড় বিছানা প্রস্তুত করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জনাব এহিয়া খান চৌধুরীকে ফোন করে বললাম, আমার বাড়িতে পুলিশ এসেছিল, বোধহয় আমাকে গ্রেফতার করার জন্য। আমি এখন ঘরেই আছি গাড়ি পাঠিয়ে দেন। আমি তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে ফোন ছেড়ে দিলাম। রেণু আমার সকল কিছু ঠিক করে দিল এবং কাঁদতে লাগল। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে। ওদের উঠাতে বারণ করলাম। রেণুকে বললাম, তোমাকে কী বলে যাব, যা ভালো বোঝ কর, তবে ঢাকায় থাকলে কষ্ট হবে, তার চেয়ে বাড়ি চলে যাও।’ অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ২৭১ পৃষ্ঠার এই গল্প যে কোন ট্র্যাজিক উপাখ্যানের বীজ হয়ে উঠতে পারে।
তখন নির্বাচনী প্রচারণাকাল। ২৫৫ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার মনে আছে খুবই গরিব এক বৃদ্ধ মহিলা কয়েক ঘন্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, শুনেছে এই পথে আমি যাব, আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বলল, বাবা আমার কুঁড়েঘরে তোমায় একটু বসতে হবে। আমি তার হাত ধরেই তার বাড়িতে যাই। অনেক লোক আমার সাথে, আমাকে মাটিতে একটা পাটি বিছিয়ে বসতে দিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান ও চার আনা পয়সা এনে আমার সামনে ধরে বলল, খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছুই নাই। আমার চোখে পানি এল। আমি দুধ একটু মুখে নিয়ে সেই পয়সার সাথে আরো কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বললাম, তোমার দোয়া আমার জন্য যথেষ্ট, তোমার দোয়ার মূল্য টাকা দিয়ে শোধ করা যায় না। টাকা সে নিল না, আমার মাথায় মুখে হাত দিয়ে বলল, গরীবের দোয়া তোমার জন্য আছে বাবা। নীরবে আমার চক্ষু দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল, যখন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। সেইদিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মানুষেরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না।’
বঙ্গবন্ধুকে পাঠ করলে যে কেউ অনুধাবন করবেন, তিনি কেবল ‘পয়েট অব পলিটিকস’ নন, মানুষ ও ভূমির অনন্য কথাকারও ছিলেন বটে। তাঁর রচিত জীবনী, রোজনামচা, চিঠিপত্র ও বক্তৃতামালার প্রতিটি বাক্য, সংলাপ বা অনুচ্ছেদই যেন সুসাহিত্যের বসতবাড়ি। বঙ্গবন্ধু রাজনীতির পাশাপাশি সাহিত্যের একজন সমঝদার পাঠক হয়ে ওঠেছিলেন। সাহিত্যিকদের তিনি ভালোবাসতেন। তাঁর চিন্তা ও চেতনায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন। তাই একজনকে করলেন আমাদের জাতীয় কবি, আর অপরজনের অমীয় বাণী ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’কে করলেন আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। কারাগারে বসেও তিনি বিশ্বের প্রভাবশালী পত্রপত্রিকা, রাজনীতি বা সাহিত্যের বই পড়তে চাইতেন। কিন্তু পাকিস্তানি কারা কর্তৃপক্ষ তাঁকে বেশিরভাগ সময়ই বিমুখ করত।
যেকোনো অধিকার আদায়েই ত্যাগ থাকে, সংগ্রাম, শ্রম ও একাগ্রতা থাকে। বঙ্গবন্ধুর পাণ্ডুলিপি হলো সাহিত্য ও শিল্পের শীর্ষ মর্যাদায় অভিষিক্ত জীবনের শ্রেষ্ঠতম জীবনালেখ্য আর অধিকারবোধ ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামের পথপ্রদর্শক।
শোষিত মানুষের পক্ষাবলম্বন করতে গিয়ে দুঃখ দুর্দশা কিংবা রাষ্ট্রীয় নির্যাতন বঙ্গবন্ধুর পিছু ছাড়েনি। অন্যান্য মামলার সাথে শেখ মুজিবের নামে ছয় সাতটা বক্তৃতার মামলাও থাকত। সেসব মামলা জামিনযোগ্য হলেও পাকিস্তানি কোর্ট প্রায়ই জামিন বাতিল করে জেলে অন্তরীণ করে রাখতেন। সেই সময় রবীন্দ্রকাব্যে তিনি সাহস খুঁজতেন। ২৩-২৭ এপ্রিল ১৯৬৭-এর কারাগারের দিনলিপিতে বঙ্গবন্ধু লিখেন :
‘আমার পক্ষে সবই সমান। আর একটা মামলায়ও আমার জেল আছে বৎসর। সেটাও বক্তৃতা মামলা, হাইকোর্টে পড়ে আছে। কনফার্ম করেছে এক বৎসর খাটতে হবে যদি হাইকোর্ট থেকে মুক্তি না পাই। বুঝতে পারলাম আরো যে ছয়-সাতটা বক্তৃতার মামলা আছে সব মামলাই নিচের কোর্টে আমাকে সাজা দিবে। শুধু মনে মনে বললাম, বিপদে মোরে রক্ষা কর/ এ নহে মোর প্রার্থনা,/ বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’
সঙ্গীত ভালোবাসতেন বঙ্গবন্ধু। আত্মজীবনীর ১১১ পৃষ্ঠায় সকৃতজ্ঞ চিত্তে উল্লেখ করেছেন, ‘নদীতে বসে আব্বাসউদ্দীন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে।’ সাহিত্যের নিবিষ্ট পাঠক বঙ্গবন্ধু তাঁর লেখায় সশ্রদ্ধায় স্মরণ করেছেন তুর্কি কবি নাজিম হিকমত, মার্কিন লেখক হেনরি ডেভিড থরো, পাকিস্তানের জাতীয় কবি আল্লামা ইকবাল, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মওলানা আকরম খাঁ, আবুল মনসুর আহমদ, রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, অজিত কুমার গুহ, মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সারসহ গুণী সাহিত্যসেবী ও সংস্কৃতিজনদের নাম।
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ট্র্যাজিক নায়ক বঙ্গবন্ধুর রসবোধও ছিল প্রবল। গোপালগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী মুসলিম লীগের কনভেনর কাজী আলতাফ হোসেন ও বঙ্গবন্ধু যাচ্ছিলেন নিজেদের একই ইউনিয়নের লালবাগ মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা শামসুল হক সাহেবের সাথে দেখা করতে। আত্মজীবনীর ১২৫ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষায় একটি সামান্য ঘটনার উল্লেখ করেছেন। দুজন রাত ১০টায় একটা এক মাঝির নৌকায় রওনা হলেন। নদীর এক চওড়া জায়গায় ডাকাত পড়ল। ক্লান্ত বঙ্গবন্ধু তখন ঘুমাচ্ছিলেন। আগুন চাওয়ার নাম করে চারজনের ডাকাতদল নৌকাটির কাছে এসেই হুঙ্কার ছাড়ল, নৌকা যাবে কোথায়? ভয়ে জড়সড় মাঝি উত্তর দিল টুঙ্গিপাড়া! এরপর ডাকাতদের প্রশ্ন নৌকায় কে? মাঝি উত্তরে বঙ্গবন্ধুর নাম বললে ডাকাতদলের সর্দার বৈঠা দিয়ে ভীষণভাবে আঘাত করে বলল, ‘শালা আগে বলতে পার নাই শেখ সাহেব নৌকায়!’ মাঝির চিৎকারে বঙ্গবন্ধুর ঘুম ভাঙলে কাজী সাহেব ও মাঝি এই গল্প বঙ্গবন্ধুকে বললেন। কাজী সাহেব বললেন, ‘ডাকাতরা আপনাকে শ্রদ্ধা করে। আপনার নাম করেই বেঁচে গেলাম, না হলে উপায় ছিল না। রসিক বঙ্গবন্ধু প্রত্যুত্তর দিলেন, ‘বোধহয় ডাকাতরা আমাকে ওদের দলের একজন বলে ধরে নিয়েছে।’
মওলানা ভাসানি, শামসুল হক ঢাকা জেলে এক সেলে বন্দি। হক সাহেব রাত ১২টার পরে এক দুই ঘণ্টা পর্যন্ত আল্লাহু আল্লাহু করে জোরে জিকির করতেন। তাঁর সশব্দ আরাধনায় সেলের আশপাশে থাকা দশ-পনেরজন সবারই ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছিল। কয়েদিরা দিনভর কাজ করে। রাতে না ঘুমিয়ে পারে না। মওলানা সাহেবের কাছে এ ব্যাপারে নালিশ করেও কোনো প্রতিকার হলো না। একদিন দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়ার পরে হক সাহেবকে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘এভাবে চলবে কেমন করে? রাতে ঘুমাতে না পারলে শরীরটা তো নষ্ট হয়ে যাবে।’ হক সাহেব রেগে উত্তর দিলেন, ‘আমার জিকির করতে হবে, যা ইচ্ছা কর। এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাও।’ কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে বঙ্গবন্ধু এবার বললেন, ‘রাতে যখন জিকির করবেন আমি উঠে আপনার মাথায় পানি ঢেলে দেব, যা হবার হবে।’ হক সাহেব আস্তে আস্তে বললেন, ‘বুঝতে পারছ না কিছুই, আমি সাধনা করছি। একদিন ফল দেখবা।’ কি আর করা যাবে, নীরবে সহ্য করা ছাড়া। হক সাহেবের শরীর খারাপ হয়ে চলেছে। আত্মজীবনীর ১৬৯ পৃষ্ঠা এমন সাক্ষ্যই দেয়।
একাত্তরের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ পুরোদস্তুর এক অমর কবিতা। ‘আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না, রক্ত যখন দিয়েছি আরো দেব এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ’র মতো দৃঢ়চেতা দ্রোহের প্রত্যয় বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেই আর কোনো কবিতায় মেলে?
এমন এক মহৎপ্রাণ মানুষকে দেশবিদেশের বড় সাহিত্যিকরা যেমন প্রভাবিত করেছেন, তেমনি প্রথিতযশা বাঙালি কবিরাও তাঁদের কাব্যে সগৌরবে বঙ্গবন্ধুর কথাই বলেছেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ও তাঁর পরিবারের ট্র্যাজিক বিদায়ের পর শোকাভিভূত কবি অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন :
‘যতকাল রবে পদ্মা মেঘনা গৌরি যমুনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’
স্বাধীনতাবাদী মুজিবীয় অবিনশ্বর আদর্শবাদিতার কাছ থেকে প্রেরণা নিয়ে কবিতায় বঙ্গবন্ধুর কথা সগর্বে বলেছেন আমাদের কবি নির্মলেন্দু গুণ :
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন৷...
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন
তাঁর অমর -কবিতা খানি :
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।
বেদনার সমুদ্র মন্থন করে কোটি মানুষের মুখে আলো ফুটিয়ে একটা দেশ এনে দেয়া আমাদের সেই জাতির পিতার ভালোবাসার দায় আমরা বড় নির্মমভাবে শোধ করেছি। আমাদের এই অক্ষমতার অভিশাপ কোনোদিন কি ঘুচবে? আত্মজীবনীর প্রথম পাতায় বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেছেন, ‘নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।’ রাজনীতির কুশলী শিল্পী বঙ্গবন্ধুর সেই সামান্য ত্যাগেই আমরা ঢাকা পড়ে আছি মানবীয় মানচিত্রের আদিগন্ত। কবি রফিক আজাদের উচ্চারণ তাই চির সত্য ও সুন্দর:
স্বদেশের মানচিত্র জুড়ে পড়ে আছে
বিশাল শরীর...
তাঁর রক্তে এই মাটি উর্বর হয়েছে,
সবচেয়ে রূপবান দীর্ঘাঙ্গ পুরুষ,
তার ছায়া দীর্ঘ হতে হতে
মানচিত্র ঢেকে দ্যায় সস্নেহে আদরে!