গল্প
উচলে চলন

ধোপদুরস্ত বিশেষণটি এখন বেশ লাগসই কবি কায়েস কায়সারের ক্ষেত্রে। নিখুঁত দাড়ি কামিয়েছেন। পরিপাটি আঁচড়ানো চুল। গায়ে চাপিয়েছেন সাদা রঙের পাঞ্জাবি-পাজামা, ধবধবে তাঁর বাহার। কড়কড়ে মাড়ের পরে তাতে ইস্তিরির দাগ বসেছে পাকা পেয়ারায় কাঠবিড়ালির দাঁতের মতো!
একটি সাহিত্যসভায় যোগ দেবেন কায়েস। ঘড়ির হিসাবে হাতে সময় খুব একটা নেই বটে। যদিও তিনি জানেন, নির্ধারিত সময়ের অন্তত আধা ঘণ্টা পরে অনুষ্ঠান শুরুর প্রস্তুতি শুরু হবে, মূলে গড়াতে আরো মিনিট কুড়ি-পঁচিশ। সব মিলিয়ে এক ঘণ্টার খাসলতজট! তবু যথাসময়ে অনুষ্ঠানে পৌঁছানোটাই তাঁর স্বভাব। পশ্চিম ধানমণ্ডির ভাড়া বাসা থেকে বেঙ্গল গ্যালারিতে রিকশায় যেতে বড়জোর মিনিট পনেরো লাগবে। সময় বাকি পাক্কা চল্লিশ মিনিট।
ঘর ছাড়ার শেষ মুহূর্তে শান্তিনিকেতনী ঝোলায় রুমাল, পানির বোতল, নিজের একখানি কবিতার বই এবং অন্যান্য দরকারি জিনিস ভরে নেন কায়েস। চুলটা আরেক দফা ঠিকঠাক করতে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই চোখ গেল কুঁচকে। পাঞ্জাবিতে ছোপ ছোপ নীলের দাগ! তাও আবার যেখানে-সেখানে নয়, একেবারে বুক বরাবর; প্রথমেই চোখ আটকে যাবে যে কারো। মেজাজে চিড় ধরে তাঁর।
বাতের ব্যথায় পারুল স্থায়ীভাবে বিছানা নেওয়ার পর থেকে ঠিকে ঝি-ই কাপড়চোপড় কাচে। এ জন্য মাসে তিনশ টাকা বাড়তি গুনতে হয় তাঁদের। টাকাটা কি সে হালাল করে নেবে না? পাঞ্জাবি-পাজামাটা বিয়ের সময় পারুলের বাবারই দেওয়া। দেখতে দেখতে কায়েস-পারুল জোড়ের বয়স ১৪ পেরিয়ে গেল। পোশাকের জোড়টিও এত ভালো যে এখনো তা নতুনের মতোই লাগে! বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে গেলে এটিই পরে যান কায়েস। অবশ্য এর চেয়ে ভালো কোনো বন্দোবস্তও তাঁর নেই।
কোনো একটা কাপড়ের টুকরো পানিতে ভিজিয়ে তা-ই দিয়ে নীল ছোপ মোছার কথা ভাবলেন কায়েস। আজ না হয় অনুষ্ঠান শুরুর বাস্তবিক সময়ে হাজির হবেন! দাওয়াতপত্রে লেখা ‘আনুষ্ঠানিক’ সময়ে যাবেন না।
পাঞ্জাবিটা গা থেকে খোলেন। বিছানায় সেটি বিছিয়ে ভেজা কাপড় দিয়ে ডলা দিতে আরেক বিপত্তি। মাড় মার খেয়ে যা-তা কুঁচকে গেল। নীলের ছোপ আরো বিচ্ছিরিভাবে চোখে পড়তে লাগল। বিরক্তিতে কায়েসের মুখ এবার করলা ছেড়ে নিমতেতো! কী করবেন এখন? পারুলকে ডাকবেন? বেচারি কাল রাতে ব্যথায় এক ফোঁটাও ঘুমাতে পারেননি। আজ দুপুরে খাওয়ার পর একটু বিছানায় গড়িয়েছেন। এখন তাঁর ঘুম ভাঙানো ঠিক হবে না। আর সে-ই বা এখন এর কী গতি করবেন?
পারুল জানেন, আজ একটি সাহিত্যসভায় যাবেন কায়েস। বাইরে থেকে দরজা লক করে যাওয়ার কথা তাঁর। অন্য সময়েও কায়েস মোটামুটি এ কায়দাতেই বাইরে যান। প্রতিদিন তো আর যাওয়া পড়ে না, যানই কালেভদ্রে। কে কবে একটা লেখার প্রুফ দেখতে ডাকবেন, তার অপেক্ষায় থাকেন। মাঝেমধ্যে হাঁটাপথের দূরত্বে কাছে-পিঠের এ-ও প্রকাশনা সংস্থায় নিজেই ঢুঁ দেন। যদি কাজটাজ পাওয়া যায় কিছু একটা।
পারুল একা একাই দেড় কামরার বাসাটায় আটকা পড়ে থাকেন! ছেলেপুলে তো আর হলো না। চেষ্টাচরিত্রও একেবারে যে হয়নি, তা নয়। এখন ‘কপাল’ মেনে নেওয়াটাই একমাত্র সান্ত্বনা তাঁদের। পারুলের সময় কাটতে চায় না। কায়েস বাসায় থাকলেও হয় প্রুফ দেখা, নয়তো নিজের লেখালেখি নিয়ে বসেন। এক যুগ বয়সের সাদা-কালো টিভিই সঙ্গী পারুলের।
ভেজা কাপড়ে পাঞ্জাবিটা মোছার পর কায়েসের মনে হলো, যেন কোনো শিশু বমি করে দিয়েছে! পানি লেগে মাড়ের থলথলে চেহারা এমন ফুটে উঠেছে, দুধ খেয়ে শিশুরা যেমন বমি করে ফুটফাট, ঠিক তেমন দেখতে। বড় আপার বাচ্চা দুটোর বেলায় দেখেছেন কায়েস। একটু এদিক-সেদিক হলেই ফুটুস করে বমি করে দেয় শিশুরা! তাঁদের ঘর শিশুশূন্যই রইল! নাহ... মাথাটা জোর ঝাঁকিয়ে এসব ভাবনা তাড়ান মাথা থেকে! এখন তাঁকে যেতে হবে। কী আর হবে এসব ভেবে? মেনেই তো নিয়েছেন নিয়তি!
সাদাটা ছেড়ে খদ্দরের পাঞ্জাবিটা যে পরে যাবেন, তারও তো জো নেই। গত তিন-চারদিন টানা ওটাই পরেছেন কায়েস। আজ সকালেও বাজারে গিয়েছিলেন ওটা গায়ে দিয়ে। ঘামে-গন্ধে একসা হয়ে আছে। মনে মনে হিসাব কষে দেখেন, বেঙ্গল গ্যালারিতে হেঁটে যেতে মিনিট ত্রিশেক লাগবে। এর মধ্যে নিশ্চয়ই শুকিয়ে যাবে পাঞ্জাবিটা। ভেজাটাও আবার এমন জায়গায়... যাক, কী আর করা! পাঞ্জাবিটা আবার গায়ে চাপান।
বাসা থেকে বেরিয়ে হাতঘড়িতে সময়ের যে টানাটানি দেখেন কায়েস, রিকশা নেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। মিনিট কুড়িতে হেঁটে কুলিয়ে ওঠা যাবে না। পকেটে পড়ে আছে ৬০ টাকার মতো। কয়েকটা সিগারেট কেনাও দরকার। সাহিত্য-আঙিনার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা হবে। সিগারেট অফার না করে সব সময় অন্যেরটা খাওয়া ভালো দেখায় না।
এক রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করতে ভাড়া চাইল চল্লিশ টাকা। মাথায় চিড়িক করে কেমন রক্ত উঠে গেল কায়েসের! যাওয়া-আসার ভাড়া চায় নাকি?
শব্দরাজ্যের অন্তহীন কুয়াশা-পথে ঘুরে ঘুরে জুতসই একেকটি আলোকবিন্দুর মতো শব্দ খোঁজায় বুঁদ হয়ে থাকেন কায়েস; ঘণ্টার পর ঘণ্টা মনঃসংযোগের কিছুমাত্র টলে না। অথচ রিকশাওয়ালার কথায় কেমন দুম করে মনোচ্যুতি ঘটে গেল তাঁর!
তিন ডাবল ভাড়া চাও মিয়া! ফাজলামি পেয়েছ?
রিকশাওয়ালার সাফ জবাব, না পোষাইলে যাইবেন না!
কী, তোমার অ্যাত্ত বড় সাহস...
কিছু কি একটু বুকে ব্যথা বোধ করেন কায়েস? ব্যথার অনুভূতিতে যেন বা সংবিতও ফিরে পান। একি করছেন তিনি? রাস্তায় দাঁড়িয়ে রিকশাওয়ালার সঙ্গে ঝগড়া করছেন? নাহ, এ কাজ তো তাঁর শোভা পায় না। তিনি যে কবি! কোনোভাবেই আর রিকশাওয়ালার সঙ্গে ঝগড়ায় জড়ানো চলবে না।
রিকশা না নেওয়ার মনস্থ করে সটান হাঁটা শুরু করেন কায়েস। পেছনে তখন রিকশাওয়ালাটি আরেক রিকশাওয়ালাকে কী যেন বলল; দুজনই জোরে হেসে উঠল। না চাইতেও কায়েসের কানে গেল সেই হাসির দমক। যতই ভাবার চেষ্টা করেন, তাঁকে উদ্দেশ করে কিছু বলা হয়নি, ততই মনে হতে লাগল, তিনি-ই উপলক্ষ! কেমন অপমানিত বোধ করেন! বিষয়টি মন থেকে তাড়াতে আরেকজন রিকশাওয়ালাকে ফট করে জিজ্ঞেস করে বসেন, ভাই, বেঙ্গল গ্যালারি যাবেন?
হ যামু।
কত?
পঞ্চাশ ট্যাকা দিয়েন।
খরদুপুরের টিনের চালের মতো এবার মেজাজের উত্তাপ ছড়ায় কায়েসের! কী বলবেন তিনি? রাগে চোখমুখ ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে! কী অদ্ভুত ব্যাপার! টাকার কি কোনো দাম নেই ঢাকা শহরে? দশ মিনিটের রাস্তা নয়, চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা ভাড়া চায়! আর তাও এমনভাবে চায়, যেন ন্যায্য ভাড়াটাই চাওয়া হয়েছে। কিছু বললে উল্টো তর্ক জুড়ে দেয়।
কী মামা, যাইবেন না?
কায়েস মনে মনে বলেন, শালার রিকশাতেই চাপব না আর! বিগারের চোটে বেশ কিছুদূর দুদ্দার ছোটার পর একটু দাঁড়ান, একটু ধাতস্থ হন। নাহ, অযথাই রাগ করছেন তিনি! আর করছেনই বা কার ওপর? এমনটাই হয়তো দস্তুর এখন। সবাই তো তাঁর মতো ছেঁড়া পকেটওয়ালা নন। হু-হু করে চারদিকে দরদালান বাড়ছে। গাড়িতে গাড়িতে ঠাসা রাস্তাঘাট। টাকা আছে বলেই না এমন সবকিছুর বাড়বাড়ন্ত! তিনি নিজে না হয় পাঁচ-ছয় ফর্মার একটি বইয়ের প্রুফ দেখে পাঁচশ টাকাও পান না। সবাই কি আর তাঁর মতো? সবাই স্রোতের সঙ্গেই বয়ে চলছেন। আজ সকালেই তো বাজারে তাজা ট্যাংরা দেখে দরাদরি করছিলেন কায়েস। পাশ থেকে এক ভদ্রলোক মাছওয়ালার চাওয়া দামেই দুম করে নিয়ে নিলেন। একবারও তিনি ভাবলেন না, পাশে আরেকজন দাম করছেন। মাছওয়ালাও খুশি বেশি দামে বেচতে পেরে। মাঝখান থেকে মুখ চুন করে মাছ না নিয়ে বাসায় ফিরলেন কায়েস।
রাস্তার পাশের দোকান থেকে একটা সিগারেট নেন কায়েস। ১০ টাকা নিয়ে দোকানদার এক টাকার একটা চকলেট বাড়িয়ে দেন, ‘মামা খুচরা নাই। চকলেট ন্যান।’
মানে কী? আরে, তুমি ব্যবসা করবে খুচরা রাখবে না? আর কায়েসের তো চকলেটের দরকারও নেই। খুচরা নেই—আগে বললেও না হয় সিগারেট নিতেন না। এখন তো জ্বালিয়েও ফেলেছেন। অতএব, দোকানদারের সঙ্গে আপসরফায় যেতে বাধ্য হন কায়েস! এই তো কয়েক দিন আগেই তাঁর বাসার নিচের দোকানদার বলেই বসলেন, ‘কায়েস ভাই, আপনেই খালি এক-দুই ট্যাকা নিয়া কথা কন। আর তো কেউ কিছু কয় না।’
নাহ, আজ আর কিছুতে মন বসবে না! কায়েস ঠিক করলেন, সাহিত্য সভাটভা সব বাদ। ধানমণ্ডি লেকের জলের সামনে কোথাও গিয়ে বসবেন। এমন বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে আর যা-ই হোক, ‘সাহিত্য’ হয় না! তবু কায়েসের মনে পড়ে গেল গতকাল লেখা কবিতার একটা লাইন।
রাতভর কুহক কুয়াশার বিছানো মায়া
লপ্তে তাকে খেদানোর মতো
তাপিত আলোর ফাঁদ সকালে...!
রাস্তার দিক বদল করে লেকের দিকে পা বাড়ান কায়েস। আপনা-আপনি একটা দীর্ঘশ্বাস বুক ছেড়ে বাইরে বেরোয় তাঁর। জীবিকার লড়াইয়ে পরাস্ত মানুষ কায়েসের এ শ্বাসে কবি কায়েসের অস্তিত্ব নেই!