বৈশাখী লোকাচার

পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বর্ষশুরুর দিনটি পালন করা হয় সোৎসাহে। এমনকি কোনো কোনো দেশে এই দিনটি রূপ নেয় জাতীয় উৎসবে। আমাদের বাংলা সনের প্রথম দিনটিকেও উদযাপন করা হয় বিপুল সমারোহ ও বর্ণিল মেজাজে। শুধু নববর্ষের প্রথম দিনেই নয়, বর্ষশুরুর প্রথম মাস, বৈশাখজুড়ে থাকে বিভিন্ন রকম উৎসব, আয়োজন আর বিশেষ বিশেষ কিছু রীতিনীতি, লোকসংস্কার, ধর্মীয় আচার—এককথায় নানা রকম লোকাচার। বাংলাদেশের মতো কৃষিজীবী সমাজে বর্ষশুরুর দিনক্ষণ নিয়ে প্রাকৃতিক ও অতীন্দ্রিয় শক্তির প্রতি কিছুটা বিশ্বাস ও লোকসংস্কার রয়েছে এখানে। ব্যাপারটি যেহেতু কৃষি বিষয়ে তাই মনে রাখা দরকার, বৃষ্টি ছাড়া এ পেশা অনেকটাই নিষ্ফল ও অর্থহীন। আর সে কারণেই তারা তাকিয়ে থাকে বছরের প্রথম দিনটির দিকে, যেদিন বৃষ্টি হবে আর জাগতিক সব কাজের প্রথম দিন হিসেবে কৃষকের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ বছর হিসেবে চিহ্নিত হবে।
নববর্ষের আগের দিন রাতে, অর্থাৎ চৈত্রসংক্রান্তির রাতে আমাদের দেশের কোথাও কোথাও চাষি পরিবারের গৃহিণীরা ‘আমানী’ নামক এক ধরনের খাবার তৈরি করে রাখে। বড় হাঁড়ির ভেতর অনেকখানি পানি দিয়ে তাতে চাল ও কিছু আম ভিজিয়ে রাখা হয়। আর হাঁড়ির ভেতর ডুবিয়ে রাখা হয় আমের ডাল। সারা রাত আমের সঙ্গে চাল মিশিয়ে রাখা হয় বলে ভেজা চাল কিছুটা টক স্বাদ ধারণ করে। এই টক চাল পরদিন ভোরে গৃহিণীরা পরিবেশন করেন বাড়ির সবার জন্য। আর খাবার খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আমের ডাল দিয়ে তাঁরা সবার গায়ে ছিটিয়ে দেন পানি। বলা হয়ে থাকে, ওই পানি ছিটানোর অর্থ হলো যাদের গায়ে পানি ছিটানো হলো, তাদের দেহ সারা দিন ঠান্ডা থাকবে। গবেষকরা ধারণা করেন, এই আচারের মধ্যে প্রোথিত রয়েছে সুদীর্ঘকাল ধরে লালিত লোকসংস্কারজাত বিশ্বাসটি যে, পানি ছিটানোর মধ্য দিয়ে বৈশাখের তপ্ত দিনে নেমে আসবে বৃষ্টিধারা। আর বৃষ্টি নামা মানেই তো কৃষকের মুখে হাসি। পানি ছিটানোর পরে আসে টক খাওয়ানোর ব্যাপারটি। লোকবিশ্বাস, টক খেলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে। তাই বছরের প্রথম দিনটিতে টক খেলে সারা বছর পরিবারের লোকজন থাকতে পারবে সুস্বাস্থ্যের মধ্যে।
আমরা নগরবাসী ফ্যাশন করেই হোক আর লোককৃতি পালনের ঐতিহ্যানুসারেই হোক, নববর্ষের আগের দিন রাতে ভাত ভিজিয়ে রাখি সারা রাত, যাতে পরদিন পান্তা খেয়ে শুভ নববর্ষের দিনটি জাঁকালোভাবে পালন করা যায়। এই লোকাচারের উৎস আমাদের কৃষকসমাজ। পয়লা বৈশাখের ভোরে তাঁরা আগের রাতে রান্না করা পান্তা খেয়ে খেতে হাল চাষ করতে যান। কৃষকের এই পান্তা খাওয়ার মধ্যে বছরজুড়ে তাঁর অন্নপ্রাপ্তির কামনা খুব সুন্দরভাবে প্রকাশ পায়।
বৈশাখকে কেন্দ্র করে বাঙালির আরো অনেক লোকাচার রয়েছে। চট্টগ্রামে এখনো অনেক জায়গায় বৈশাখ মাসের সকালবেলা একমুঠো চাল ও এক কত্তি বা বদনা ঠান্ডা পানি খেয়ে চাষিরা মাঠে লাঙল দিতে যান। দেশের নানা স্থানে হিন্দু ধর্মীয় গৃহিণীরা চালের নাড়ু তৈরি করে রাখেন পয়লা বৈশাখের দিন। আর তা খায় পয়লা জ্যৈষ্ঠে। এ সম্পর্কিত প্রবাদও রয়েছে : বৈশাখে রাখে জ্যৈষ্ঠে খায়, যত পায় তত চায়। বৈশাখের রাম নবমী উৎসবে দোকানপাট কুলাচিত্রে সাজানোর রেওয়াজ আছে।
বৈশাখের অনাবৃষ্টি ও খরার সময় বাংলাদেশের প্রায় সবখানেই বিশেষ নামাজ আদায়ের চল লয়েছে। এই নফল নামাজ শেষে হাত উঁচিয়ে আল্লাহর কাছে সবাই প্রার্থনা করেন, যাতে করে বৃষ্টি এসে ফসলকে রক্ষা করবে। জাতীয় পর্যায়ে সরকারি নির্দেশেও মাঝেমধ্যে নামাজ শেষে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করা হয়। এ সময়টাতে হিন্দুরা বরুণ পূজার আয়োজন করেন বৃষ্টি চেয়ে। দেশের কোনো অঞ্চলে এ সময়ে দেখা যায় ব্যাঙ বিয়ের আয়োজন। দুটো কুনো ব্যাঙকে ধরে বর ও কনে সাজানো হয়, পরস্পরের মধ্যে বিয়ে দেওয়া হয়। গ্রামের ছোট্ট ছেলেমেয়ের দল সোৎসাহে আনন্দঘন এ কাজটি করে। বিয়ের পর ব্যাঙ দুটিকে নদী, পুকুর কিংবা খালের ধারে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। ছেড়ে দেওয়ার সময় ছেলেমেয়ের দল একযোগে ছড়া কাটে—
বেঙ্গা ঝির বিয়া, সোনার মুকুট দিয়া
ও বেঙ্গা মেঘ দিছনা কেয়্যা।
বেঙ্গে বইছে ঘাডঅ, করিম গঞ্জের হাডঅ
ও বেঙ্গা মেঘ দিছনা কেয়্যা।
উড়ি পাতায় ছাইলাম ছানি, তেওনা পরে মেঘের পানি
বেঙ্গারে একফোঁটা শেঘ দেওরে খাই।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায় বৈশাখের তপ্ত দিনগুলোতে গাওয়া হয় ‘মেঘরাজার গান’। বৃষ্টির জন্য প্রার্থনাস্বরূপ এই আচার এখানে বেশ জনপ্রিয়। বৈশাখ যেহেতু ফসল বোনার মাস, তাই বৃষ্টি এ সময়টাতে চরম আকাঙ্ক্ষিত হয়ে ওঠে। কৃষক পরিবারের ছোট্ট ছোট্ট ন্যাংটো, আধান্যাংটো ছেলেমেয়ের দল মাথায় ভাঙা কুলা নিয়ে বাড়ি বাড়ি মেঘরাজার গান করে বেড়ায় আর বৃষ্টি-প্রার্থনায় গান ধরে। কুলার ওপর থাকে বরইয়ের শুকনো ডাল, বেতকাঁটা, মরিচসহ আরো কয়েকটি জিনিস। মাঝেমধ্যে দু-একটি কুনো ব্যাঙও বেঁধে রাখে। কারোর বাড়িতে এসব জিনিস নিয়ে গান শুরু করলে গৃহবধূরা এসে কুলার ওপর বদনা বা কলসিভর্তি পানি ঢেলে দেন। এতে নাচানাচির জায়গাটি কর্দমাক্ত হয়ে ওঠে। আর কর্দমাক্ত জায়গাতেই ছেলেমেয়েরা নেচে নেচে গড়াগড়ি খায়। জায়গাটি একটু শুকিয়ে উঠলেই উৎসাহী রসিক গৃহবধূ আবারো সেখানে পানি ঢেলে দেন এবং নাচানাচি, গড়াগড়ির সঙ্গে চলতে থাকে সমস্বরে গান—
মেগ-রাজারে তুই আমার সহোদর ভাই
এক গুঁড়ি মেগের লাইগ্যা দুয়ার ভিজ্যা যায়।
দুয়ার ভিজ্যা যাইতে যাইতে দিনে (মেঘে) দিল ডাক
এক্ক টানে ফালাই দিল কচুক্ষেতের পাইল।
কচুক্ষেতের পানি পুডি (পানিটুকু) টলমল করে
মার চক্ষের পানি পুডি বুক ভাইস্যা পড়ে।
আবের কুলা বেতের বান
ঝুম্মুর কইরা মেঘ আন।
হওরা (সরিষা) খাইল ঘুণে
ধান খাইল রইদে
মেঘামেঘি বইয়া রইচে গাঙের কূলে
অ-ব্যাঙি মেঘ দিয়া যা।
বৈশাখের তাপদাহের এ সময়কালে রংপুরের রাজবংশী সম্প্রদায়ের কৃষক মেয়েরা খেতে নগ্ন হয়ে বৃষ্টিকে আবাহন করার জন্য নাচ-গান করে। এ আচারটিকে বলে ‘হুদুম দেয়া’। কুমিল্লা জেলার নবীনগর এলাকায় সন্ধ্যার পর যুবকরা উলঙ্গ হয়ে মাছ ধরার যন্ত্র ‘পল’ বা পলা দিয়ে নদী-পুকুর-খালে মাছ ধরে বৃষ্টিকে আহ্বান করত। দেশের কোনো কোনো এলাকায় শিরনি করারও রেওয়াজ রয়েছে। এই শিরনিকে বলা হয় ‘ঘোড়াপাইরা শিরনি’। খটমটে শুষ্ক দিনে সন্ধ্যার পর কিছু রাখাল ছেলে গ্রামের বাড়ি বাড়ি চাল মাংতে বা জোগাড় করতে যায় আর একযোগে গান ধরে—নবী সত্য, আল্লাহ কেন মেঘ দিল না...। জোগাড়ের পর সে চাল দিয়ে শিরনি করে তারা ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে খাইয়ে দেয়। কিছু চাল কাক-চিলকেও খেতে দেওয়া হয়। এ প্রক্রিয়াতে বৃষ্টি নেমে আসবে বলে লোকবিশ্বাস রয়েছে।
আমাদের দেশের কোনো কোনো এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের কুমারী মেয়েরা বৈশাখ মাসের প্রতি ভোরে ‘পুণ্য পুকুর ব্রত’ বলে এক ধরনের ব্রত পালন করে থাকে। বাংলার সুপ্রাচীনকালের মেয়েলি লোকাচারের একটি এটি। মেয়েদের বিশ্বাস, এতে বর জোটে। উঠানের এক কোনায় ছোট্ট একটি গর্তকে পুকুরের মতো বানিয়ে এতে ফুল ভাসিয়ে বরলাভের প্রার্থনা করা হয়। আর কাটা হয় ছড়া—
পুণ্য পুকুর পুষ্পমালা
কে পুজে রে দুপুর বেলা?
আমি সতী লীলাবতী
সাত ভাইয়ের বোন ভাগ্যবতী।
‘হলপ্রবাহ’ নামের একটি অনুষ্ঠান এই বৈশাখেই অনুষ্ঠিত হয়। এটি মূলত বছরের প্রথম চাষ দেওয়ার সময়কার অনুষ্ঠান। লোকগবেষক ওয়াকিল আহমদের (বাংলার লোকসংস্কৃতি) ভাষ্যমতে : ‘বৈশাখসংক্রান্তির দিন গ্রামের লোক মাঠে জমা হয়; তারা একজোড়া আনাড়ি ষাঁড়ের গলায় নতুন ফলাযুক্ত লাঙ্গল জুড়ে ছেড়ে দেয়। জনতার তাড়া খেয়ে ষাঁড় দুটি লেজ তুলে দৌড় দেয়। অনভ্যস্ততার কারণে এ দৌড় হয় এলোপাতাড়ি। ষাঁড়দৌড় দিয়ে যতগুলি ক্ষেত স্পর্শ করে, আসন্ন মৌসুমে সেগুলিতে ভালো ফসল হবে।’ এ রকম আরো অনেক আদিম বিশ্বাসজনিত লোকাচার আমাদের গ্রামীণ সমাজে নিকট অতীতে প্রচলিত ছিল। এখনো কোনো কোনো এলাকায় টিকে আছে সগৌরবে। হিরালির আচার নামেও একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় গ্রামবাংলায়। বৈশাখী ঝড়ের প্রবল প্রতাপের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এ আচার পালন করা হয়ে থাকে। হিরালি বা তান্ত্রিকদের ঝাড়ফুঁক-তুকতাকের মাধ্যমে কালবৈশাখী ও শিলাবৃষ্টিকে তাড়াতে সক্ষম হবে বলে গ্রামসমাজে বিশ্বাস রয়েছে। মন্ত্রের জোরে বজ্রপাতের হাত থেকে বাড়িঘর রক্ষা পাবে বলেও হিরালির মন্ত্রাচার অনুষ্ঠিত হয়। চৈত্র মাসে বৃষ্টি হলেও আমাদের দেশের অনেক চাষি বৈশাখ মাসের আগে খেতে হাল লাগান না। কেননা তাঁরা মনে করেন, বৈশাখ মাসের আগে শস্য বুনলে ভালো ফসল ঘরে তোলা যায় না।
নববর্ষের প্রথম দিন কুমিল্লা অঞ্চলের কোনো কোনো বাড়িতে বড় বড় মাছের মুদ্রার আকারের আঁশ ঘরের চালে শুকাতে দেওয়া হয়। লোকবিশ্বাস, হয়তো টাকা আসবে বছরজুড়ে। কোনো কোনো বাড়ির ছেলেমেয়েরা বাদির গোটা নামে এক ধরনের গাছের গোটা খেয়ে গোসল করত। তাদের বিশ্বাস, এতে করে শরীর সুস্থ থাকে, সারা বছর কোনো রোগে আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ থাকে না।
সচ্ছল ও মধ্যবিত্ত পরিবারেও বৈশাখী সংস্কার দেখা যায়। পয়লা বৈশাখের আগের দিন ঘরদোর, দোকানপাট, ধোয়ামোছা ও পরিষ্কার করা আর নতুন নতুন জিনিসপত্র কেনা হয়। ভালো ভালো খাবার-দাবারের আয়োজন করা হয় অনেক বাড়িতে। অনেকে নতুন পোশাক গায়ে দেয়। নববর্ষের আগের রাতে অনেকে গোসল করে। এমনকি গরু-ছাগলও গোসল করানো হয়। বিশেষ করে টাঙ্গাইল এলাকায় এর রেওয়াজ ছিল।
মাছ নিয়ে বাঙালির উৎসাহ কম থাকে না পয়লা বৈশাখের দিন। কুমিল্লায় গড়ে উঠেছে বড় বড় মাছ খাওয়ার ঐতিহ্য। ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ প্রবাদ থেকে এই অনেকটা ধারাটির প্রচলন হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। সুতরাং সারা বছরই যাতে মাছ খাওয়া যায়, তাই বছরের শুরুর দিনক্ষণ পয়লা বৈশাখ থেকে এ ধারা বজায় রাখা চাই। প্রায় প্রতিটি পরিবারে পয়লা বৈশাখে মাছ রান্না করা হবে, এ ঐতিহ্য কুমিল্লায় দীর্ঘদিন ধরে পালন করে আসছেন স্থানীয়রা। তাই বিশাল বিশাল মাছের সমারোহে মেলার প্রচলনও রয়েছে এ অঞ্চলে। এ মেলায় কে কার আগে বেশি দাম দিয়ে বড়সড় মাছ কিনবে, সে প্রতিযোগিতার হিড়িক পড়ে যায়। দেশের কোনো কোনো স্থানে চৈত্রের শেষের দিন পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরা হতো আর পয়লা বৈশাখে খাওয়ার জন্য সে মাছ রান্না করা হতো।
দৈনন্দিন রীতিনীতি ছাড়াও লোকসমাজে লাগে উৎসবের ছটা। বছর শুরুর এ সময়টাতে আয়োজন করা হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের। চাঁদা তুলে জারি ও যাত্রাগানের আসর জমায় লোকজন। একসময় বাংলার অনেক গ্রামে আয়োজন করা হতো ষাঁড়ের লড়াই ও ঘোড়দৌড়। এখনো বাংলাদেশের কয়েকটি এলাকায় এর প্রচলন রয়েছে। মুন্সীগঞ্জে নববর্ষের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ গরুদৌড়। রাজশাহী এলাকায় অনেককাল আগে থেকে আয়োজন করা হয় বিখ্যাত গম্ভীরা গানের আসর। এখন অবশ্য অল্পবিস্তর পরিসরে আয়োজিত হয়। ব্রিটিশ কুশাসনের জবাবে প্রচলিত জব্বরের বলীখেলা আয়োজন করা হয় চট্টগ্রামে। বৈশাখের অন্যতম প্রধান আকর্ষণের একটি এটি।
হালখাতার কথা বলতেই হয়। লালসালু মোড়া লম্বা টালি বা হিসাবের খাতা এদিন নতুন করে খোলা হয়। এটি ব্যবসায়ীদের বকেয়া আদায়ের পক্ষে ‘পুণ্যের দিন’। পয়লা বৈশাখের শুভলগ্নে যার যার বকেয়া আদায়ে ব্যবসায়ীরা তাঁদের নিয়মিত গ্রাহক, পৃষ্ঠপোষক ও শুভার্থী, তাঁদের পত্রযোগে অথবা লোক-মারফত দাওয়াত দিয়ে দোকানে এনে সাধ্যমতো মিষ্টি ও নানা রকম নাশতা পরিবেশন করে। এখনো ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন নগরীর পুরোনো দোকানে হালখাতা ও এ সংশ্লিষ্ট রীতি পালনের প্রচলন রয়েছে।
নববর্ষ কিংবা বৈশাখের সময়টাকে কেন্দ্র করেই হোক, এ সম্পর্কিত বেশ কিছু লোকাচার আজ আর পালন করা হয় না। যেমন—পয়লা বৈশাখের পুণ্যাহ অনুষ্ঠান। এটি সামন্ত সমাজের অনুষ্ঠান। প্রজারা এ ক্ষণটিতে খাজনা বা পাওনা দানের জন্য মিলিত হতো জমিদারের কাছারিতে। এ উপলক্ষে খোলা হতো নতুন খাতা বা রোকড়। উল্লেখ্য, এই নতুন খাতা খোলার সঙ্গে নববর্ষের দিন খোলা ‘হালখাতা’র যোগ রয়েছে। খাজনা কিংবা বকেয়া প্রদানের জন্য জমিদারের পক্ষ থেকে সমবেত প্রজাদের উদ্দেশে পরিবেশন করা হতো মিষ্টি পানসুপারি। এক পক্ষের অর্থপ্রাপ্তির আনন্দ আর আরেক পক্ষের অর্থদানের বিনিময়ে মিষ্টিমুখ করার আনন্দে বছরের শুরুর দিনটা বেশ ভালোই জমত অনেকের। এ তো গেল জমিদারি আমলের কথা। এই কয়েক দিন আগেও উত্তরবঙ্গে গাজনের গান পরিবেশিত হতো বৈশাখের কয়েক রাতজুড়ে। পয়লা বৈশাখের আগের রাতে অনুষ্ঠিত ভাড়াভুঁড়া নামের একটি খেলা এখন আর খেলতে দেখা যায় না। টাঙ্গাইলের ছেলেরা দলবেঁধে কিছু পাটখড়ি গোল করে ‘বুন্দা’ বেঁধে আগুন লাগিয়ে পুরো গ্রাম প্রদক্ষিণ করে। তাদের বিশ্বাস, এতে করে ভূত-প্রেত, রোগ-বালাই গ্রাম থেকে দূর হয়ে যাবে। একসময় ঢাকার ঐতিহ্যবাহী নবাববাড়িতে নববর্ষের দিন ওড়ানো হতো বিভিন্ন রকমের ঘুড়ি।
মেলার কথা না বললেই নয়। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই নববর্ষ কিংবা বৈশাখকে উপলক্ষ করে আয়োজন করা হয় মেলার। গরুদৌড়, ষাঁড়ের লড়াই, ঘোড়দৌড়, মোরগ লড়াই, সাপের খেলা, বানরনাচ, সার্কাস, জাদু, বায়োস্কোপ, গাজির গান, গম্ভীরা নাট্যপালা, যাত্রা, পুতুলনাচ, চড়কি—এগুলোর প্রসঙ্গ এলেই মেলার কথাটি অবধারিতভাবে এসে যায়। বাঙালির বৈশাখী আয়োজনের আনন্দঘন ও চিরায়ত উৎসবের বহিঃপ্রকাশ এই মেলা। মেলা শুধু ছোট ছোট ছেলেমেয়ের আগ্রহের জায়গা তা-ই নয়, সংসারের অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসেরও ক্রয়স্থল এটি।
আমাদের আদি জনগোষ্ঠীও পয়লা বৈশাখ ঘটা করে উদযাপন করে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। বৈসুক, সাংগ্রাই আর বিঝু বা বিষু—এই তিন উৎসবের প্রথম অক্ষর নিয়ে হয় বৈসাবি। বৈসুক উৎসব পালন করে ত্রিপুরা সম্প্রদায়, সাংগ্রাই মারমারা, আর চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায় পালন করে বিঝু বা বিষু উৎসব। বছরের শেষের দুদিন আর নববর্ষের প্রথম দিন বৈসুক উৎসব পালন করে ত্রিপুরা সম্প্রদায়। এ দিনগুলোতে তাদের বাড়িতে বাড়িতে তৈরি হয় পাঁচান পিঠা, মিষ্টান্নসহ নানা রকম মুখরোচক খাবার। বছরের শেষের দিন ‘বিসুমা’-তে সম্প্রদায়ের লোকজনের মদ্যপান করাতে কোনোরকম নিষেধ থাকে না। চাকমাদের বিঝু উৎসবও তিনদিনের। ৩০ চৈত্র ফুল-বিঝু, ৩১ চৈত্রে পালিত হয় মূল বিঝু। বছরের শেষের দিনটিতে কমপক্ষে পাঁচ রকমের তরকারি ছাড়াও নাড়ু, বিনি ভাত, সেমাই, শরবত, মিষ্টান্ন ও পাঁচ রকম সবজি দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনের খাবার। সকাল থেকেই এই খাবার খাওয়ার ধুম লেগে যায়। কেউ কাউকে দাওয়াত করা ছাড়াই একে অপরের বাড়িতে ভূরিভোজে অংশগ্রহণ করে তারা। আর বছরের শুরুর দিন, যাকে তারা বলে ‘গচ্ছে পচ্ছে’ বা গোর্য্যা পোর্য্যা দিন, অর্থাৎ বছর গড়িয়ে পড়ার দিন। এদিন নিকটাত্মীয়দের দাওয়াত দিয়ে ভাত-মাছ-মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের হাজং সম্প্রদায়ের লোকেরা বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের অনুষ্ঠানকে বলে ‘হঙ্গরানী’। উৎসবটি দুই-তিনদিন ধরে চলে। এ উৎসবের সময় বাড়িতে বাড়িতে পিঠা-পায়েস রান্না হয়। আর রান্না হয় ১০৭ ধরনের শাকসবজি দিয়ে এক বিশেষ ধরনের তরকারি। এ তরকারিকে মহৌষধি মনে করে হাজংরা। তারা বিশ্বাস করে, রান্না করা এ তরকারি খেলে অনাগত বছরে কোনোরকম রোগব্যাধি তাদের আক্রমণ করবে না।
বাঙালির চিরায়ত অসাম্প্রদায়িক জীবনের অন্যতম এসব বৈশাখী লোকাচার আজ বিজাতীয় ও প্রতিক্রিয়াশীল চেতনার কর্তৃত্বে কিছুটা ঝাঁকুনি খাচ্ছে সত্য; কিন্তু বাঙালির আচার অত সহজে মুছে ফেলার নয়।