আমার এ দেহখানি
সর্বজনপাঠ্য একটি বই

পূরবী বসু নারীবাদী কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক। তাঁর এই পরিচয়ের পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎ মেলে ‘আমার এ দেহখানি’ বইতে। বইটির সাবটাইটেল হলো ‘নারীর কথা : গল্পে ও রচনায়’। অর্থাৎ পূরবী বসু তাঁর রচিত নারীজীবননির্ভর ছোটগল্প ও নারীজীবনের জাগতিক, শারীরিক, সামাজিক, মনোজাগতিক সমস্যা নিয়ে রচিত চিন্তাশীল প্রবন্ধের সম্মিলন ঘটিয়েছেন এই বইয়ে।
বইটি প্রকাশিত হয় বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে, ২০১৩ সালে। চমৎকার প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। ৪৪৮ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য ৬৫০ টাকা।
বইয়ের নিবেদন অংশের শুরুতেই লেখক পূবরী বসু লিখেছেন, ‘পুরুষ ও পুরুষতন্ত্র যে দুটি প্রধান অস্ত্রের মাধ্যমে নারীকে শোষণ ও অবদমন করে থাকে, তার একটি ধর্মীয় বা শাস্ত্রীয় গ্রন্থে বিধৃত নারী-নির্মাণ ও নারীর বিরুদ্ধে আরোপিত যাবতীয় অনুশাসন-বিধিনিষেধ; আরেকটি, সাহিত্যকলায়, বিশেষত প্রচলিত লোকসংস্কৃতিতে, বর্ণিত নারীর রূপ, প্রকৃতি ও ভূমিকা।’ কথাগুলো আমাদের কাছে একেবারে নতুন না হলেও, এটা গুরুত্বপূর্ণ এ জন্য যে, লেখকের দৃষ্টিভঙ্গিটা এ থেকে পরিষ্কার হয়। বোঝা যায়, তিনি বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। নারীর দেহকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে চান তিনি।
বইয়ের ভেতরের আলোচনায় পূরবী কয়েকটি প্রসঙ্গ ধরে এগিয়েছেন। প্রতিটা প্রসঙ্গ একটি-দুটি গল্প ও প্রবন্ধের সংযোগে তিনি দাঁড় করিয়েছেন। স্বল্প পরিসরে দীর্ঘ এই বইয়ের সব প্রসঙ্গ ধরে আলোচনা করা সম্ভব না। আমি বইটির চরিত্র সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য কেবল একটি প্রসঙ্গ ধরে আলোচনা করব।
বইটির একটি মজার প্রসঙ্গ হলো ‘মাতৃত্ব’। এই অংশে তিনটি প্রবন্ধ ও দুটি গল্প আছে। প্রথম প্রবন্ধ ‘মা হওয়া কি মুখের কথা?’ এই অংশে লেখক বলতে চেয়েছেন মা হওয়া একজন নারীর জীবনের অন্যতম কষ্টকর এক অধ্যায়। প্রসববেদনা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ বেদনা শেষ হয়ে যায় না, কেবল অন্য একটি মাত্রা পায় মাত্র। এখানে তিনি ছোট্ট করে হলেও অতি দরকারি একটা পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন, ‘জগৎজুড়ে প্রতি মিনিটে ৩৮০ জন নারী সন্তানসম্ভবা হচ্ছে। এর ভেতর প্রায় অর্ধেকই, অর্থাৎ ১৮০টি গর্ভধারণ অনাকাঙ্ক্ষিত অথবা অপরিকল্পিত। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ (১১০টি) গর্ভধারণ কোনো না কোনো জটিলতার মুখোমুখি হয়। আর কমপক্ষে ৪০টির সমাপ্তি ঘটে গর্ভপাতে। মৃত্যু হয় অন্তত একজনের।’ এ কেবলই এক মিনিটের হিসাব; যে মিনিটে হয়তো একজন পুরুষ জুতার ফিতে বাঁধতে বাঁধতে কিংবা সিগারেটে আগুন দিতে দিতে কাটিয়ে দেয়। এরপর প্রবন্ধজুড়ে বিষয়টির আরো বিশদ বয়ান আমরা পাই।
দ্বিতীয় গদ্য ‘সৃষ্টির রহস্য : নারী ও পুরুষ’। এই প্রবন্ধে পূরবী বলছেন, জীবজগতে যৌন ও অযৌন এই দুই রকম বংশবৃদ্ধির প্রচলন আছে। তবে সুস্থ ও সবল প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্য যৌনপ্রজনন অযৌন প্রজননের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকরী ও শ্রেষ্ঠতর। এর কারণ তিনি এখানে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এই প্রসঙ্গ ধরে তিনি সত্যের পথে এগিয়েছেন। সত্যটা হলো, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভালোমন্দের ভাবনায় পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি নারী জড়িত। পুরুষ এ ক্ষেত্রে স্বার্থপর কিন্তু নারী কল্যাণমুখী, নিঃস্বার্থপ্রাণ।
পরের অংশে পূরবী অন্যান্য প্রাণিকূলের জৈবপ্রকৃতির উদাহরণ টেনে দেখিয়েছেন, সুস্থ প্রজন্ম গড়ে তোলায় স্ত্রী-জাতির অবদান সবচেয়ে বেশি। পুরুষজাতির মধ্যে যে প্রবণতা কাজ করে তা হলো বৈচিত্র্যপূর্ণ স্ত্রী-সঙ্গ ও নিজের বংশের বিস্তার ঘটানো।
তৃতীয় গদ্য ‘ধরিত্রী’। গল্পের ঢঙে বলে চলা। কতগুলো চরিত্র আছে। প্রথম চরিত্র খাদিজা। সে একজন সংগ্রামী নারী। শ্বশুরবাড়ি যত রকমের সম্ভাব্য অত্যাচার-নিগ্রহ আছে, তার সবটাই সে ভোগ করেছে; তারপর প্রতিবাদী হয়ে সংসার ছেড়েছে। নিজের সন্তানদের বড় করে তুলতে সংগ্রাম চালিয়ে গেছে, একা। অন্য দুটি চরিত্র স্বামী-স্ত্রী। তারা আসে গবেষণার কাজে আসা বিদেশি গবেষক ড. স্মিথের কাছে। তাদের সন্তান হচ্ছে না। স্বামী-স্ত্রী ভীষণভাবে সন্তান চায়। তবে স্ত্রী গোপনে জানায় যে, সে অন্য কোনো পুরুষের শুক্রাণুতে মা হতে চায়। কারণ তার স্বামী নানা রোগে জর্জরিত। সে সুস্থ সন্তান চায়, আবার অসৎভাবেও নয়।
এই অংশটিতে বিষয়ভিত্তিক আরো দুটি গল্প আছে। একটি ‘জনক-জননী’, অন্যটি ‘সবাই তাকে পাগল বলে’।
এভাবেই নারীজীবনের আরো ষোলটি প্রসঙ্গের আলোচনা পূরবী বসু করেছেন গল্পে ও প্রবন্ধে। তাঁর শাণিত যুক্তি, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি, কখনো কখনো কল্পিত চরিত্রের মধ্য দিয়ে বাস্তবনির্ভর কাহিনীর সরল উপস্থাপন পাঠককে নানাভাবে ঋদ্ধ করে। নারী ইস্যুতে যারা কাজ করছে, যারা নারীকে জানতে চায় এবং যারা নারীকে ভুলভাবে জানে সবার জন্যই বইটি সমান গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের এই ধরনের ইস্যু নিয়ে অনেকেই কাজ করেছেন। কিন্তু পূরবী বসুর এই বইখানির মেজাজ একেবারে আলাদা। তার দৃষ্টিভঙ্গিও যেমন কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র তেমন প্রকাশভঙ্গিও সহজাত। তিনি প্রবাসজীবনে বিজ্ঞানচর্চা করেন, গল্প লেখেন, প্রবন্ধ লেখেন এবং চেতনায় নারীবাদী তাই তাঁর কাজটি অন্যদের থেকে আলাদা হবে, সেটাই স্বাভাবিক। বইটিকে লেখক-পাঠক-অপাঠক সবার জন্য অবশ্যই পাঠ্য বলে আমি মনে করছি।