দগ্ধদিনের রঙিন ফুল

প্রচণ্ড গরম। প্রখর উজ্জ্বল আলো। সময়টা গ্রীষ্মকাল। রঙের, একই সাথে রসেরও কাল এটি। রঙিন সুন্দর আলো ও তাপের মধুরস পেয়ে ফুলগুলো রঙের ফোয়ারা ছোটায়। কত যে নাম না-জানা আর নামজাদা ফুল ফোটে আমাদের আশপাশেই, তার খোঁজ কে রাখে?
এক রমণীয় দিনে রমনা এলাকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা আর তার আশপাশের বিভিন্ন জায়গায় অনুসন্ধানী দৃষ্টি ফেললে খুব সহজেই কিন্তু অপরূপ, অপূর্ব সব ফুলের সন্ধান মিলবে। এদের অনেকেই আমাদের ভূমিজ। আবার এদের অনেকগুলো এনেছেন শৌখিন বিদেশিরা। শখের বাগানী হিসেবে এনেছেন বাঙালি অভিজাত লোক। বিদেশি ফুলের মধ্যে অধিকাংশই এনেছে আজ থেকে আড়াইশো-তিনশো বছর আগে ওলন্দাজ, ফরাসি, পর্তুগিজ আর ইংরেজরা। এগুলো তারা এনেছে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বেছে বেছে। বাঙালিদের মধ্যে জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় এনেছেন সারা দুনিয়ার দুর্লভ ও অসাধারণ কিছু গাছ। তাঁর ওয়ারীর বলধা গার্ডেনের সাইকি-সিবিলি বাগানে এগুলোর খোঁজ মিলবে।
বাংলাদেশের মাটি উর্বরা। যেকোনো প্রাণকে তার গর্ভে ধারণ করতে পারে শ্যামলা মা-ধরণী। আর কোলে-পিঠেও বড় করে তুলতে পারে স্নেহ দিয়ে। এসব গাছকে বাংলার মাটি এতটাই আপন করে নিয়েছে যে ভুলেও একটিবারের জন্য মনে পড়ে না, এগুলো বিদেশ থেকে আসা- ধরণী মায়ের ঔদার্য এতটাই। আর স্বদেশি ফুলের গুণগান গেয়ে তো শেষই করা যাবে না। কত রঙের, কত ঢঙের ফুলের ভাণ্ডারই না রয়েছে এই বঙ্গরতনের। এক সোনালুর রূপের জৌলুসে যে কেউ হার মানবে। গ্রামদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকজন একে ডাকে বান্দরলাঠি বলে। কে জানে, এর লম্বা শুটি আকারের ফলগুলো নিয়ে বানরের দল বাঁদরামি করে বলেই হয়তো এর এমন নাম। সোনা-দায়ী গাছটি আজ শোভা পাচ্ছে নগরে নগরে, রাস্তার দুধারে কিংবা কোনো অভিজাত বাগানীর শখের বাগানে কিংবা সরকারি-বেসরকারি ভবন প্রাঙ্গণে। আর এখানকার উদ্যানজুড়ে তো রয়েছেই।
কোনটি যে বসন্তের, আর কোনটি গ্রীষ্মের ফুল, অনেক সময় গোল পাকিয়ে যায়। গাছপালা তো আর মানুষের বেঁধে দেওয়া সময়কাল অনুসারে ফুল ফোটায় না; আলো, তাপ, বৃষ্টি আর পর্যাপ্ত রসের আনুকূল্য মিললে সে ফুল ফোটায়। যেমন, অশোক। বসন্ত পেরিয়ে ভর গ্রীষ্মেও দেখাতে থাকবে ওর প্রস্ফুটন ঐশ্বর্য। এদিকে রয়েছে শিরিষ। চৈত্রের শেষে বৃষ্টি না হলে সে ফুল ফোটাবেই না। ফুলের গন্ধ হয় মন মাতানো।
হিজলকে কে না চেনে? গরমে গাছজুড়ে যখন এর রক্তাভ ফুল ভরে যায়, সে অপরূপ দৃশ্য কখনোই ভোলা যাবে না। ঝুলন্ত লম্বা ডাঁটায় অবিরাম ফুলের মাতম ছোটায় হিজল। গাছতলায় ঝরা ফুল পড়ে থাকার দৃশ্যটিও ভোলার মতো নয় মোটেই।
বিচিত্র রঙের রাঙা বাংলাদেশের গ্রীষ্ম। কোনে রঙে না সে সাজে। সোনা হলুদ, লাল, নীল, বেগুনি, সাদা; আবার বিভিন্ন রঙে চিত্রিত ফুলও আছে। জলার ধারেকাছে যেমন হিজল বেশি করে সুখ অনুভব করে, তেমনি সুখ পায় আমাদের জারুলও। গ্রীষ্মের একেবারে শুরু থেকে সে প্রস্তুতি নেয় ফুল ফোটানোর খেলাকে কেন্দ্র করে। পুরোনো দিনের সব রিক্ততা ঘুচে দিয়ে এক-এক করে কুঁড়িকে তৈরি করবে সে। তারপর একদিন হঠাৎই ফুলের বিস্ফোরণ ঘটাবে সে। এমনই ঐশ্বর্য, যার রূপের বর্ণনা আমাদের পক্ষে দেওয়া অসম্ভবই বলা চলে। রূপের প্রাচুর্য রয়েছে বলেই হয়তো খুব একটা বেশিদিন ধরে ফুলের বন্যা বইয়ে দেয় না জারুল। মাত্র সপ্তাহ দু-তিনেক এর ফুল ফোটানোর মহোৎসবটি চলে বেশি মাত্রায়।
জলাভূমির ধারেকাছে আরেকটি অনুপম সুন্দর ফুলের খোঁজ পাওয়া যাবে। সে বরুণ। গ্রামের লোকজন একে ডাকে আদর করে বইন্যা। সত্যিই লাখো-কোটি ফুলের বন্যায় সারা গাছ ভেসে যায়। ভর গরমে সাদা-রঙা ফুলের এমন প্রস্ফুটন সত্যিই স্বস্তিদায়ক। বাংলার ভাণ্ডারে প্রস্ফুটন-ঐতিহ্যের এমন নমুনা খুব কমই রয়েছে।
কনকচূড়ার কথা না বললেই নয়। শহরের অন্যতম শোভাবর্ধক বৃক্ষ এটি। দুপুরের খরতাপে পুড়েও এর দিকে একবার না একবার মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাতে যেকোনো নগরবাসী পাষণ্ডও বাধ্য-এমনই এর শোভা। সারা গাছের চাঁদোয়া জুড়ে সোনা ধরে যায় একেবারে। গন্ধও সুমিষ্ট।
অর্জুন আমাদের উপমহাদেশীয় গাছ। সুদর্শন সে। একই সাথে দারুণ ঔষধি গুণসম্পন্ন। এ কারণে উদ্যান কিংবা কোনো খোলা স্থানে থাকা গাছগুলো রেহাই পায় না দেশীয় কবিরাজের হাত থেকে। পুষ্পদণ্ডের চারদিকে থাকা কড়া-গন্ধি ফুলগুলো মধুপায়ী ও অন্যান্য পোকামাকড়ের সাময়িক আখড়া। সারাক্ষণ ভন ভন করতে থাকে এগুলো।
কৃষ্ণচূড়ার সাথে নতুন করে পরিচয় দেওয়ার কিছু নেই। আফ্রিকার গাছটি বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় দখল করে থাকে গ্রীষ্ম থেকে একেবারে বর্ষা পর্যন্ত। শীত-বসন্তজুড়ে নিষ্পত্র, ন্যাড়া গাছটিতে সামান্য কিছু নতুন পাতার সাথে ফোটায় অযুত-নিযুত, লাখো-কোটি ফুল। গন্ধে একধরনের মাদকতা রয়েছে, যা মোটেই ভোলার নয়।
মনোরম শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয় ক্যাসিয়া জাভানিকার লালচে গোলাপি রঙের উজ্জ্বলতা। নিজেদের ফুল হলেও নির্দিষ্ট বাংলা নাম এখনো সে পায়নি। তবে অনেকে একে লাল সোনাইল বলে ডাকে। সোনাইল বা সোনালুর একক ফুলের সাথে গড়নে মিল রয়েছে বলে এর এমন নাম। ফুলের প্রাচুর্যে এর মিহি পাতার বিরাট আকারের ছড়ানো ডালগুলো মাটি পর্যন্ত প্রায় নুয়ে পড়ে।
স্বর্ণচাঁপা, চাঁপা, চম্পক, চম্পা-কোন নামে ডাকলে এই ফুলের চরিত্রটি বোঝা যাবে? এর ফুলের মৌতাতে গাছতলায় থাকা নিসর্গী অস্থির হয়ে যায়- এমনই এর ঘ্রাণ। পরিপূর্ণ প্রস্ফুটনের সময় বেশ দূর থেকে চাঁপার গন্ধ পাওয়া যায়। গাছটি বেশি দৃষ্টিনন্দন। পাতার রং-ঢংও তাই। গাছটি অনেক সময় মন্দির-আকৃতি ধারণ করে।
বট আমাদের গ্রামবাংলার অভিজাত গাছ। বটবৃক্ষের বিশাল ছায়াতলে জমে ওঠে হাটবাজার। রাস্তার ধারে, নদীর কিনারে হাট মানেই তো বটের ছায়াতল। ফল টকটকে লাল, একই সাথে এটি ফুলও। বট ডুমুরজাতীয় গাছ। তাই এদের ফুল ও ফলের গড়ন একই।
গরমকাল জুড়ে বড় বড় গাছেই যে কেবল ফুল ফোটে তা কিন্তু নয়। লতা কিংবা লতানো গুল্মও বাদ পড়ে না ফুলের উৎসবে। প্রথমেই যার কথা বলতে হয়, তাকে বাদ দিয়ে বলতে গেলে রীতিমতো ধৃষ্টতা দেখানো হয়। সে মধুমঞ্জরী। মধুমঞ্জরীই ভালো শোনায়। লোকে মাধুরীলতা বলেও ডাকে। এ কারণে মাধবীলতার সাথে অনেকে একে গুলিয়ে ফেলে। আবার শখ করে অনেকে মধুমালতী বলেও ডাকে। সত্যিকার অর্থে তিনটি লতাই ভিন্ন। এদের প্রস্ফুটনকালও ভিন্ন। আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে এদের মধ্যে। মাধবী ফোটে ফাল্গুনে, দিন কয়েকের জন্য। আর মালতী বর্ষার ফুল, রং ধবধবে সাদা, পাঁপড়িগুলো মোচড়ানো, অসাধারণ মধুগন্ধি।
দারুণ সুগন্ধি মধুমঞ্জরী। রাতে লতার ধারেকাছে গেলে অনেকটা গন্ধরাজ ফুলের মতো গন্ধ পাওয়া যায়। রাতে ফোটা ফুল শাদা হলেও দিনের আলোর সংস্পর্শে এসে এগুলো লালচে-গোলাপি, সাদাটে রং ধারণ করে। সারা দেশজুড়ে জনপ্রিয় লতা এটি। এর একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী বাগানবিলাসী বা বোগেনভিলিয়া। মধুমঞ্জরীকে দালানের ফটকের দুদিকে বাইয়ে দিলে অসাধারণ সব ফুলের গোছার সন্ধান মিলবে গরমের সময়টাতে। গরম ছাড়াও অন্য সময়ে ফোটে।
অ্যালামেন্ডা, হলুদ ঘণ্টা, ঘণ্টালতা- কোন নামে ডাকলে এর রূপ-রসের কথা ভালোভাবে বোঝানো যায়? দারুণ বাহারি ফুল এর। চমৎকার সবুজ পাতার কোলে এর বড় বড় ভেরী আকারের ফুল সাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য। একসার করে ঘণ্টালতা বোনা হলে এ সময়ে পাওয়া যাবে আশাতীত ফুল। যেখানেই ফুটবে, চারপাশের পরিবেশ আলো করে রাখবে এটি। এর একটি লালচে রঙের জাতভাইও রয়েছে আমাদের এখানটাতে। সেটি আবার কোনো কিছুকে আঁকড়ে ধরার ক্ষেত্রে ঘণ্টালতার মতো অতটা নমনীয় নয়, একটু শক্ত ধরনের গুল্ম। সংখ্যার প্রাচুর্য না থাকলেও চমৎকার এর ফুলের ধরন-বরণ। অনেকদিন ডালে টিকে থাকে।
প্রাচুর্যের কথা যখন এলো, মর্নিংগ্লোরি বাদ যায় কেন। দু-এক জায়গায় একে ‘প্রভাত গরিমা’ বলে ডাকতে শোনা যায়। একসাথে অনেকগুলো লতাকে ফটকে বা আঙিনার বাহারি গেটে বাইয়ে দিলে দৃষ্টি সুখকর দৃশ্যের সূচনা হয় এ সময়টাতে। নীলচে বেগুনির সাথে ফানেলের ভেতরের দিককার সাদা অংশ মিলে দারুণ দৃষ্টিনন্দন হয়। সকালে সতেজ থাকে। দিনের আলোর প্রখরতার সাথে সাথে নিজেদেরকে গুটিয়ে রাখে ফুলগুলো। আর রংগুলো কিছুটা পাল্টে লালচে হয়ে যায়।
নগরের অস্থির মানুষগুলোকে একপলকে শান্ত, সুস্থির করে দিতে পারবে অনন্তলতার ফুল- এমনই এর জাদুকরি রঙের বাহার। এর রং প্রশান্ত গোলাপি। প্রস্ফুটন-ঐশ্বর্য অতুলনীয়। প্রথম ফুল ফোটানোর খেলা অসাধারণ। এর লতাপাতার আশ্চর্য কোমলতার সাথে যোগ হয় অবাক-করা ফুলের ঢল। প্রথমবারের অভিজ্ঞতায় যে কেউই চমকে যেতে বাধ্য।
অদ্ভুত মায়াভরা রং আর গড়নে ঝুমকোলতার তুলনা নেই। নীলের কয়েক স্তরের কারুকাজ চোখ জুড়ানোর মতো। এর লাল রঙের একটি প্রজাতিও আমাদের এদিকটাতে দিন দিন সহজলভ্য হয়ে উঠছে। দুটিই অনিন্দ্যসুন্দর। প্রথমটির ঘ্রাণ অসাধারণ।
কত শত ফুলের কথা এক বৈঠকে শেষ করা যায়! আরো কত যে ফুল রয়েছে বঙ্গভাণ্ডারে, শুধুমাত্র রূপের বিচার করতে গেলে অবিচার হবেই হবে, তাই বেশি বাড় না বাড়াই ভালো। বাহারি ফুলকে নমি যেমন, বুনো ফুলকেও নমি।