Skip to main content
NTV Online

শিল্প ও সাহিত্য

শিল্প ও সাহিত্য
  • অ ফ A
  • গদ্য
  • কবিতা
  • সাক্ষাৎকার
  • গ্রন্থ আলোচনা
  • বইমেলা
  • চিত্রকলা
  • শিল্পসাহিত্যের খবর
  • পুরস্কার ও অনুষ্ঠান
  • চলচ্চিত্র
  • আলোকচিত্র
  • বাংলাদেশ
  • বিশ্ব
  • খেলাধুলা
  • বিনোদন
  • অর্থনীতি
  • শিক্ষা
  • মত-দ্বিমত
  • শিল্প ও সাহিত্য
  • জীবনধারা
  • স্বাস্থ্য
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ভ্রমণ
  • ধর্ম ও জীবন
  • নির্বাচন
  • সহজ ইংরেজি
  • প্রিয় প্রবাসী
  • আইন-কানুন
  • চাকরি চাই
  • অটোমোবাইল
  • হাস্যরস
  • শিশু-কিশোর
  • এনটিভি ইউরোপ
  • এনটিভি মালয়েশিয়া
  • এনটিভি ইউএই
  • English Version
  • এনটিভি বাজার
  • এনটিভি কানেক্ট
  • যোগাযোগ
  • English Version
  • এনটিভি ইউরোপ
  • এনটিভি অস্ট্রেলিয়া
  • এনটিভি ইউএই
  • এনটিভি মালয়েশিয়া
  • এনটিভি কানেক্ট
  • ভিডিও
  • ছবি
  • এনটিভির অনুষ্ঠান
  • বিজ্ঞাপন
  • আর্কাইভ
  • কুইজ
  • বাংলাদেশ
  • বিশ্ব
  • খেলাধুলা
  • বিনোদন
  • অর্থনীতি
  • শিক্ষা
  • মত-দ্বিমত
  • শিল্প ও সাহিত্য
  • জীবনধারা
  • স্বাস্থ্য
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ভ্রমণ
  • ধর্ম ও জীবন
  • নির্বাচন
  • সহজ ইংরেজি
  • প্রিয় প্রবাসী
  • আইন-কানুন
  • চাকরি চাই
  • অটোমোবাইল
  • হাস্যরস
  • শিশু-কিশোর
  • এনটিভি ইউরোপ
  • এনটিভি মালয়েশিয়া
  • এনটিভি ইউএই
  • English Version
  • এনটিভি বাজার
  • এনটিভি কানেক্ট
  • যোগাযোগ
  • English Version
  • এনটিভি ইউরোপ
  • এনটিভি অস্ট্রেলিয়া
  • এনটিভি ইউএই
  • এনটিভি মালয়েশিয়া
  • এনটিভি কানেক্ট
  • ভিডিও
  • ছবি
  • এনটিভির অনুষ্ঠান
  • বিজ্ঞাপন
  • আর্কাইভ
  • কুইজ
Follow
  • শিল্প ও সাহিত্য
ছবি

বর্ণিল সাজে সেমন্তী সৌমি

লাল টুকটুকে মিম

একান্তে তাহসান-রোজা

মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকর ৫ খাবার

মেট গালা ফ্যাশনে দ্যুতি ছড়ালেন কিয়ারা

গ্রীষ্মের ফুলে ভিন্নরূপে রাজধানীর প্রকৃতি

বিমান বাহিনীর অনুশীলন পর্যবেক্ষণে প্রধান উপদেষ্টা

বিমান বাহিনীর অনুশীলন পর্যবেক্ষণ প্রধান উপদেষ্টার

পুলিশ সপ্তাহ শুরু

স্টাইলিশ মিম

ভিডিও
এ লগন গান শোনাবার : পর্ব ২০৫
এ লগন গান শোনাবার : পর্ব ২০৫
আপনার জিজ্ঞাসা : পর্ব ৩৩৭১
আপনার জিজ্ঞাসা : পর্ব ৩৩৭১
জোনাকির আলো : পর্ব ১২৩
ফাউল জামাই : পর্ব ৯৫
কোরআন অন্বেষা : পর্ব ১৮১
কোরআন অন্বেষা : পর্ব ১৮১
মিউজিক নাইট : পর্ব ১৯৫
মিউজিক নাইট : পর্ব ১৯৫
সংলাপ প্রতিদিন : পর্ব ২৩৯
গানের বাজার, পর্ব ২৩৩
এই সময় : পর্ব ৩৮২০
এই সময় : পর্ব ৩৮২০
মহিলাঙ্গন : পর্ব ৩৫৯
মহিলাঙ্গন : পর্ব ৩৫৯
সলিমুল্লাহ খান
১৪:০৪, ০৬ মে ২০১৫
আপডেট: ১৪:২৫, ০৬ মে ২০১৫
সলিমুল্লাহ খান
১৪:০৪, ০৬ মে ২০১৫
আপডেট: ১৪:২৫, ০৬ মে ২০১৫
আরও খবর
কাজী নজরুল ইসলাম : দ্রোহের কবি, সম্প্রীতির কবি
আন্দোলন-সংগ্রাম, রাজনীতিতে নজরুল-সাহিত্যের প্রভাব
প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এশিয়া অঞ্চলে বিজয়ী ফারিয়া বাশার
স্বাগত ১৪৩২: বাংলা নববর্ষ বাঙালির উৎসব
ঢাকার ঈদ মিছিলে মোগল ঐতিহ্য

ঠাকুরের সহিত বিচার

বাংলা বানানে হ্রস্ব ইকার (কিস্তি ১)

সলিমুল্লাহ খান
১৪:০৪, ০৬ মে ২০১৫
আপডেট: ১৪:২৫, ০৬ মে ২০১৫
সলিমুল্লাহ খান
১৪:০৪, ০৬ মে ২০১৫
আপডেট: ১৪:২৫, ০৬ মে ২০১৫

‘আজ ৮০-৯০ বছর পর্যন্ত বাংলা বানানে হ্রস্ব-ই দীর্ঘ-ঈ নিয়ে যত আলোচনা তর্ক-বিতর্ক হয়েছে, এত আর কোনো বানান নিয়ে হয়নি।’

-মণীন্দ্রকুমার ঘোষ (বাংলা বানান, দে’জ ৪র্থ সংস্করণ, পৃ. ৩৫)

আমার ‘বাংলা বানানের যম ও নিয়ম’প্রবন্ধ (নতুনধারা, জ্যৈষ্ঠ ১৪১৭) বাহির হইবার পর দাতা হিতৈষী ও পরোপকারী বন্ধুরা বলিয়াছেন, ‘তুমি উষ্ণ হইয়াছ যে? এই বয়সে মানুষের শোণিত তো শীতল হইবার কথা, কথা শীতল হইবার কথা।’ আপনারা আমার কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করিবেন। জানিবেন রক্তে বসন্তরোগের শিকার আমি একা হই নাই। এই বিষয়ে আমার উত্তমর্ণ আছেন।

“যে পণ্ডিতমূর্খেরা ‘গভর্ণমেন্ট’ বানান প্রচার করতে লজ্জা পাননি তাঁদেরই প্রেতাত্মার দল আজও বাংলা বানানকে শাসন করছেন- এই প্রেতের বিভীষিকা ঘুচবে কবে? কান হলো সজীব বানান, আর কাণ হলো প্রেতের বানান এ কথা মানবেন তো?’

-কে লিখিয়াছিলেন এই সকল কথা? আর কেহ নয়, স্বয়ং মহাত্মা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৯৮-৯৯) বাংলা বানানের রাষ্ট্রে ‘বিপ্লব’আনিয়াছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁহার তুলনা তিনি নিজেই। একান্ত কাঁহারও সহিত তাঁহার তুলনা করিতেই হয়- তো আমি শুদ্ধ ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ বিদ্যাসাগরের নাম লইব। ১৮৫৫ ইংরেজি [সংবৎ ১৯১২] সালে বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ ছাপা হয়। প্রথম ভাগের বিজ্ঞাপনে শ্রীঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা স্বাক্ষরের উপরে যাহা লেখা গিয়াছিল তাহাতে এসায়ি উনিশ শতকের বিপ্লব চরমে দেখা যায়। বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগ লিপিকালে এই বিপ্লব সম্পন্ন হয়।

‘বহুকাল অবধি, বর্ণমালা ষোল স্বর ও চৌত্রিশ ব্যঞ্জন এই পঞ্চাশ অক্ষরে পরিগণিত ছিল। কিন্তু বাঙ্গালা ভাষায় দীর্ঘ ঋকার [রিকার] ও দীর্ঘ ৯ কারের [লিকারের] প্রয়োগ নাই; এই নিমিত্ত ঐ দুই বর্ণ পরিত্যক্ত হইয়াছে। আর, সবিশেষ অনুধাবন করিয়া দেখিলে, অনুস্বর ও বিসর্গ স্বরবর্ণ মধ্যে পরিগণিত হইতে পারে না; এজন্য, ঐ দুই বর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণের মধ্যে পঠিত হইয়াছে। আর, চন্দ্রবিন্দুকে ব্যঞ্জনবর্ণস্থলে এক স্বতন্ত্র বর্ণ বলিয়া গণনা করা গিয়াছে। ড, ঢ, য এই তিন ব্যঞ্জনবর্ণ, পদের মধ্যে অথবা পদের অন্তে থাকিলে, ড়, ঢ়, য় হয়; ইহারা অভিন্ন বর্ণ বলিয়া পরিগৃহীত হইয়া থাকে। কিন্তু যখন আকার ও উচ্চারণ উভয়ের পরস্পর ভেদ আছে, তখন উহাদিগকে স্বতন্ত্র বর্ণ বলিয়া উল্লেখ করাই উচিত; এই নিমিত্ত, উহারাও স্বতন্ত্র ব্যঞ্জনবর্ণ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। ক ও ষ মিলিয়া ক্ষ হয়, সুতরাং উহা সংযুক্ত বর্ণ; এ জন্য, অসংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ গণনাস্থলে পরিত্যক্ত হইয়াছে’ (বিদ্যাসাগর রচনাবলী, খ. ২, পৃ. ১২৪৯)

অন্যূন কুড়ি বছরের ভিতর বর্ণপরিচয়ের কমসে কম ষাটটি সংস্করণ হইয়াছিল। ষাটি সংস্করণের বিজ্ঞাপনেও সেই ঘটমান বর্তমানের প্রমাণ পাওয়া যাইতেছিল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লিখিয়াছিলেন: ‘প্রায় সর্ব্বত্র দৃষ্ট হইয়া থাকে, বালকেরা অ, আ, এই দুই বর্ণস্থলে স্বরের অ, স্বরের আ, বলিয়া থাকে। যাহাতে তাহারা, সেরূপ না বলিয়া, কেবল অ, আ, এইরূপ বলে, তদ্রুপ উপদেশ দেওয়া আবশ্যক।’ (বিদ্যাসাগর রচনাবলী, খ. ২, পৃ. ১২৫০)

প্রসঙ্গ যখন উঠিলই বলা অবিধেয় হয় না, আমার- মানে এই গরিব লেখকের- জন্ম বর্ণপরিচয়ের একশত কয়েক বছর পর। কিন্তু আমাকে সেই সদুপদেশ কেহ দেন নাই। আমিও স্বরের অ, স্বরের আ-ই বলিয়া থাকিব। সন্দেহ কি? যাহা বাছুরকে দেওয়া হয় নাই তাহা ষাড়ে দিয়া কোন লাভের মুখ দেখা যায় না। তথাপি বিদ্যাসাগরের গৌরব ম্লান হইতেছে না। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হইতেছে। শ্রীঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা লিখিয়াছেন :

‘যে সকল শব্দের অন্ত্য বর্ণে আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ এই সকল স্বরবর্ণের যোগ নাই, উহাদের অধিকাংশ হলন্ত, কতকগুলি অকারান্ত, উচ্চারিত হইয়া থাকে। যথা, হলন্ত-কর, খল, ঘট, জল, পথ, রস, বন ইত্যাদি। অকারান্ত- ছোট, বড়, ভাল, ঘৃত, তৃণ, মৃগ ইত্যাদি। কিন্তু অনেক স্থানেই দেখিতে পাওয়া যায়, এই বৈলক্ষণ্যের অনুসরণ না করিয়া, তাদৃশ শব্দ মাত্রেই অকারান্ত উচ্চারিত হইয়া থাকে।’(বিদ্যাসাগর রচনাবলী, খ. ২, পৃ. ১২৫০)

মনে পড়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ১৩০৫ ও ১৩০৮ সালে রাজা রামমোহন রায়ের গৌড়ীয় ব্যাকরণ ধরিয়া তাঁহার সহিত এই হলন্ত ও অকারান্ত উচ্চারণ বিষয়ে প্রতিবাদ করিয়াছিলেন। (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ৫৫, ৯১) দশ বছর পরও তিনি রামমোহনের উল্লেখ করিয়া একই কথা সামান্য ঘুরাইয়া লিখিলেন। কিন্তু তিনি বিদ্যাসাগরের উল্লেখই করিলেন না। (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ১৩৮)

শুদ্ধ কি তাহাই? তাঁহার আয়ু যখন ৭৭ বছরে পড়িয়াছে তখনও রবীন্দ্রনাথ বিষয়টি ছাড়েন নাই। তখনও তিনি তত্ত্ব করিলেন, বাংলা ভাষায় দুই অক্ষরবিশিষ্ট বিশেষণ পদ প্রায়ই স্বরান্ত হইয়া থাকে। ঠাকুর লিখিলেন, “তার কোনো ব্যতিক্রম নেই তা নয়, কিন্তু সেগুলি সংখ্যায় অতি অল্প।”(বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৭১)

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এ সম্বন্ধে কোথাও বিদ্যাসাগরের ঋণ স্বীকার করিলেন না, যদিও একেলা ‘বাংলা শব্দতত্ত্ব’গ্রন্থেই পাঁচ জায়গায় বিদ্যাসাগরের উল্লেখ প্রসঙ্গত পাওয়া যাইবে। ভাবিতেছিলাম, শুদ্ধ স্বদেশে কেন স্বকালেও যোগী মাঝে মাঝে ভিখ্ পাইবেন না।

বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অপর সংযোজন, বাংলা তকারের ত ও ৎ এই দ্বিবিধ কলেবর। দ্বিতীয় কলেবরের নাম খণ্ড তকার। ‘ঈষৎ, জগৎ, প্রভৃতি সংস্কৃত শব্দ লিখিবার সময়, খণ্ড তকার ব্যবহৃত হইয়া থাকে। খণ্ড তকারের স্বরূপ পরিজ্ঞানের নিমিত্ত, বর্ণপরিচয়ের পরীক্ষার শেষভাগে তকারের দুই কলেবর প্রদর্শিত হইল।’ (বিদ্যাসাগর রচনাবলী, খ.২, পৃ. ১২৪৯-৫০)

বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পরোপকারবৃত্তি স্বীকার করুন আর নাই করুন রবীন্দ্রনাথের নিজের সৎকর্মের তালিকাও কিন্তু হ্রস্ব নহে। তাঁহার দেওয়া অনেক। তাঁহার বাংলা সম্পত্তির মধ্যে বানান সংস্কারও পড়িবে। ঠাকুরের খ্যাতি জগৎ জুড়িয়া। কিন্তু আমরা যাঁহারা নিতান্ত গৃহকোণজীবী তাঁহাদের কাছে তিনি আরো। বাংলা ভাষার দশ স্রষ্টার একজন। আর দশ শব্দের কথা ছাড়িয়াও যদি দিই খোদ “বাংলা”শব্দটির বানান তো আর ছাড়িতে পারি না। বানানটি ব্যবহার প্রথম করিয়াছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই। (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৫৭)

এই বিষয়ে ঠাকুরের জবাবদিহি শুনিবার মতন: ‘আমার প্রদেশের নাম আমি লিখি বাংলা। হসন্ত ঙ-র চিহ্ন ং। যেমন হসন্ত ত-য়ের চিহ্ন ৎ। “বাঙ্গলা”মুখে বলি নে লিখতেও চাই নে। যুক্তবর্ণ ঙ্গ-এ হসন্ত চিহ্ন নিরর্থক। ঙ-র সঙ্গে হসন্ত চিহ্ন দেওয়া চলে, কিন্তু দরকার কী, হসন্ত চিহ্ন যুক্ত ঙ-র স্বকীয়রূপ তো বর্ণমালায় আছে- সেই অনুস্বরকে আমি মেনে নিয়ে থাকি।’(বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৯৭)

বিদ্যাসাগরের কথা মনে পড়ে? পড়ে বটে। তিনিও তো ‘বাঙ্গালা’-ই লিখিয়াছিলেন। সত্যের অনুরোধে বিদ্যাসাগর কবিতার ব্যবসায়ী হয়েন নাই। আর রবীন্দ্রনাথ শেষ বিচারে কবিই। কিন্তু তিনি হাল ছাড়িয়া দিবার মত, কবিজনোচিত ধাতুদৌর্বল্যে ভুগিবার মত অস্থিরমতি ছিলেন না। তাই রক্ষা।

এখনও অনেকের মনে দুঃখ। রবীন্দ্রনাথের সর্বশেষ ‘বাংলা’বানান তাঁহারা এখনও গ্রহণ করেন নাই। তাঁহারা লেখেন “বাঙ্‌লা”। ঘটনা কি? মণীন্দ্রকুমার ঘোষ পূর্ব বাঙালির দুঃখ খানিক ধরিতে পারিয়াছেন বলিয়াই মনে হয়। মাত্র ১৯৭৬ সালেও তিনি লিখিয়াছেন :

‘উচ্চারণের খাতিরে রবীন্দ্রনাথ কয়েকটি মাত্র শব্দে ‘ঙ্গ’থেকে ‘গ’বিচ্ছিন্ন করে ‘ঙ’কে স্বাতন্ত্র্য দান করেছিলেন বটে কিন্তু সেসব শব্দ ছিল তদ্ভব- তৎসম শব্দে তিনি হস্তক্ষেপ করেন নি। ‘বঙ্গ’শব্দ থেকে ‘বাঙ্গালা’‘বাঙ্গলা’-আমরা দুই বানানেরই সাক্ষাৎ পাই অষ্টাদশ শতাব্দীতে। রবীন্দ্রনাথ ‘বাঙ্গলা’না লিখে প্রথমে লিখলেন ‘বাঙ্‌লা’, পরে ‘বাংলা’। ‘বাঙ্গালী, কাঙ্গালী, ভাঙ্গা, রাঙ্গা’রবীন্দ্রনাথের হাতে হল ‘বাঙালি, কাঙালি, ভাঙা, রাঙা’। পশ্চিমবঙ্গের উচ্চারণে ‘গ’লোপ পেয়েছে ঠিকই, তবে পূর্ববঙ্গের কণ্ঠ থেকে কিন্তু অদ্যাপি ‘ঙ্গ’ধ্বনির কোনো বর্ণ স্খলিত হয় নি।” (বাংলা বানান, পৃ. ৩২)

এই তো মাত্র শুরু। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোন দানকে বাংলাদেশ (ভারতের কথা বলিতে পারিব না) অস্বীকার করিবে? ১৯৩১ সনে রবীন্দ্রনাথের বয়স ৭০ বছর পূরা হইয়াছিল। তাঁহাকে বাড়াইয়া লইবার জন্য বাংলাদেশের সাধুব্যক্তিরা ৮ মে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছায়ায় জনসভা ডাকিয়াছিলেন। মূলসভা নহে, পরামর্শ সভা। সভায় সভাপতির পাট লইয়া মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলিলেন আমাদের মনের কথাটাই :

‘সাহিত্য-জগতের এমন কোন বিভাগ নাই যেখানে রবীন্দ্রনাথ প্রবেশ করেন নাই, কিন্তু গীতিকাব্য জগতে তিনি যে সাফল্য অর্জ্জন করিয়াছেন, তাহা ত অপরিমেয়। তাঁহার রচনাবলী জীবন্ত তাঁহার বিদ্রুপ তীক্ষ্ণ এবং তাঁহার ব্যঙ্গ তীব্র হইয়াছে। তিনি প্রাচীন কবিদিগকে শ্রদ্ধার চক্ষে দেখিয়াছেন, তাঁহার ব্যাকরণ জ্ঞান ও শব্দবিজ্ঞান আমাদের অধিকাংশকেই ছাড়াইয়া গিয়াছে।’(চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, রবীন্দ্র-প্রসঙ্গ, খণ্ড ১, পৃ. ২৩)

ঠাকুরের জগজ্জোড়া খ্যাতি বাংলা বানান সংস্কার আন্দোলনে তাঁহার সহায়ও হইয়াছে। শাস্ত্রী মহাশয়ের কথা হইতেও তাহার আভাস পাওয়া যাইতেছে। ‘বহু দূরের স্কান্ডিনেভিয়া তাঁহাকে পুরস্কার দিয়াছেন, কিন্তু তাঁহার দেশবাসী তাঁহার জন্য কি করিয়াছেন?’- হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর এই প্রশ্নের উত্তর তাঁহার ৮ মে তারিখের বক্তৃতাতেই আছে: ‘আমরা যদি তাঁহার প্রতিভা-প্রসূত দানসমূহকে গ্রহণ ও উপলব্ধি করি, তাহাতেই তাঁহার প্রতি সর্ব্বোৎকৃষ্ট পুরস্কার দেওয়া হইবে।’

 

ব্যাকরণিয়া রবীন্দ্রনাথ

‘প্রাকৃত বাংলায় যা শুচি, সংস্কৃত ভাষায় তাই অশুচি।’

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৮২)

বানান সংস্কার আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ যাঁহাকে ‘কর্ণধার’মনে (বৃথা যদিও) করিয়াছিলেন সেই সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ই তাঁহাকে ‘ব্যাকরণিয়া’উপাধি দিয়াছেন। চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের অনেক পুঁথির মধ্যে এক পুঁথির নাম ‘মনীষী স্মরণে’। সেখানে রামমোহন রায়ের উপাধি হইয়াছে ‘ব্যাকরণকার’আর রবীন্দ্রনাথের হইয়াছে ‘ব্যাকরণিয়া’। ‘বৈয়াকরণ’কথাটি সুনীতিকুমার কাঁহারও ভাগেই বরাদ্দ করেন নাই।

রামমোহন পুরাদস্তুর একখানা ব্যাকরণ বই লিখিয়াছিলেন, যথাক্রমে ইংরেজি ও বাংলা ভাষায়। রবীন্দ্রনাথ তাহা না করিলেও এই বিষয়ে তাঁহার মোট লেখা কম নহে। বিশেষ, শেষের দিকে লেখা ‘বাংলাভাষা-পরিচয়’প্রবন্ধের লেখককে তাঁহার ধাঁচায় ‘ব্যাকরণিয়া’বলা অবৈধ হইতেছে না। তিনি যদি কোনদিন এই কথা বলিয়া থাকেন, ‘বাংলাদেশকে বাংলা ভাষার ভিতর দিয়ে চিরজীবন আমি সেবা করে এসেছি,’ তবে তিনি অনেক কম দাবি করিয়াছেন ধরিতে হইবে।

বাংলা ব্যাকরণে বা ভাষাতত্ত্বে রবীন্দ্রনাথ যাহা দিয়াছেন তাহার সারাংশ লেখাও শক্ত। কতর্ব্যরে দোহাই দিয়া বলিব- সংস্কৃত ব্যাকরণের শাসন অর্থাৎ নিয়মের নিগড় হইতে বাংলা ব্যাকরণের মুক্তি প্রার্থনা তাঁহার চিরস্মরণীয় কীর্তি। জীবনের উপান্তে পৌঁছিয়া ঠাকুর লিখিয়াছেন, ‘এতকাল ধরে সংস্কৃত ব্যাকরণের সাহায্য না নিয়ে যে বহুকোটি বাঙালি প্রতিদিন মাতৃভাষা ব্যবহার করে এসেছে এতকাল পরে আজ তাদের সেই ভাষাই বাংলা সাহিত্যে প্রবেশের অধিকার পেয়েছে। এই জন্য তাদের সেই খাঁটি বাংলার প্রকৃত বানান নির্ণয়ের সময় উপস্থিত হয়েছে।’ (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৮১)

একই জায়গায় তিনি দাবি করিয়াছিলেন, সংস্কৃত ভাষা না জানিলে বাংলা ভাষা ব্যবহার করা যাইবে না এমত দাবি অস্বাভাবিক এবং অত্যাচারের শামিল। যত শীঘ্র পারা যায় এই কঠোর বন্ধন, ‘পাণ্ডিত্যাভিমানী বাঙালির’এই নূতন কীর্তি, শিথিল করিয়া দেওয়া উচিত। তাঁহার ভাষায়, ‘বস্তুত একেই বলে ভূতের বোঝা বওয়া।’ (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৮১)

তিনি অনেক দূর গিয়াছেন। সবটুকু যাইতে পারেন নাই বলিয়া তাহার যতটুকু কৃতিত্ব তাহা তো অস্বীকার করা যাইবে না। রাজশেখর বসুকে ১৯৩১ সাল নাগাদ তিনি লিখিয়াছিলেন,

‘ভেবে দেখলে বাংলা ভাষায় সংস্কৃত শব্দ একেবারেই নেই। যাকে তৎসম শব্দ বলি উচ্চারণের বিকারে তাও অপভ্রংশ পদবীতে পড়ে। সংস্কৃত নিয়মে লিখি সত্য কিন্তু বলি শোত্তো। মন শব্দ যে কেবল বিসর্গ বিসর্জন করেছে তা নয় তার ধ্বনিরূপ বদলে সে হয়েছে মোন্। এই যুক্তি অনুসারে বাংলা বানানকে আগাগোড়া ধ্বনি-অনুসারী করব এমন সাহস আমার নেই- যদি বাংলায় কেমাল পাশার পদ পেতুম তা হলে হয়তো এই কীর্তি করতুম- এবং সেই পুণ্যে ভাবীকালের অগণ্য শিশুদের কৃতজ্ঞতাভাজন হতুম। অন্তত তদ্ভব শব্দে যিনি সাহস দেখিয়ে ষত্বণত্ব ও দীর্ঘহ্রস্বের পণ্ডপাণ্ডিত্য ঘুচিয়ে শব্দের ধ্বনিস্বরূপকে শ্রদ্ধা করতে প্রবৃত্ত হবেন তাঁর আমি জয়জয়কার করব।’ (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৯৮)

মনে করিবার কারণ ঘটে নাই, রবীন্দ্রনাথ সংস্কৃতের মর্যাদা কমাইয়া দেখিয়াছেন। তিনি রুই মাছের অমর্যাদা করেন নাই, শুদ্ধমাত্র পুঁটি মাছের জন্য দুঃখ পাইয়াছেন। রুই মাছ অগাধ জলে বিহার করে। তাহার বিকার নাই। পুঁটি গণ্ডুষমাত্র জলে ফরফর করিয়া বেড়ায়।

বাংলার উপর সংস্কৃতের চাপ বা প্রভাব বলিয়া একটা কথা আছে। রবীন্দ্রনাথ জানিয়াছেন এই চাপ প্রাচীনকালের নয়। নিতান্ত আধুনিক যুগের ঘটনা। যে যুগে ভারতবর্ষের নানান এলেকায় নানা প্রকার প্রাকৃত অর্থাৎ মৌখিক ভাষার শ্রীবৃদ্ধি হইতেছিল তখন সেই সকল ভাষা লেখার সময় সংস্কৃত ভাষার নিয়ম অনুসরণ করা হয় নাই। মুখের ভাষাকেই লিখিত ভাষার আদর্শ ধরা হইয়াছিল। সর্বসাধারণের মধ্যে নতুন ধর্মের বাণী ছড়াইয়া দিতে হইলে তাহাই ছিল কার্যকর পন্থা। এই কার্যবুদ্ধি ও ন্যায়পরতা সমান হইয়াছিল সেই যুগে।

বর্তমান যুগের আদর্শ কেন তাহা হইবে না? প্রাচীন পণ্ডিতদের তিনি শ্রদ্ধা করিয়াছেন। ঠাকুর লিখিয়াছেন: ‘যাঁরা সমাধান করেছিলেন তাঁরা অসাধারণ পণ্ডিত ছিলেন, তাঁদের পাণ্ডিত্য তাঁরা বোঝার মতো চাপিয়ে যান নি জনসাধারণের ’পরে। যে অসংখ্য পাঠক ও লেখক পণ্ডিত নয় তাদের পথ তাঁরা অকৃত্রিম সত্যপন্থায় সরল করেই দিয়েছিলেন।’(বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৮১)

এ কালের পণ্ডিতরা, কবির নালিশ, সেই ধর্ম ভুলিয়াছেন। ‘তাঁহারা সংস্কৃত বানানকে বাংলা বানানের আদর্শ কল্পনা করিয়া যথার্থ বাংলা বানান নির্বিচারে নষ্ট করিয়াছেন।’(বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৯৩) রবীন্দ্রনাথ বাংলা বানান সংস্কারে বাদী হইয়াছিলেন এই দুঃখেই। তিনি জানিতেন, ‘বর্তমান সাহিত্যের বাংলা বহুলপরিমাণে সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদিগের উদ্ভাবিত বলিয়া বাংলা বানান, এমন-কি, বাংলা পদাবিন্যাস প্রণালী তাহার স্বাভাবিক পথভ্রষ্ট হইয়া গিয়াছে, এখন তাহাকে স্বপথে ফিরাইয়া লইয়া যাওয়া সম্ভবপর নহে।’(বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৭৬) কামনা করিয়াছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় ইহাতে হাত দিন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তিত বানান সংস্কার সমিতির বিধানকর্তা হইবার মতো জোর আছে। রবীন্দ্রনাথ শুদ্ধমাত্র যুক্তির জোরে নহে, সেই জোরের জোরেও আস্থা রাখিতেন।

সংস্কৃত ভাষায় ভারতীয় চিত্তের যে আভিজাত্য, যে তপস্যা আছে তাকে বাংলা ভাষায় পুরাপুরি গ্রহণ করিবার পক্ষে রবীন্দ্রনাথ। যদি না করি তবে আশঙ্কা, ‘আমাদের সাহিত্য ক্ষীণপ্রয়ণ ও ঐশ্বর্যভ্রষ্ট’ হইবে। শুদ্ধ ভাবের দিক হইতেই নহে, ‘শব্দের দিক’ হইতেও ‘বাংলা ভাষা সংস্কৃতের কাছে নিরন্তর আনুকূল্যের অপেক্ষা না করে’ থাকিতে পারে না। (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৪২)

রবীন্দ্রনাথ শুদ্ধমাত্র বাংলার স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠা পাইবে এই প্রার্থনা করিয়াছেন। ১৩৩৮ সালে সংস্কৃত কলেজ কবিকে ‘কবি সার্বভৌম’উপাধি দেন। সেই উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ তাঁহার ভাষাতত্ত্ব নতুন করিয়া বয়ান করিলেন। বলিলেন, ‘একদিন ছিল ভারতবর্ষে ভাষা-বোধের একটা প্রতিভা। ভারতবর্ষ পানিনির জন্মভূমি।’ তিনি আরো বলিলেন :

‘তখনকার দিনে প্রাকৃতকে যাঁরা বিধিবদ্ধ করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন পরম পণ্ডিত। অথচ প্রাকৃতের প্রতি তাঁদের অবজ্ঞা ছিল না। সংস্কৃত ব্যাকরণের চাপে তাঁরা প্রাকৃতকে লুপ্ত-প্রায় করেন নি। তার কারণ ভাষা সম্বন্ধে তাঁদের ছিল সহজ বোধশক্তি। আমরা আজকাল সংস্কৃত শিখে ভুলে যাই যে বাংলার একটি স্বকীয়তা আছে। অবশ্য সংস্কৃত থেকেই সে শব্দ-সম্পদ পাবে, কিন্তু তার নিজের দৈহিক প্রকৃতি সংস্কৃত দ্বারা আচ্ছন্ন করবার চেষ্টা অসংগত। আমাদের প্রাচীন পণ্ডিতেরা কখনো সে চেষ্টা করেন নি।’(বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৪১)

রবীন্দ্রনাথকে কেহ কেহ বসন্তরোগে পাইয়াছে কিনা সন্দেহ করিলেও করিতে পারেন। কিন্তু তিনি শীতলা মায়ের পূজা বিশেষ দিয়াছিলেন বলিয়া জানি না। তিনি কোন কোন ‘আধুনিক’পণ্ডিতকে ‘পণ্ডিতমূর্খ’কেন বলিয়াছিলেন, এখন বোঝা যাইতেছে। কারণ তাঁহারাই তো গভর্ণমেন্ট, কাণ, বানান প্রভৃতি বানান লিখিতেন। কবির উষ্মার কারণ এই সংস্কৃতের চাপে বাংলাকে লুপ্তপ্রায় করনেওয়ালারা অর্বাচীন। তাহাদের দোষ পশ্চিমের দোষ মাত্র।

‘যারা মনে করেছেন বাইরে থেকে বাংলাকে সংস্কৃতের অনুগামী করে শুদ্ধিদান করবেন, তাঁরা সেই দোষ করেছেন যা ভারতে ছিল না। এ দোষ পশ্চিমের। ইংরেজিতে শব্দ ধ্বনির অনুযায়ী নয়। ল্যাটিন ও গ্রীক থেকে উদ্ভূত শব্দে বানানের সঙ্গে ধ্বনির বিরোধ হলেও তাঁরা মূল বানান রক্ষা করেন।’ (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৪১)

কেহ কেহ বলিতে কসুর করেন নাই, রবীন্দ্রনাথের ‘অনুগত’ পণ্ডিতগণ সমভিব্যবহারে বানান সংস্কার সমিতি গঠিয়াছিলেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। সেই কমিটি বিচারের উপরে উঠে নাই-একথা সত্য। পুরাতত্ত্ববিদ রমাপ্রসাদ চন্দ কহিয়াছিলেন, ‘বাঙ্গালা ভাষা যাঁহাদের মাতৃভাষা, তাঁহাদের অধিকাংশই মুসলমান।’ (‘কর্ত্তার ইচ্ছা কর্ম্ম,’ মাসিক বসুমতী ১৩৪৪) তদুপরি, কমিটির অন্যতম সভ্য বিজনবিহারী ভট্টাচার্যের কথানুসারে, ‘সে সময়ে বাংলাদেশে হিন্দুমুসলমানের মধ্যে মন কষাকষির ভাব চলিতেছিল।’শুদ্ধ তাহাই নহে, ‘অনেক মুসলমান লেখক বাংলা ভাষায় নূতন নূতন আরবী ফারসী শব্দ এবং অপূর্ব-প্রচলিত বাগভঙ্গী আমদানী করিয়া বাংলা ভাষার ‘সংস্কার’-এ উদ্যোগী হইয়াছিলেন।’ আর রবীন্দ্রনাথ ‘ইহার তীব্র প্রতিবাদ করিয়াছিলেন’। (বঙ্গভাষা ও বঙ্গসংস্কৃতি, মুদ্রণ ২, পৃ. ৩৭-৩৮)

কি শোচনীয় এই দেশ! যে দেশের শতে পঞ্চাশের বেশি লোক সেই বঙ্কিমচন্দ্রের যুগেই মুসলমান হইয়া গিয়াছে, যে দেশের বাদবাকির শতকরা ৮০ জনই তপশিলি হিন্দু তাঁহাদের একজন প্রতিনিধিও বাংলা বানান সংস্কার কমিটিতে দেখা যায় নাই। ইহা কেমন ন্যায়বিচার? কেমন কাণ্ডজ্ঞান? কোন কোন লোকের ধারণা বানান কমিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের প্রধান এবং প্রখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহও ছিলেন। (নৃপেন্দ্রনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়, ভাষাতত্ত্বের ইতিহাস, পৃ. ৩৪)

প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁহার ধারণা মার্ক টোয়েনের মৃত্যু সংবাদের মতো সামান্য অতিরঞ্জিত হইয়াছে। এই যা। রসিকতার অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ এক স্থানে বলিয়াছিলেন, ‘নব্য বানান-বিধাতাদের মধ্যে তিন জন বড় বড় ভট্টাচার্যবংশীয় তাঁদের উপাধিকে য-ফলা বঞ্চিত করতে সম্মতি দিয়েছেন।’ (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৭৬)

সমিতির সাধারণ সম্পাদক চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যকেও যদি হিসাবে লওয়া অবৈধ না হয় তবে আমি তো ভট্টাচার্য পাইতেছি চারিজন- বাকি তিনের মধ্যে বিধুশেখর, দুর্গামোহন ও বিজনবিহারী রহিয়াছেন। (বঙ্গভাষা ও বঙ্গসংস্কৃতি, পৃ. ২১-২২)

এই বানান সমিতিও কবির কথা ষোলো আনা রাখেন নাই। কান, সোনা, কোরান, গভর্নর প্রভৃতি শব্দও যাহাতে কবির ইচ্ছানুযায়ী বামুন, গিন্নী, শোনা, করেন, করুন প্রভৃতির মতন দন্ত্য ন দিয়া লেখা হয় তাঁহার আদেশ হইল। দুঃখের মধ্যে, প্রতিবিধানও একই সঙ্গে রহিল। ‘ “রাণী”বানান অনেকেই রাখিতে চান, এ জন্য এই শব্দে বিকল্প বিহিত হইয়াছে’-সমিতি বলিলেন তাহাই সই। (নেপাল মজুমদার সম্পাদিত, বানান বিতর্ক, পৃ. ৩১৪)

বিধানকর্তারা নিতান্ত অবিবেচক নহেন। সবার উপরে রবীন্দ্রনাথও বুঝিলেন, ‘তাঁহাদের মনেও ভয় ডর আছে, প্রমাণ পাওয়া যায়।’ (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৭৫) প্রমাণ- সমিতি লিখিয়াছেন-‘বিকল্প বাঞ্ছনীয় নয়, তথাপি যেখানে দুই প্রকার বানানের পক্ষেই প্রবল অভিমত পাওয়া গিয়াছে সেখানে বিকল্পের বিধান করিতে হইয়াছে।’(বানান বিতর্ক, পৃ. ৩১৩)

একপ্রস্ত উদাহরণ দিয়া ইহা বুঝান যাইতে পারে। ‘বাংলা বানানের নিয়ম’দ্বিতীয় সংস্করণে (সেপ্টেম্বর ১৯৩৬) কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বানান সংস্কার সমিতি বিধান দিয়াছিলেন, ঢাকি, ঢুলি, বাঙ্গালি, ইংরেজি, হিন্দি, রেশমি, পশমি, মাটি, ওকালতি, একটি, দুটি প্রভৃতি তদ্ভব, স্ত্রীলিঙ্গ ও অন্য শব্দে কেবল হ্রস্ব-ই বা হ্রস্ব-উ হইবে। (বিধি ৭)

তৃতীয় সংস্করণে পুনরাদেশ হইল: ‘স্ত্রীলিঙ্গ এবং জাতি, ব্যক্তি, ভাষা ও বিশেষণ বাচক শব্দের অন্তে ঈ হইবে, যথা-“কলুনী, বাঘিনী, কাবুলী, কেরানী, ঢাকী, ফরিয়াদী, ইংরেজী, বিলাতী, দাগী, রেশমী”। কিন্তু কতকগুলি শব্দে ই হইবে, যথা: “ঝি, দিদি, বিবি, কচি, মিহি, মাঝারি, চল্তি”। “পিসী, মাসী”স্থানে বিকল্পে ‘‘পিসি, মাসি’’ লেখা চলিবে।’ (বিধি ৫)

তৃতীয় সংস্করণের পায়ে পায়ে প্রকাশিত প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আপত্তি করিলেন। তিনি বলিলেন, ‘সংস্কৃত ভাষার নিয়মে বাংলার স্ত্রীলিঙ্গ প্রত্যয়ে এবং অন্যত্র দীর্ঘ ঈকার বা ন’এ দীর্ঘ ঈকার মানবার যোগ্য নয়।’ (বাংলাভাষা-পরিচয়, পৃ. ৮৬)

‘গৃহবিচ্ছেদের আশংকা’আছে বলে রবীন্দ্রনাথও সমিতির অনেক সিদ্ধান্ত কষ্টে মানিয়া লইয়াছিলেন। ১৯৩৭ সালের ২ জুলাই আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে ‘বিশ্বভারতীয় কার্য্য নির্ব্বাহক সমিতি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় রচিত বাঙ্গালা শব্দের নূতন বর্ণবিন্যাস পদ্ধতি এবং বাঙ্গালা পরিভাষা গ্রহণ করিয়াছেন।’ (রবীন্দ্র-প্রসঙ্গ, খ. ২, পৃ. ১৫৫)

মণীন্দ্রকুমার দারুণ বলিয়াছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের ঝোঁক ছিল হ্রস্ব-ইকারের দিকে, সুনীতিকুমারের আসক্তি দীর্ঘ-ঈকারের প্রতি।’রবীন্দ্রনাথ ‘জরাজনিত মনোযোগের দুর্বলতা’ হেতু ‘দায়ী’কে ‘দায়ি’ লিখিতেন আর সুনীতিকুমার ‘খেয়াল ছিল না’ বলিয়া রিপোর্টকে ‘রীপোর্ট’লিখিতেন। মণীন্দ্রকুমার লিখিতেছেন, ‘অর্থাৎ খেয়াল না থাকলে রবীন্দ্রনাথের কলমে আসে হ্রস্ব ই-কার, সুনীতিকুমারের আসে দীর্ঘ-ঈকার।’ (বাংলা বানান, পৃ. ৩৫-৩৬) কথাপ্রসঙ্গে সুনীতিকুমার নাকি একদিন বলেওছিলেন ‘দীর্ঘ-ঈকার (ী) লেখা সোজা।’ মণীন্দ্রকুমারের মন্তব্যও তাঁহার অনুকূলই: ‘বাস্তবিকই বাংলা বর্ণবিন্যাসে স্বরচিহ্নের মধ্যে হ্রস্ব-ইকার (ি) লেখাই সর্বাধিক কষ্টদায়ক।’(বাংলা বানান, পৃ. ৩৬)

রবীন্দ্রনাথ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে ‘ভাষাচার্য’ উপাধি দান করিয়া যে পুঁথিটি তাঁহার করকমলে তুলিয়া দিলেন, তাহাতেই দেখি লেখা আছে,

‘খাঁটি বাংলাকে বাংলা বলেই স্বীকার করতে যেন লজ্জা না করি, প্রাচীন প্রাকৃত ভাষা যেমন আপন সত্য পরিচয় দিতে লজ্জা করে নি। অভ্যাসের দোষে সম্পূর্ণ পারব না, কিন্তু লিঙ্গভেদসূচক প্রত্যয়ে সংস্কৃত ব্যাকরণ কতকটা স্বীকার করার দ্বারা তার ব্যাভিচারটাকেই পদে পদে ঘোষণা করা হয়। তার চেয়ে ব্যাকরণের এই সকল স্বেচ্ছাচার বাংলা ভাষারই প্রকৃতিগত এই কথাটা স্বীকার করে নিয়ে যেখানে পারি সেখানে খাঁটি বাংলা উচ্চারণের একমাত্র হ্রস্ব ই-কারকে মানব। ‘ইংরেজি’ বা ‘মুসলমানি’ শব্দে যে ই-প্রত্যয় আছে সেটা যে সংস্কৃত নয়, তা জানাবার জন্যই- অসংকোচে হ্রস্ব ইকার ব্যবহার করা উচিত। ওটাকে ইন্-ভাগান্ত গণ্য করলে কোন্ দিন কোনো পণ্ডিতাভিমানী লেখক ‘মুসলমানিনী’কায়দা বা ‘ইংরেজিনী’রাষ্ট্রনীতি বলতে গৌরব বোধ করবেন এমন আশংকা থেকে যায়।’(বাংলাভাষা-পরিচয়, পৃ. ৮৬-৭; নিুরেখা যোগ করা হইয়াছে, বানান রবীন্দ্রনাথের)

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তো রবীন্দ্রনাথের এই বক্তব্য প্রকাশের এক যুগ আগেই তাঁহার সমর্থনসূচক কথা লিখিয়া রাখিয়াছিলেন। তাঁহার বিচারে তদ্ভব ও দেশজ বাংলা শব্দে সবখানেই হ্রস্ব ই এবং হ্রস্ব উ হওয়াই নিয়ম। দীর্ঘস্বরের জন্য বাংলা ভাষায় আলাদা হরফেরই দরকার নাই। দীর্ঘস্বর বুঝাইবার জন্য আদৌ কোন চিহ্নও দরকার হইবে কিনা এই প্রশ্নের উত্তরে শহীদুল্লাহ বাংলা ১৩৩১ সালে জানাইয়াছিলেন,

‘যেমন সংস্কৃত ইত্যাদির রোমান অক্ষরে অনুলেখনে (Transliteration) স্বরবর্ণের উপর দীর্ঘ চিহ্ন দেওয়া হইয়া থাকে আমাদের বিবেচনায় বাঙ্গালায় তাহার কোন দরকার নাই। বাঙ্গালা উচ্চারণের নিয়মেই হ্রস্ব দীর্ঘ ধরা পড়ে- যেমন হসন্ত বর্ণের আগের স্বর দীর্ঘ হয়। বাস্তবিক সেখানে আমরা সংস্কৃতের অনুকরণে হ্রস্বদীর্ঘ লিখি, বাঙ্গালা উচ্চারণ অনেক জায়গায় তাহার বিপরীত, যেমন “সীতা” এবং “মিতা”। এখানে “সী” ও “মি” উভয়েরই উচ্চারণ হ্রস্ব। “মীন” “দিন” এখানে “মী” ও “দি” উভয়েরই উচ্চারণ দীর্ঘ। কাজেই “শিতা” “মিন” লিখিলে বাঙ্গালা উচ্চারণ দস্তুরমত বুঝা যাইবে।’ (ভাষা ও সাহিত্য, পৃ. ৮৬)

মুহম্মদ আবদুল হাই তাঁহার ‘ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব’ নামক প্রসিদ্ধ পুঁথিযোগে আরো অধিক গিয়াছেন। তাঁহার মতে দেশজ, বিদেশি, সংস্কৃত ও সংস্কৃতভব সকল বাংলা শব্দেই হ্রস্ব ই আর হ্রস্ব উ ব্যবহার করাই সংগত। যথা: গাভি, বুদ্ধিজিবি, নিড়, অনুসারি, অনুরূপ, ইত্যাদি। কেবল বিদেশি শব্দ বাংলা অক্ষরে লিপিকালে ইহার অন্যথা হইতে পারে। (পৃ. ৬৪৬; পরেশচন্দ্র মজুমদার, বাঙলা বানানবিধি, পৃ. ২৮)

বাংলা শব্দের, স্ত্রীলিঙ্গ প্রত্যয় একদা “ন্” ছিল, যেমন: নাতিন, মিতিন, ঠাকুরন ইত্যাদি, পরেশচন্দ্র মজুমদার এ কথা মানেন। কিন্তু তাঁহার মতে, ‘সংস্কৃত প্রভাবেই তা ক্রমে ক্রমে –নী (অর্থাৎ ন+ঈ) প্রত্যয়ে পরিণত হয়েছে।’ (বাঙলা বানানবিধি, পৃ. ২৩) এই যুক্তিতে তিনি বাদী হইলেন, বাংলায় স্ত্রীলিঙ্গে দীর্ঘ ঈকারযুক্ত প্রত্যয় রাখিতে হইবে। তাঁহার ধারণা সংস্কৃতের চাপ এখনও আছে। যেখানে তৎসম শব্দের বেলায় যথারীতি ঈ/নী প্রত্যয় থাকিতেছে সেখানে বাংলা শব্দের বেলায় ই/নি চালু করা হইলে ‘দ্বৈধ প্রবণতার সংগ্রাম’ সূচিত হইবে।

ইহার বাহিরেও কথা আছে। ওড়িয়া, ভোজপুরি, অহমিয়া, হিন্দি প্রভৃতি ভাষায় তদ্ভব শব্দের বানানে এখনও সংস্কার করা হয় নাই। সেখানে এখনও ঈ/নী চলিতেছে। তাই বাংলায় বিচ্ছিন্ন সংস্কার করা উচিত হইবে কিনা তিনি নিশ্চিত হইতে পারিতেছেন না। (বাঙলা বানানবিধি, পৃ. ২৩)

 

দুই বানানের আবদার

‘পণ্ডিত বলেন, বাংলা স্ত্রীলিঙ্গ শব্দে তুমি ঈ ছাড়িয়া হ্রস্ব ই ধরিলে যে? আমি বলিব ছাড়িলাম আর কই। একতলাতেই যাহার বাস তাহাকে যদি জিজ্ঞাসা কর, নীচে নামিলে যে, সে বলিবে, নামিলাম আর কই- নীচেই তো আছি। ঘোটকীর দীর্ঘ-ঈতে দাবি আছে; সে ব্যাকরণের প্রাচীন সনন্দ দেখাইতে পারে- কিন্তু ঘুড়ির তাহা নাই। প্রাচীন ভাষা তাহাকে এই অধিকার দেয় নাই। কারণ, তখন তাহার জন্ম হয় নাই। তাহার পরে জন্মাবধি সে তাহার ইকারের পৈতৃক দীর্ঘতা খোয়াইয়া বসিয়াছে।

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ১১২)

পরেশচন্দ্র মজুমদার প্রভৃতি পণ্ডিতের আপত্তি যেন রবীন্দ্রনাথ আগে হইতেই আন্দাজ করিয়া থাকিবেন। তিনি লিখিয়াছিলেন, ‘একটা বিষয়ে বাংলাকে বাহাদুরি দিতে হবে। য়ুরোপীয় অনেক ভাষায়, তা ছাড়া হিন্দি হিন্দুস্থানি গুজরাটি মারাঠিতে, কাল্পনিক খেয়ালে বা স্বরবর্ণের বিশেষত্ব নিয়ে লিঙ্গভেদপ্রথা চলেছে। ভাষার এই অসংগত ব্যবহার বিদেশীদের পক্ষে বিষম সংকটের। বাংলা এ সম্বন্ধে বাস্তবকে মানে। বাংলায় কোনোদিন ঘুড়ি উড্ডীয়মানা হবে না, কিংবা বিজ্ঞাপনে নির্মলা চিনির পাকে সুমধুরা রসগোল্লার শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করবে না। কিংবা শুশ্রূষার কাজে দারুণা মাথাধরায় বরফশীতল জলপটির প্রয়োগ সম্ভাবনা নেই।’ (বাংলাভাষা-পরিচয়, পৃ. ৮৬)

তাহা ছাড়াও ‘খাপছাড়াভাবে সংস্কৃতের নী ও ঈ প্রত্যয়ের যোগে স্ত্রীলিঙ্গ বোঝাবার রীতি বাংলায় আছে, কিন্তু তাকে নিয়ম বলা চলে না। সংস্কৃত ব্যাকরণেও মেনে চলবার অভ্যেস তার নেই। সংস্কৃতে ব্যাঘ্রের স্ত্রী ‘ব্যাঘ্রী’, বাংলায় সে ‘বাঘিনী’। সংস্কৃতে ‘সিংহী’ই স্ত্রীজাতীয় সিংহ, বাংলায় সে ‘সিংহিনী’।’(বাংলাভাষা-পরিচয়, পৃ. ৮৪)

শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথেরই জয় হইল। ১৯৮০ সালের দশক হইতে বাংলাদেশে এবং ভারতে বাংলা ভাষার বানান, লিপি ও লেখনরীতির সংস্কার আন্দোলন শুরু হইবার পর ভাষায় হ্রস্ব ইকারের অধিকার বেশি করিয়া স্বীকার করা হইতেছে। বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্য পুস্তক বোর্ড এবং বাংলা একাডেমি যে সকল সংস্কার প্রস্তাব পাস করাইতে সমর্থ হইয়াছেন সেইগুলিতে হ্রস্ব ইকার প্রবণতারই জয় হইয়াছে। সাধারণভাবে এই সত্যে সন্দেহ করিবার কোন স্থান নাই। তবে ইহাও মিথ্যা নহে যে সংস্কৃতের চাপ কোথাও কোথাও এখনও রহিয়া গিয়াছে।

পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি ব্যাপক সমতার জন্য সিদ্ধান্ত লইয়াছেন স্ত্রীলিঙ্গ বোঝানোর ক্ষেত্রে হ্রস্ব ইকার/নিকারের ব্যবহার হইবে। (বানানবিধি, স. ৫, বিধি ১১.৪)

‘তাই লেখা হবে কাকি(-মা) কামারনি খান্ডারনি খুকি খুড়ি খেঁদি গয়লানি’ চাকরানি চাচি ছুঁড়ি ছুকরি জেঠি (-মা) ঝি ঠাকুরানি দিদি (-মা) নেকি পাগলি পিসি (-মা) পেঁচি বাঘিনি বামনি বেটি ভেড়ি মামি (-মা) মাসি (-মা) মুদিনি মেথরানি রানি সাপিনি সোহাগিনি স্যাঙাতনি ইত্যাদি।’

পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির তুলনায় বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি খানিক পিছনে আছেন বলিয়াই মনে হয়। তাঁহাদের ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’তৃতীয় সংস্করণ পর্যন্ত হইয়াছে। তাহাতে দেখা যায়, ‘তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্ত্রীবাচক শব্দের শেষে ঈ-কার দেওয়া যেতে পারে। যেমন : রানী, পরী, গাভী।’ (নিয়ম ২.০১) ভারতের বাংলা আকাদেমিও কম যাইবেন কেন? তাঁহারাও ব্যতিক্রম অনুমোদন করিয়াছেন। বিধান হইল :

‘সংস্কৃত-ঈয় প্রত্যয় যদি বিশেষণার্থে বিদেশি শব্দ বা অ-তৎসম শব্দ বা শব্দাংশের সঙ্গে যুক্ত হয় সে ক্ষেত্রে দীর্ঘ ঈ-কার বজায় রাখতে হবে। যেমন : অস্ট্রেলীয় আর্টেজীয় আলজেরীয় ইউরোপীয় ইতালীয় এশীয় কানাডীয় ক্যারিবীয় ক্যালাডোনীয় জর্জীয় পোলিনেশীয় লাইবিরীয় সাইবেরীয় ইত্যাদি।’ (বিধি ১১.৮)

কোন যুক্তিতে এই ব্যতিক্রম? যুক্তি আর যাহাই হোক বিশেষ্য-বিশেষণ উচ্চারণ ভেদের যুক্তি হইতে পারে না। বাংলা ও সংস্কৃতের ভেদই শুরু হইয়াছে উচ্চারণ ভেদ হইতেই। রবীন্দ্রনাথ সে সত্যে সম্পূর্ণ সজাগ : ‘বাংলা ভাষা শব্দ সংগ্রহ করে সংস্কৃত ভাণ্ডার থেকে, কিন্তু ধ্বনিটা তার স্বকীয়। ধ্বনিবিকারেই অপভ্রংশের উৎপত্তি।’

এই সত্যটাই চাপা দেওয়ার সুবিধা জোগায় বাংলা শব্দের বানান। রবীন্দ্রনাথের মতে এই বানান ব্যবসায়ের জোরেই বাংলা আপন অপভ্রংশত্ব চাপা দিতে চাহে। ‘এই কারণে বাংলা ভাষার অধিকাংশ বানানই নিজের ধ্বনিবিদ্রোহী ভুল বানান।’ (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৬৪)

একই কথাটা উল্টা দিক হইতে দেখিলে কি দাঁড়ায়? পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি ‘ধ্বনিবিদ্রোহী ভুল বানান’কেও ‘মান্যতা’ দিতে আগ্রহী। তাঁহাদের দৃষ্টিতে ‘বাংলা ব্যাকরণসম্মত প্রত্যয়-ব্যবহারে, সমাস-ব্যবহারে বা সন্ধি-সূত্রানুসারে কোনো কোনো বানান বাংলায় দীর্ঘকাল যাবৎ ঈষৎ স্বতন্ত্রতা লাভ করেছে। সেগুলিকেও তৎসম শব্দানুরূপ মান্যতা দেওয়া যেতে পারে।’(বিধি ৩.২, নিুরেখা আমরা দিয়াছি)

রবীন্দ্রনাথ আশা প্রকাশ করিয়াছিলেন, ‘যদি প্রাচীন ব্যাকরণকর্তাদের সাহস ও অধিকার আমার থাকত, এই ছদ্মবেশীদের উপাধি লোপ করে দিয়ে সত্য বানানে এদের স্বরূপ প্রকাশ করবার চেষ্টা করতে পারতুম। প্রাকৃত বাংলা ব্যাকরণের কেমাল পাশা হবার দুরাশা আমার নেই কিন্তু কালোহ্যয়ং নিরবধিঃ। উক্ত পাশা এ দেশেও দেহান্তর গ্রহণ করতে পারেন।’ (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৭৫)

বলি, ঠাকুরের আত্মা শান্তিতে থাকিবেন। আপনার পাশা এখনও এই দেশে দেহান্তর গ্রহণ করেন নাই। বোধ হয় তিনি বিশ্রামে আছেন। তবিয়তে বহাল আছেন অসত্য বানান। মান্যতা পাইয়াছেন নতুন করিয়া। কোন কোন বাংলা বানানকে তৎসম শব্দস্বরূপ মান্যতা দিবার দৃষ্টান্ত: অধিকারী অধিবাসী অভিমুখী আততায়ী একাকী কৃতী গুণী জ্ঞানী তন্ত্রী দ্বেষী ধনী পক্ষী মন্ত্রী রোগী শশী সহযোগী ইত্যাদি।

আবার এগুলি বাংলায় আসিলেও সংস্কৃতের পোঁ ছাড়ে নাই। তাই সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মেই পরিবর্তিত হইবে। যথা: গুণিজন, পক্ষিকুল মন্ত্রিসভা শশিভূষণ বা একাকিত্ব সহযোগিতা প্রভৃতি। সঙ্গে সঙ্গে আবার ব্যতিক্রমও স্বীকার করা কর্তব্য হইয়াছে। তাই পাইবেন দীর্ঘ ঈকারওয়ালা শব্দভাণ্ডার। যেমন : আগামীকাল আততায়ীদ্বয় ধনীসমাজ পরবর্তীকাল প্রাণীবিদ্যা যন্ত্রীদল হস্তীদল ইত্যাদি। (বিধি ৪.২)

এই রকম আরও চিত্তরঞ্জিনী বিধির প্রদর্শনী আছে। বাংলা বানানে আমোদ নামে নতুন প্রবন্ধ কেহ লিখিলে মন্দ হইবে না। এই প্রসঙ্গে জানাইয়া রাখি একালের সংস্কারবাদী কর্তারাও রবীন্দ্রনাথের সেই দেহান্তর লওয়া কেমাল পাশা মোটেই নহেন। তাঁহাদিগকে বড় জোর খলিফা আবদুল হামিদ উপাধি দেওয়া যাইতে পারে।

মজার কথা এই- ঢাকা ও কলিকাতার সংস্কর্তারা রবীন্দ্রনাথের নির্দেশ বা প্রেরণা অমান্য করিয়াই এখনও সংস্কৃত ব্যাকরণের দাসত্ব করিতেছেন। শুদ্ধমাত্র বাংলায় চলিত ‘সংস্কৃতসম’শব্দেই নহে, এই দাসত্বের শিকলি তাহারা ‘সংস্কৃতভব’শব্দেও ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে লাগাইয়া রাখিয়াছেন।

আবার এই সংস্কর্তারাই কারণে অকারণে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে যত্রতত্র দীর্ঘ-ঈকার বসাইয়া ‘কী’লিখিয়া উল্লাস করিবার সময় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরই নজির হাজির করিতে কুণ্ঠিত হইতেছেন না। রবীন্দ্রনাথকে সম্বোধন করিয়া দেবপ্রসাদ ঘোষ ১৯৩৭ সনে একবার বলিয়াছিলেন, ‘আপনি অদ্বিতীয় সাহিত্য-স্রষ্টা, কিয়ৎ পরিমাণে ভাষাস্রষ্টাও বটেন, কিন্তু বিশ্লেষণ বিষয়ে আপনার যেন কিঞ্চিৎ অপাটব লক্ষ্য করিতেছি। বোধ করি সৃষ্টি এবং বিশ্লেষণে বিভিন্ন প্রকার প্রতিভার আবশ্যক হয়।’ (বানান বিতর্ক, স. ৩, পৃ. ১৪৬)

আমাদের আশংকা দেবপ্রসাদের এই নির্দেশ হয়তো বা অমূলক নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁহার একাধিক পত্রিকা ব্যবহারে ও ‘বাংলাভাষা-পরিচয়’প্রবন্ধে যে যুক্তির অবতারণা করিয়া দীর্ঘ-ঈকারযোগে ‘কী’লিখিবার আবেদন জানাইয়াছিলেন তাহা তিনি নিজেই তো স্থানে স্থানে, অজ্ঞানে খণ্ডন করিয়াছেন। আমাদের তাহা খণ্ডন করিবার প্রয়োজন হইতেছে না।

রবীন্দ্রনাথ এক স্থানে বলিয়াছেন, ‘কি শব্দের সর্বনাম প্রয়োগ ও অব্যয় প্রয়োগে বানানভেদ করিলে অর্থাৎ একটাতে হ্রস্ব ই ও অন্যটাতে দীর্ঘ ঈ দিলে উভয়ের ভিন্ন জাতি এবং ভিন্ন অর্থ বোঝাবার সুবিধা হয়।’(বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৯০)

আরেক স্থানে তিনি লিখিয়াছেন, ‘তাদের ভিন্ন বানান না থাকলে অনেক স্থলেই অর্থ বুঝতে বাধা ঘটে। এমন-কি প্রসঙ্গ বিচার করেও বাধা দূর হয় না।’(বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৮৪)

ঠাকুরের এই ধারণাটাই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বানান সংস্কার সমিতি ১৯৩৬ সনে (২য় সংস্করণে) গ্রহণ করিয়াছিলেন। লিখিয়াছিলেন, “অব্যয় হইলে ‘কি’, সর্বনাম হইলে বিকল্পে ‘কী’বা ‘কি’হইবে, যথা : ‘তুমি কি যাইবে? তুমি কী (কি) খাইবে বল’। (নিয়ম ৭) অর্থাৎ সর্বত্র ‘কি’লিখিলেও অন্যায় হইবে না।

ব্যাখ্যাচ্ছলে জানানো হইয়াছিল, ‘অর্থপ্রকাশের সুবিধার নিমিত্ত ‘কি’ও ‘কী’র ভেদ বিকল্পে বিহিত হইল। অন্যত্র ঈ ই প্রয়োগের হেতু দেখা যায় না, কেবল ই উ লিখিলে বানান সরল হইবে।’(নিয়ম ৭) ইহা কি প্রকারান্তরে রবীন্দ্রনাথের আবদার যুগপৎ প্রত্যাখ্যান ও অনুমোদন দুইটাই ছিল না? ইহাতেই তো শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আগে তিনি পালন করিয়া চলিবেন বলিয়া কথা দিয়াছিলেন। তাই না? আমরা ইহার অর্থ করিতে পারি কেহ ইচ্ছা করিলে বা প্রয়োজনে ‘কী’লিখিতে পারিবেন, তবে অন্যদের লিখিতে বাধ্য করা যাইবে না। এতদিনে আমাদের বাধ্য করা হইতেছে, ইচ্ছা এখন অধিকারকে হটাইয়াছে।

ইতিহাসের অনুরোধে স্মরণ করিতেছি এই দীর্ঘ ঈকারযুক্ত কী বানানের দাবি প্রথম তুলিয়াছিলেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। তাঁহাদের ‘চ’ল্‌তি ভাষার বানান’ নামক প্রবন্ধে জানানো হইয়াছিল

‘সাধুভাষা ও চল্‌তি ভাষা দুয়েতেই প্রশ্নসূচক অব্যয় কি [হ্রস্ব] ই-কার দিয়ে লেখা হবে। নির্দেশক সর্ব্বনাম “কী” [দীর্ঘ] ঈ-কার দিয়ে লেখা হবে। যেমন: তুমি কি খাবে? [অব্যয়], তুমি কী খাবে? [সর্ব্বনাম], তুমি কী কী খাবে [সর্ব্বনাম]।’সঙ্গে আরো জানান হইয়াছিল, ‘পুরানো বাঙলা পুঁথীতে “কী”বানান অনেক জায়গায় পাওয়া যায়।’ (বানান বিতর্ক’, পৃ. ৩০৯-৩১০)

বানানের তফাত না থাকিলে ভাবের তফাত নিশ্চিত করা যাইবে না বলিয়া রবীন্দ্রনাথ ‘কি’বানান হইতে ‘কী’বানান আলাদা করিতে চাহেন। ‘তুমি কি জানো?’ এই প্রশ্নে দুই দুইটা ভাব প্রকাশ হইতে পারে। একটা ভাবে প্রশ্ন করা হয় শ্রোতা জানেন কি জানেন না। রবীন্দ্রনাথ ইহার নাম রাখিয়াছেন ‘জানা সম্বন্ধে’প্রশ্ন। দ্বিতীয় ভাবে একটা সন্দেহ করা হয় মাত্র। সন্দেহের বিষয় শ্রোতা জানেন কি জানেন না এই বিকল্প নহে। বিষয় তিনি কতখানি জানেন তাহাতেই সীমিত। রবীন্দ্রনাথ ইহার নাম রাখিলেন ‘জানার প্রকৃতি বা পরিমাণ সম্বন্ধে’প্রশ্ন। ভাবের এই তফাত নিশ্চিতরূপে আন্দাজ করিতে হইলে বানানের তফাত করিতে হয়। ইহাই রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাব। দেবপ্রসাদ ঘোষের কাছে লেখা দ্বিতীয় পত্রিকায় ঠাকুরের প্রতিপাদ্য ইহাই। (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৮৪-৮৫)

ছয় বছর আগের- জীবনময় রায়কে লিখিত-চিঠিতে পরিমার্জিত রূপও বাংলা শব্দতত্ত্ব বইয়ে পাওয়া যায়। তাহাতে রবীন্দ্রনাথ ব্যাকরণের ‘পদ’অর্থেও জাতি শব্দটির ব্যবহার করিয়াছেন। বলিয়াছেন ‘কি’শব্দ অব্যয় হইলে এক জাতি, সর্বনাম হইলে অন্য জাতি। জাতির মতন অর্থেরও ভেদ হয়। এই ভিন্ন জাতিধর্ম আর ভিন্ন অর্থধর্ম বুঝবার সুবিধা হয় বলিয়াই তিনি বানানের তফাত দরকার বোধ করেন। তাঁহার আশঙ্কা, ‘এক বানানে দুই প্রয়োজন সারতে গেলে বানানের খরচ বাঁচিয়ে প্রয়োজনের বিঘ্ন ঘটানো হবে।’ (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৯০)

এক্ষণে কবির উদাহরণ ‘কি রাঁধছ?’ অথবা “কী রাঁধিছ?”- এই প্রশ্নেও দুই অর্থ প্রকাশ্য হয়। রবীন্দ্রনাথ বলেন, “বলা বাহুল্য এ দুটো বাক্যের ব্যঞ্জনা স্বতন্ত্র।” বাক্যের এক ব্যঞ্জনা- শ্রোতা রাঁধিতেছেন কি রাঁধিতেছেন না সেই দ্বন্দ্ব। দ্বিতীয় ব্যঞ্জনা, তিনি রাঁধিতেছেন নিশ্চিত তবে জানার ইচ্ছা হইতেছে কোন ব্যঞ্জন রাঁধিতেছেন। এই দুই ব্যঞ্জনার তফাত করিতে হইলে বানানের তফাতে সাহায্য হইবে। ইহার একটি বিকল্পও রবীন্দ্রনাথের মনে আসিয়াছিল: “যদি দুই ‘কি’-এর জন্যে দুই ইকারের বরাদ্দ করতে নিতান্তই নারাজ থাক তা হলে হাইফেন ছাড়া উপায় নেই। দৃষ্টান্ত: ‘তুমি কি রাঁধ্ছ’ এবং ‘তুমি কি-রাঁধ্ছ’।” (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ, ২৯০)

দুর্ভাগ্যবশত এই বিকল্পটি প্রয়োগের কথা তিনি বেশিদিন মনে রাখেন নাই। অর্থের প্রভেদ করার সমস্ত দায় তিনি বানানের উপর ছাড়িয়া দিয়াছিলেন। বিচার করিয়া দেখিতে হয়, এই দায় সত্য সত্যই বহন করা বানানের ক্ষমতায় কুলাইবে কিনা।

জীবনময় রায়কে লিখিত ১৯৩১ সালের পত্রিকায় তিনি আরো একটি পথের সন্ধান পাইয়াছিলেন। কবি বলিতেছিলেন ভাষায় অতিরিক্ত যতিচিহ্ন ব্যবহার করার দরকার নাই। তাঁহার কথায়, “চিহ্নগুলো ভাষার বাইরের জিনিশ।”এইগুলি অগত্যা ব্যবহার করিতে হয় মাত্র। ভাষার গতি হইলে করিতে হয় না: “সেগুলোকে অগত্যার বাইরে ব্যবহার করলে ভাষায় অভ্যাস খারাপ হয়ে যায়।” কবি স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন, “প্রাচীন পুঁথিতে দাঁড়ি ছাড়া আর-কোনো উপসর্গ ছিল না। ভাষা নিজেরই বাক্যগত ভঙ্গিদ্বারাই নিজের সমস্ত প্রয়োজনসিদ্ধি করত।”(বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৮৮)

কবি বলিতেছিলেন প্রশ্নবোধক আর বিস্ময়চিহ্নের তো প্রয়োজনই নাই। ‘কে, কি, কেন, কার, কিসে, কিসের, কত প্রভৃতি এক ঝাঁক অব্যয় শব্দ তো আছেই তবে চিহ্নের খোশামুদি করা কেন।’কবি বলিলেন, ‘তুমি তো আচ্ছা লোক’-এই বাক্যে তো শব্দই যাহা বলিবার বলিতেছে। তাহার পর আর বিস্ময়চিহ্ন বা প্রশ্নচিহ্ন যোগ করা বাহুল্য মাত্র। কবির ভাষায়, ‘ইঙ্গিতের পিছনে আরো একটা চিহ্নের ধাক্কা দিয়ে পাঠককে ডব্ল চমক খাওয়ানোর দরকার আছে কি। পাঠক কি আফিমখোর।’

আরো উদাহরণ দিয়াছেন তিনি। ‘রোজ রোজ যে দেরি করি আসো’-এই বাক্যের বিন্যাসেই নালিশের যথেষ্ট জোর আছে। বিস্ময়বোধক চিহ্ন বসাইবার কাজটিই বরং কবির বিস্ময় উদ্রেক করিয়াছে। তিনি বাতলাইয়াছেন, ‘যদি মনে কর অর্থটা স্পষ্ট হল না তা হলে শব্দযোগে অভাব পূরণ’কর। ‘করলে ভাষাকে বৃথা ঋণী করা হয় না-যথা, ‘রোজ রোজ বড়ো-যে দেরি করে আস’।’ (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৮৯)

বাংলা ভাষার এই দোষ নতুন, পশ্চিমের দোষ। পরাধীনতার কুফল। রবীন্দ্রনাথের হাতের ভাষায় এই ‘হাকিমী সাহেবিয়ানায় পেয়ে বসেছে’আমাদের। ‘কে হে তুমি’ বাক্যটা নিজের প্রশ্নত্ব হাঁকাইয়া চলিয়াছে। উহার পিছনে আবার একটা কুঁজওয়ালা সহিস লাগাইবার দরকার নাই। ‘আহা, হিমালয়ের কী অপূর্ব গাম্ভীর্য’-এই বাক্যের পরে আর একখানা ফোঁটা-সওয়ারি দাঁড়ি বা বিস্ময়চিহ্নের প্রয়োগ বৃথা। ভাষাকে বৃথা ঋণী না করাই কবির ধর্ম।

কবি শুদ্ধ ভুলিয়া গিয়াছিলেন যতিচিহ্ন সম্বন্ধে তাঁহার প্রস্তাব বানানচিহ্ন সম্বন্ধেও খাটে। প্রশ্ন বা বিস্ময়চিহ্ন যেমন বাংলা ভাষায় মধ্যে মধ্যে অত্যাচার আকারে হাজির হয় দীর্ঘ ঈকারযুক্ত ‘কী’ বানানও তাহার অনুরূপ কিনা রবীন্দ্রনাথের ভাবিবার অবকাশ হয় নাই। আমার ধারণা- না হওয়াতে আমাদের ভাষারই ক্ষতি হইয়াছে। ভাষাকে বৃথা ঋণী করার সকল চেষ্টাই পরিহার করিতে হইবে। না করিলে ভাষা সম্বন্ধে সতর্ক হইবার কর্তব্যে শিথিলতা দেখা দেয়।

রবীন্দ্রনাথ নিজেই ইহার নজির দেখাইয়াছেন, ‘চিহ্নের উপর বেশি নির্ভর যদি না করি তবে ভাষা সম্বন্ধে অনেকটা সতর্ক হতে হয়। মনে করো কথাটা এই: “তুমি যে বাবুয়ানা শুরু করেছ।”এখানে বাবুয়ানার উপর ঠেস দিলে কথাটা প্রশ্নসূচক হয়-ওটা একটা ভাঙা প্রশ্ন- পুরিয়ে দিলে দাঁড়ায় এই, “তুমি যে বাবুয়ানা শুরু করেছ তার মানেটা কী বলো দেখি।” “যে” অব্যয় পদের পরে ঠেস দিলে বিস্ময় প্রকাশ পায়। “তুমি যে বাবুয়ানা শুরু করেছ”। প্রথমটাতে প্রশ্ন এবং দ্বিতীয়টাতে বিস্ময়চিহ্ন দিয়ে কাজ সারা যায়। কিন্তু যদি চিহ্ন দুটো না থাকে তা হলে ভাষাটাকেই নিঃসন্দিগ্ধ করে তুলতে হয়। তা হলে বিস্ময়সূচক বাক্যটাকে শুধরিয়ে বলতে হয়-“যে-বাবুয়ানা তুমি শুরু করেছ”। (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৮৯-৯০)

রবীন্দ্রনাথ যদি বাংলা ভাষার এই শিক্ষাটিই ধরিয়া রাখিতেন তবে তাহাকেও ‘কি’ বানান বদলাইবার প্রাণান্তকর ব্যায়ামটি করিতে হইত না। বানানের খরচ বাঁচিত, প্রয়োজনের বিঘ্ন হইত না।

দুঃখের মধ্যে সমস্যা শুদ্ধ বানানের খরচ লইয়া নহে। ঋণই আসল সমস্যা। ভাষার কাজ শুদ্ধ ভাবের প্রকাশ নহে। ভাষা ভাবের জন্মও দিয়া থাকে। সংস্কারও করে। রবীন্দ্রনাথ- আমার আশঙ্কা- এই কথাটিই ভুলিয়া গিয়াছিলেন। ভাবের মাপে ভাষা হইয়া থাকে- এই সংস্কারটাই কবির বাক্যভ্রংশের গোড়ায় বলিয়া আমার ধারণা। মনুষ্যজাতির মধ্যে এহেন অহমিকা আকছার দেখা যায়। মানুষ ভাবিয়া থাকেন তিনি ভাষা তৈয়ার করিয়াছেন। অথচ সত্য তো ইহাও হইতে পারে- ভাষাই মানুষ তৈয়ার করিয়াছে।

মানুষ ভাষার প্রভু নহে- বরং ভাষাই মানুষকে পালন করেন। এই সত্যে যতদিন সন্দেহ থাকিবে ততদিন রবীন্দ্রনাথের মতন আমাদেরও বাক্যভ্রংশ রোগের শিকার হইতেই হইবে। আমি বা আপনি কিয়ৎ পরিমাণে ভাষার স্রষ্টা- এই বিশ্বাসই আমাদের আদিপাপ। আর কে না জানে পাপ বাপকেও ছাড়ে না। কেবল ভাষার অধীন থাকিয়াই মানুষকে ভাষার প্রেম জয় করিতে পারে। যে মানুষ ভাষার অধীনতা সহজে স্বীকার করে তাহাকেই আমাদের দেশের সাধকরা ‘সহজ মানুষ’বলিয়াছেন।

‘কি’সমস্যায়ও আমার এই বক্তব্য। দুই বানানে এক শব্দ লিখিবার এই অসম্ভব বাসনা অভিমানি প্রভুর বিকারগ্রস্ত বাসনা বৈ নহে। ভাষা নিজেই নিজের অর্থ প্রকাশ করিতে সক্ষম, বিকাশ করিতে সক্ষম। কারণ ভাষা নিজেই আকাশ। আর ভাষার সকাশেই ভাবের হিসাব-নিকাশ। ভাষা মানে কি মাত্র বানান বা যতিচিহ্ন? কখনই না।

বঙ্কিমচন্দ্র বকলম কমলাকান্ত লিখিলেন, “কে গায় ওই?” তিনি ‘কে’পদে কি বুঝাইলেন? “কে”শব্দে নানা ভাবের প্রকাশ হইতে পারে। প্রশ্ন যদি হইত ‘কে গায়?’- শুদ্ধ ওইটুকুই, তবে জানিতাম উত্তর হইবে রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ কি রামপ্রসাদ, কি অন্য কোন একজন। কিন্তু ‘ওই’ শব্দ জোড়া দিয়া বঙ্কিম সেই ভাবের সর্বনাশ করিয়াছেন। বাংলা ভাষায় যদি দৈবক্রমে দীর্ঘ একার বলিয়া কোন স্বরচিহ্ন থাকিতও তাহাতেও শান্তি হইত না। কে গায়? বলা মুশকিল। প্রশ্ন হয়, “গায়” বলিতেও বা কি বুঝাইল?

‘পথিক পথ দিয়া, আপন মনে গায়িতে গায়িতে যাইতেছে। জোৎস্নাময়ী রাত্রি দেখিয়া, তাহার মনের আনন্দ-উছলিয়া উঠিয়াছে। স্বভাবতঃ তাহার কণ্ঠ মধুর; -মধুর কণ্ঠে, এই মধুমাসে, আপনার মনের মাধুর্য্য বিকীর্ণ করিতে করিতে যাইতেছে। তবে বহুতন্ত্রীবিশিষ্ট বাক্যের তন্ত্রীকে অঙ্গুলি স্পর্শের ন্যায়, ঐ গীতিধ্বনি আমার হৃদয়কে আলোড়িত করিল কেন?’

কমলাকান্তের ‘উত্তর কি?’

একটা উত্তর এই রকম:

‘ক্ষণিক ভ্রান্তি জন্মিল- তাই এই সংগীত এত মধুর লাগিল। শুদ্ধ তাই নয়। তখন সংগীত ভাল লাগিত- এখন লাগে না- চিত্তের যে প্রফুল্লতার জন্য ভাল লাগিত, সে প্রফুল্লতা নাই বলিয়া ভাল লাগে না। আমি মনের ভিতর মন লুকাইয়া সেই গত যৌবনসুখ চিন্তা করিতেছিলাম- সেই সময়ে এই পূর্বস্মৃতিসূচক সংগীত কর্ণে প্রবেশ করিল। তাই এত মধুর বোধ হইল।’

যথার্থ উত্তরণ হইল কি? কমলাকান্ত জানেন, হয় নাই।

‘-কিন্তু কি বলিতেছিলাম, ভুলিয়া গেলাম। সেই গীতিধ্বনি! উহা ভাল লাগিয়াছিল বটে, কিন্তু আর দ্বিতীয় বার শুনিতে চাহি না। উহা যেমন মনুষ্যকণ্ঠজাত সংগীত, তেমনি সংসারের এক সংগীত আছে। সংসাররসে রসিকেরাই তাহা শুনিতে পায়। সেই সংগীত শুনিবার জন্য আমার চিত্ত আকুল। সে সংগীত আর কি শুনিব না?’

এতক্ষণে বুঝিলাম, ‘কে গায়?’-ওটা একটা কথার কথা মাত্র। গায়কের পরিচয় নিশ্চয় করিয়া জানা জিজ্ঞাসাকর্তার আদত উদ্দেশ্য ছিল না। এই যে কথার কথা-ইহার নামই ভাষার পালনক্ষমতা।

‘শুনিব, কিন্তু নানাবাদ্যধ্বনিসংমিলিত বহুকণ্ঠপ্রসূত সেই পূর্ব্বশ্রুত সংসারসংগীত আর শুনিব না। সে গায়কেরা আর নাই- সে বয়স নাই, সে আশা নাই। কিন্তু তৎপরিবর্ত্তে যাহা শুনিতেছি, তাহা অধিকতর প্রীতিকর। অনন্যসহায় একমাত্র গীতিধ্বনিতে কর্ণাধার পরিপূরিত হইতেছে। প্রীতি সংসারে সর্ব্বব্যাপিনী- ঈশ্বরই প্রীতি। প্রীতিই আমার কর্ণে এক্ষণকার সংসার-সংগীত। অনন্ত কাল সেই মহাসংগীত সহিত মনুষ্য-হৃদয়-তন্ত্রী বাজিতে থাকুক। মনুষ্যজাতির উপর যদি আমার প্রীতি থাকে, তবে আমি অন্য সুখ চাই না। শ্রীকমলাকান্ত চক্রবর্ত্তী।’ (বঙ্কিম রচনবাবলী, খণ্ড ২, মু. ১৪, পৃ, ৪৫-৪৭)

(চলবে)

পাঠকের পছন্দ

গরমে ঘামাচিতে জেরবার?

ভ্রমণের সময় যা মনে রাখবেন

কীভাবে হবেন ভালো সহকর্মী?

সর্বাধিক পঠিত
  1. আসছে এ পি জে আবদুল কালামের বায়োপিক, নায়ক ধানুশ
  2. অক্ষয়ের মামলা, সুদসহ টাকা ফেরত দিয়ে ‘হেরা ফেরি ৩’ ছড়ালেন পরেশ রাওয়াল
  3. শুধু অভিনেতা নন, পেশাদার পাইলটও ছিলেন মুকুল দেব
  4. বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর থেকেই ঘরবন্দি ছিলেন মুকুল দেব
  5. পরেশ রাওয়ালের বিরুদ্ধে ২৫ কোটির মামলা ঠুকলেন অক্ষয় কুমার
  6. টিজারেই ঝড় তুলল ‘ওয়ার ২’, মুক্তির তারিখ ঘোষণা
সর্বাধিক পঠিত

আসছে এ পি জে আবদুল কালামের বায়োপিক, নায়ক ধানুশ

অক্ষয়ের মামলা, সুদসহ টাকা ফেরত দিয়ে ‘হেরা ফেরি ৩’ ছড়ালেন পরেশ রাওয়াল

শুধু অভিনেতা নন, পেশাদার পাইলটও ছিলেন মুকুল দেব

বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর থেকেই ঘরবন্দি ছিলেন মুকুল দেব

পরেশ রাওয়ালের বিরুদ্ধে ২৫ কোটির মামলা ঠুকলেন অক্ষয় কুমার

ভিডিও
এক্সপার্ট টুডেস কিচেন : পর্ব ২৯৯
এক্সপার্ট টুডেস কিচেন : পর্ব ২৯৯
নাটক : প্রেম আমার
নাটক : প্রেম আমার
গানের বাজার, পর্ব ২৩৩
কোরআন অন্বেষা : পর্ব ১৮১
কোরআন অন্বেষা : পর্ব ১৮১
এই সময় : পর্ব ৩৮২০
এই সময় : পর্ব ৩৮২০
আলোকপাত : পর্ব ৭৭৫
টেলিফিল্ম : প্রিয় অভিভাবক
টেলিফিল্ম : প্রিয় অভিভাবক
ফাউল জামাই : পর্ব ৯৫
মহিলাঙ্গন : পর্ব ৩৫৯
মহিলাঙ্গন : পর্ব ৩৫৯
আপনার জিজ্ঞাসা : পর্ব ৩৩৭১
আপনার জিজ্ঞাসা : পর্ব ৩৩৭১

Alhaj Mohammad Mosaddak Ali

Chairman

NTV Online, BSEC Building (Level-8), 102 Kazi Nazrul Islam Avenue, Karwan Bazar, Dhaka-1215 Telephone: +880255012281 up to 5, Fax: +880255012286 up to 7

Alhaj Mohammad Mosaddak Ali

Chairman

NTV Online, BSEC Building (Level-8), 102 Kazi Nazrul Islam Avenue, Karwan Bazar, Dhaka-1215 Telephone: +880255012281 up to 5, Fax: +880255012286 up to 7

Browse by Category

  • About NTV
  • Career
  • NTV Programmes
  • Advertisement
  • Web Mail
  • NTV FTP
  • Satellite Downlink
  • Europe Subscription
  • USA Subscription
  • Privacy Policy
  • Terms & Conditions
  • Contact
  • Archive

NTV Prime Android App

Find out more about our NTV: Latest Bangla News, Infotainment, Online & Live TV

Qries

Reproduction of any content, news or article published on this website is strictly prohibited. All rights reserved

x