ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলীখেলা

বাংলার লোকঐতিহ্যের বিচিত্র ভাণ্ডারের অতুলনীয় সব উপাদানের মধ্যে লোকক্রীড়া অন্যতম। খেলাগুলোতে অংশ নিয়ে ছেলেমেয়ের দল কিংবা পরিণত বয়সের লোকেরা লাভ করে নিছক বিনোদন। তবে বিনোদনের আনন্দ উপভোগ করার পরও লোকজীবনের দৈনন্দিন ও সামাজিক আচার-ব্যবহার—এককথায় লোকঐতিহ্যের বিভিন্ন স্মারক এগুলোতে সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। প্রায় সব খেলায়, বিশেষ করে ঘরের বাইরে মাঠঘাট দাপিয়ে যে খেলাগুলোতে অংশ নেয় তারা, তার অধিকাংশতেই থাকে শারীরিক কসরত বা শক্তিমত্তা প্রদর্শনের ব্যাপারটি। এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে নানা রকম ছড়া কিংবা ছড়াগান। শারীরিক কসরত আর ছড়া ছাড়াও প্রকৃতির কোল থেকে বেছে নেওয়া হয় ফুল-ফলসহ বিভিন্ন উদ্ভিজ্জ উপাদান। প্রাকৃতিক উপাদানের সাক্ষাৎ ব্যবহার ছাড়াও খেলাগুলোর নানা অংশজুড়ে থাকে বিভিন্ন পশুপাখি, নদ-নদী আর লোক দেবদেবীর নাম। বলা বাহুল্য, এসব উপাদানের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ উপস্থিতি খেলোয়াড়দের চিত্তবিনোদনকে আরো বেশি বাড়িয়ে তোলে।
উপরে বর্ণিত এমন অনেক গ্রামীণ খেলাধুলা বা লোকক্রীড়া সুদীর্ঘকাল ধরে আমাদের দেশে লোকজীবনের অচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এদের কোনোটি একেবারে গৃহকোণে লোকচক্ষুর আড়ালে অতি নিভৃতে মেয়েরা পরিচালনা করে আসছে, কোনো কোনোটি ঘরের উঠানে কিংবা বাড়ির আশপাশের ফসলি মাঠ বা অন্য কোথাও দিনভর ছেলেমেয়ের দল খেলে থাকে। কোনোটি গ্রামের হাটবাজারে অলস সময় কাটানোর জন্য বয়স্করা খেলে থাকেন, আবার কোনো কোনোটি একেবারে পেশাদার মনোভাব নিয়ে খেলে থাকেন অংশগ্রহণকারীরা। এই পেশাদার খেলোয়াড়রা যে খেলাগুলোতে অংশ নেন, তার অধিকাংশই আনুষ্ঠানিকভাবে, অতি ঘটা করে গ্রামগঞ্জ, হাটবাজার ও শহরের বিভিন্ন স্থানে, অনেক সময় নির্দিষ্ট কোনো ঐতিহাসিক স্থানে অনুষ্ঠিত হয়। এমনই এক খেলার নাম জব্বারের বলীখেলা। আমরা সবাই জানি, বলী আসলে এক ধরনের মল্লযুদ্ধ, ভালোভাবে বলা যায় কুস্তি খেলা। কুস্তি খেলাটি চাটগাঁর লোকজনের ভাষায় পরিচিত হয়ে আছে বলীখেলা হিসেবে। উল্লেখ্য, ‘বলী’ কথাটির অর্থ ‘বলবান’।
বলীখেলা আমাদের লোকক্রীড়াগুলোর মধ্যে ঐতিহ্যমণ্ডিত একটি খেলা। প্রাচীন এই খেলা কবে কোথায় শুরু হয়েছিল, তা জানা না গেলেও অনেকে ধারণা করে থাকেন, এর ব্যাপক প্রচলন হয় মোগল আমলে। খেলাটি দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল সেকালে। এখনো এমন অনেক হিন্দু-মুসলমান পরিবার রয়েছে, যাদের নামের শেষে পদবি হিসেবে জুড়ে দেওয়া থাকে মল্ল বা বলী। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদের মধ্যবর্তী স্থানে ২২টি মল্ল পরিবার ইতিহাস-বিখ্যাত।
মোগল ও ইংরেজ আমলে নামীদামি জমিদাররা তাঁদের শৌর্যবীর্য প্রদর্শন ও নিরাপত্তার খাতিরে বলীদের নিজেদের কাছে রেখে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। বেতনভোগী এই মল্লযোদ্ধা বা বলীরা মাঝেমধ্যে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতেন। শ্রেষ্ঠ কুস্তিগীরকে উপাধি দেওয়া হতো ‘বলী’ হিসেবে।
প্রতিবছর বৈশাখ মাস এলেই গণমাধ্যমগুলোতে বেশ ঘটা করে প্রচার করা হয় জব্বারের বলীখেলার কথা। ইতিহাসের কোলজুড়ে থাকা বলীখেলার আধুনিক রূপ জব্বারের এই বলীখেলা। কে এই জব্বার? আগে জেনে নেওয়া যাক তাঁর কথা। আবদুল জব্বার সওদাগর নামের এক বণিক ১৯০৯ সালে চট্টগ্রামে এ খেলার প্রবর্তন করেন। সময়টা তখন ইংরেজদের শোষণের হাত থেকে নিজেদের স্বাধিকার আদায় করার উত্তাল সময়। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে দেশের যুবসমাজকে একাট্টা করার জন্য বলীখেলাকে বেছে নেন আবদুল জব্বার সওদাগর। তাঁর আয়োজন এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, ব্রিটিশদের হৃদকম্পন বেড়ে গিয়েছিল আন্দোলনকে দমন না করতে পেরে। ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে তাঁকে প্রস্তাব দেওয়া হয় ‘রায়বাহাদুর’ খেতাবে ভূষিত করার জন্য। কিন্তু তিনি আদর্শ বীরের মতো তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং তাঁর আন্দোলনকে বেগবান করার কাজটি চালিয়ে যান। তাঁর পুণ্যস্মৃতি রক্ষার্থে তাঁরই উত্তরপুরুষদের প্রচেষ্টায় সর্বজনীনভাবে খেলাটি শতবর্ষের বেশি সময় ধরে এখনো দারুণ প্রতাপের সঙ্গে পুরো দেশ কাঁপিয়ে চট্টগ্রাম শহরের লালদীঘির মাঠে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। খেলাটি তখন থেকেই ছড়িয়ে পড়েছিল চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়কালে বলীখেলা দারুণ জনপ্রিয় ছিল পূর্ববঙ্গে, বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে। সেকালে চৈত্র থেকে বৈশাখের শুষ্ক সময়টাতে বলীখেলা দারুণ ধুমধামের সঙ্গে হর্ষমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হতো। তখন বলীখেলার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন ইয়াঙ্গুন বা মিয়ানমারপ্রবাসী ধনী ‘রেঙ্গুইন্যারা’। তাঁদের পাশাপাশি দেশের প্রথিতযশা বিভিন্ন ব্যক্তিও এর সমঝদার হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তাঁদের মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবুল ফজল বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে খেলাটি আয়োজন করতেন। পাকিস্তান আমলের জনৈক মন্ত্রী এ কে খান যৌবনে বলীখেলায় অংশ নিয়েছিলেন বলে জানা যায়। ঢাকার একসময়কার নবাব আবদুল গনিও সমঝদার ছিলেন বলীখেলার। ঢাকার শাহবাগে একাধিকবার বলীখেলার আয়োজন করেছিলেন তিনি।
সাধারণত বৈশাখ মাসের ১২ তারিখে (২৫ এপ্রিল) এটি অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামের স্মৃতিবাহী লালদীঘির ময়দানে। পুরো চট্টগ্রাম শহর যেন ভেঙে পড়ে খেলাটি একনজর দেখার জন্য। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বলীরা জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রতিযোগিতাভিত্তিক খেলাটিতে তাঁদের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করেন।
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে কুস্তি খেলার বেশ কয়েকটি ঘরানা রয়েছে। তার মধ্যে গ্রেকোরোমান পদ্ধতি, ফ্রি-স্টাইল পদ্ধতি, পেশাদারি ফ্রি-স্টাইল পদ্ধতি কিংবা জাপানের সুমো কুস্তি খেলা সারা পৃথিবীতে সুবিখ্যাত। আবার এদের একেকটির রয়েছে বিভিন্ন উপায় ও বিবিধ নিয়মকানুন। আমাদের দেশে অনুষ্ঠিত জব্বারের বলীখেলায়ও রয়েছে এ রকম কিছু নিয়ম। নিয়মের চেয়েও বড় হয়ে ওঠে খেলাটি শুরুর বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা। খেলাটি সাধারণত শুরু হয় দুপুরের দিকে। তখন একেকজন বলী একশ-দেড়শজনের বিরাট দলবলসহ তাঁদের ৮/১০ জন জুনিয়র বলীকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে প্রবেশ করেন। প্রত্যেক বলীর সঙ্গে থাকে ঢোলবাদ্যের মজাদার আয়োজন। প্রথমে চলে জুনিয়র বলীদের খেলা। এর পর পেশাদার বলীদের খেলা।
খেলাটিতে বাজনার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ঢুলির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় বাদ্যের তালে তালে খেলোয়াড়রা প্রথমে পাঁয়তারা করে। অর্ধচন্দ্রাকার বলয়ে থেকে পরস্পরের মুখোমুখি বিপরীত গতিতে এই পাঁয়তারা চলে। আসল লড়াই হয় প্যাঁচে। খেলাটির নিয়ন্ত্রণে থাকেন একজন রেফারি। বীরত্বসূচক এই খেলায় বিজয়ীকে দেওয়া হয় মেডেল ও অর্থ পুরস্কার। খাগড়াছড়ির মারমা সিংহ ত্রিপুরা ও কক্সবাজারের দিদারুল আলম দিদার বলীখেলার দুজন উল্লেখযোগ্য তারকা।
একসময় সিলেটেও শরৎ-হেমন্তকালে বলীখেলার বেশ প্রচলন ছিল। সেখানে এটি পরিচিত ‘মাল খেলা’ নামে। ইদানীং উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে দেশ থেকে প্রায় পাঁচশ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী বলীখেলার আয়োজন ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসছে। তার পরও খেলাটি অল্প পরিসরে হলেও চট্টগ্রামের কিছু অঞ্চলে—কক্সবাজারের ডিসি সাহেবের বলীখেলা, সাতকানিয়ায় মক্কার বলীখেলা, আনোয়ারায় সরকারের বলীখেলা, রাউজানে দোস্ত মোহাম্মদের বলীখেলা, হাটহাজারীতে চুর খাঁর বলীখেলা, চান্দগাঁওতে মৌলভীর বলীখেলা আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হচ্ছে।