ছেলেকে লেখা স্টেইনবেকের চিঠি

নোবেলজয়ী মার্কিন সাহিত্যিক জন স্টেইনবেককে (১৯০২-১৯৬৮) বিখ্যাত তাঁর ‘ইস্ট অব ইডেন’, ‘দ্য গ্রেপস অব র্যাথ’, ‘অব মাইস অ্যান্ড মেন’-এর মতো উপন্যাসগুলোর জন্য। তবে তাঁর লেখনী সত্তার আরেক অসামান্য পরিচায়ক তাঁর লেখা চিঠিগুলো। দারুণ চিঠি লিখতেন স্টেইনবেক। ‘স্টেইনবেক : এ লাইফ ইন লেটারস’ নামে একটি বইয়ে তাঁর লেখা প্রায় ৮৫০টি চিঠি ঠাঁই পেয়েছে। চিন্তাশীল, সরস, বুদ্ধিদীপ্ত, সৎ, প্রভাবক এবং চোখ খুলে দেওয়া তাঁর এই চিঠিগুলো পরিবার, বন্ধুবান্ধব, সম্পাদক এবং তাঁর পরিচিত বিখ্যাত মানুষদের বিভিন্ন সময়ে লেখা।
এই চিঠি তিনি লিখেছিলেন তাঁর বড় ছেলে থমকে, ১৯৫৮ সালে। বোর্ডিং স্কুলে পড়ুয়া থম তখন টিনএজার, সদ্য প্রেমে পড়েছে সুসান নামের এক কিশোরীর। বন্ধুসম বাবার কাছে সেই ভালোবাসার কথা অকপটে স্বীকার করেই চিঠি লিখেছিল থম। তার প্রত্যুত্তরে স্টেইনবেক সময়-ছাড়ানো জ্ঞানে ভরা এক চিঠি লিখেছিলেন ছেলেকে। এই চিঠির ভাষা এবং প্রজ্ঞা প্রত্যেক মানুষের জন্য সব সময়ে এক পথচলার পাথেয় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। চিঠিটির সন্ধান মিলেছে ব্রেইনপিকিংস নামের একটি ওয়েবসাইট থেকে।
নিউইয়র্ক
নভেম্বর ১০, ১৯৫৮
প্রিয় থম :
আজ সকালেই তোমার চিঠি পেয়েছি আমরা। আমার দৃষ্টিকোণ থেকেই এর জবাব দেব আমি। আর হ্যাঁ, ইলেনও দেবে নিশ্চয়ই, তার যাচাই বুঝে।
প্রথম কথা, তুমি প্রেমে পড়ে থাকলে—এটা ভালো বিষয়—যেকোনো মানুষের জন্য এটা সবচেয়ে সেরা ঘটনা। অন্য কাউকে এ বিষয়টাকে তুচ্ছ বা হালকা করার সুযোগ দিয়ো না কখনো।
দ্বিতীয়ত, ভালোবাসার অনেক রকমফের আছে। একটা হলো আত্মকেন্দ্রিক, নিচু, লোভী, ইগোকেন্দ্রিক—এটা কেবলই নিজেকে গুরুত্ব দেওয়ার একটা তাড়না মাত্র। এটা কুৎসিত আর বিচ্ছিরি একটা ব্যাপার। আরেকটা হলো সবকিছু তোমার কাছে প্রকাশ করার মতো—শ্রদ্ধা, বিবেচনাবোধ এবং সহৃদয়তার পরিচায়ক—কেবলই সামাজিক শ্রদ্ধাবোধ নয়, বরং আরো বড় কিছু, যা আরেকজন মানুষকে মর্যাদাসম্পন্ন, একক এবং মূল্যবান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। প্রথমটা তোমায় অসুস্থ, ক্ষুদ্র আর দুর্বল করে তুলতে পারে; কিন্তু দ্বিতীয়টা বাড়িয়ে তুলতে পারে তোমার শক্তি, সাহস এবং মাহাত্ম্য। এমনকি কখন যে তোমার মাঝে জ্ঞান এসে ভর করবে, তার টেরটিও তুমি পাবে না!
তুমি বলেছ যে এটি কোনো ছেলেমানুষি প্রেম নয়। বেশ, তুমি যদি আসলেই গভীরভাবে অনুভব করে থাকো, তাহলে এটি মোটেও ছেলেমানুষি প্রেম নয়।
তবে তোমার অনুভূতি নিয়ে তুমি আমায় প্রশ্ন করেছ বলে মনে হয় না আমার। এ তো যে কারও চেয়ে সবচেয়ে ভালো তুমিই বলতে পারবে। কী করতে হবে বা কী করা উচিত, তা নিয়েই আমার কাছে জানতে চেয়েছ তুমি—আর আমি তোমায় সেটাই বলতে পারব।
তুমি খুশি থাকো, নিজেকে সৌভাগ্যবান আর বিজয়ী মনে করো।
ভালোবাসার সবকিছুই সেরা আর সবচেয়ে সুন্দর। একে সঙ্গে নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করো।
তুমি কাউকে ভালোবাসলে সেটা বলতে তো কোনো ক্ষতি নেই, শুধু মনে রাখবে যে কিছু মানুষ খুবই লাজুক; অনেক সময় এই জড়তাকে সম্মতি হিসেবে ধরে নেওয়া যায়।
তোমার অনুভূতি অবলীলায় পড়তে পারার একটা ক্ষমতা মেয়েদের সব সময়েই আছে, কিন্তু তারা সাধারণত এ বিষয় নিজ কানেই শুনতে পছন্দ করে।
মাঝেমধ্যে এমনটা হয় যে তোমার মনে যে অনুভূতি কাজ করে তা অন্য বা অন্য কোনো কারণে ফেরত আসে না, তবে তাতে কিন্তু তোমার অনুভূতিটা সস্তা বা মন্দ হয়ে যায় না।
সবশেষে, আমি জানি তোমার অনুভূতিটা কেমন। আমি নিজেও পেয়েছি এ অনুভূতি, আর আমি খুশি যে তুমিও এ অনুভূতির স্বাদ পেলে।
সুসানের সঙ্গে দেখা হলে আমরা খুবই খুশি হব। তার জন্য আমাদের সাদর আমন্ত্রণ রইল। তবে হ্যাঁ, সব আয়োজন আর বন্দোবস্ত ইলেন করবে, কারণ এ মুলুকটা পুরোই তার; আর সেও ভারি খুশি। ভালোবাসা কী জিনিস তা সেও বোঝে, আর খুব সম্ভব তোমাকে সে আমার চেয়েও বেশি সাহায্য করতে পারবে।
আর হারানোর ভয়ে ভীত হয়ো না। যা ভালো হওয়ার, তা হবেই—আসল ব্যাপার হলো তাড়াহুড়ো না করা। যা কিছু ভালো, তা কখনোই হারিয়ে যায় না।
ভালোবাসা,
বাবা