পলিনেট হাউস : শীতের সবজি গ্রীষ্মে, গ্রীষ্মের সবজি পাওয়া যাবে শীতে
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2022/11/16/plinett-haaus.jpg)
রাজশাহীর পবা উপজেলার খড়খড়ি এলাকায় দীর্ঘদিন থেকে নার্সারিতে সবজি, ফল ও ফুলের চারা করে ব্যবসা করে আসছেন শামসুল আলম কাদু। তার ‘কৃষক বন্ধন বিসমিল্লাহ্ নার্সারি’তে চারা উৎপাদন করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত নানা সমস্যার মোকাবেলা করতে হতো তাকে। অসময়ে বৃষ্টিতে যেমন ভেঙ্গে যায় চারা, তেমনি চারাগাছ মরে যায় তাপদাহে। আবার শীতকালে ঘন কুয়াশায় কুকরে যায় গাছ। তবে শামসুল আলম কাদুকে এখন থেকে আর এই বৈরী পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে না। কৃষি বিভাগের ‘পলিনেট হাউস’ সব সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে তার।
এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে পুঠিয়া উপজেলার বিহারীপাড়ার আজিজুল ইসলাম এখন ২৫ শতক জমিতে বছরে সাত থেকে আটটি ফসল উৎপাদনের স্বপ্ন দেখছেন। বছরজুড়ে অসময়ে নানা ধরণের সবজি চাষ করে তিনি ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা আয় করার হিসাব কষে ফেলেছেন। অথচ এক বছর আগেও এই জমিতে কলা চাষ করে এক বছরে তিনি কলা বিক্রি করেছেন মাত্র এক লাখ টাকার।
ষড়ঋতুর দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশে লেগেছে বৈশ্বি জলবায়ু পরিবর্তনের হাওয়া। ফলে শীতের সময় পড়ছে গরম। বৃষ্টির সময় খরা। যখন বৃষ্টির প্রয়োজন, তখন বয়ে যায় তাপপ্রবাহ। আবার যখন রোদের প্রয়োজন, তখন হয় বৃষ্টি। জলবায়ুর এই পরিবর্তন বিরূপ প্রভাব ফেলছে কৃষিতে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে গবেষকরা বলছেন, সময় যত গড়াচ্ছে, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ততই বাড়ছে। এ অবস্থায় ক্রমেই হুমকির মুখে পড়ছে কৃষি। তাই কৃষিকে বাঁচাতে নতুন নতুন গবেষণা ও উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে বিশ্ব জুড়েই। ‘পলিনেট হাউস’ তেমনই এক গবেষণার ফসল। বলা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৃষি বিজ্ঞানের এই উদ্ভাবন টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনার নতুন রূপান্তর।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে রাজশাহী বিভাগের কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ৬৭টি উপজেলায় করা হয়েছে এই পলিনেট হাউস। মডেল হিসেবে প্রতিটি উপজেলায় একটি করে তৈরি হয়েছে এই হাউস। যা দেখে কৃষকরা উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেরাই এই পলিনেট হাউস করতে পারবে।
প্রকল্প পরিচালক ড. এস এম হাসানুজ্জামান জানান, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে আবহাওয়া। পরিবর্তিত এই আবহাওয়ায় জলবায়ুর সাথে মাসঞ্জস্য রেখে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে বর্তমানে ফসল উৎপাদন করতে প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক ও বালাইনাশক ব্যবহার করতে হচ্ছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য রোগমুক্ত ও নিরাপদ ফসল উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় ‘পলিনেট হাউস’ নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তিনি জানান, ২৫ শতক জায়গার ওপর একেকটি পলিনেট হাউস করতে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ২০ লাখ টাকা করে। পলিথিন, শেডনেট, জিআই পাইপসহ যেসব উপকরণ এখানে ব্যবহার করা হচ্ছে, তার সবগুলো আমদানি করতে হয়েছে। যে অবকাঠামো এখানে করা হয়েছে, তার স্থায়ীত্ব হবে প্রায় ২০ থেকে ২৫ বছর। তবে ৪/৫ বছর পর পলিথিন ছিড়ে গেলে তা পরিবর্তন করা যাবে।
ড. এস এম হাসানুজ্জামানের মতে, কৃষিকে রপ্তানিমুখী ও বাণিজ্যিকীকরণে পলিনেট হাউস বিরাট ভূমিকা রাখবে। রাজশাহী অঞ্চলে আমের পাশাপাশি অন্যান্য ফল ও শাকসবজিও যাতে বিদেশে রপ্তানি করা যায়, তার সুযোগ তৈরি হবে।
উপ-প্রকল্প পরিচালক এস এম আমিনুজ্জামান রতন জানান, সব ধরনের শাকসবজি ও ফলমুল চাষ করা যাবে এই পলিনেট হাউসে। সবজির মধ্যে ক্যাপসিকাম, টমেটো, গাজর, মুলা, ফুলকপি, বাধাকপি, ব্রকোলি, মুলা, গাজর বছরজুড়ে চাষ করা যাবে। স্ট্রবেরি, পেয়ারা, তরমুজ এমনকি আমও করা যাবে এখানে। জারবেরা, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, গোলাপসহ সব ধরনের ফুলও করা যাবে এখানে। তিনি বলেন, ‘মূলত পোকামাকড়ের হাত থেকে ফসলকে রক্ষা করতে এই পলিনেট হাউজ। ফলজাতীয় সবজি যেমন সিম, বেগুন, ঢেড়স, বরবটি এমনকি ফুলকপিতেও এতো বেশি পোকামাকড়ের উৎপাত হয়, সেখানে প্রচুর পরিমাণে বালাইনাশক না দিয়ে কৃষকের উপায় থাকে না। পলিনেট হাউসে এসব সবজি চাষ করলে পোকামাকড় দমন করতে কোনো ধরনের কীটনাশক প্রয়োগ করা লাগবে না। ফলে এখানে উৎপাদিত সবজি হবে পুরোপুরি নিরাপদ।’
প্রকল্প পরিচালক ও উপ-প্রকল্প পরিচালক জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি সামাল দিয়ে আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ, রোগবালাইয়ের আক্রমণ প্রতিরোধ, বীজতলার মান নিয়ন্ত্রণ এবং অসময়ের সবজি চাষসহ আধুনিক কৃষিকাজের জন্য পলিনেট হাউসের কোনো জুড়ি নেই। গ্রিনহাউস এর আদলে দেশি কৃষি ব্যবস্থাপনায় নতুন সংযোজন এই পলিনেট হাউস। এর মাধ্যমে শীতকালীন সবজি যেমন গ্রীষ্মকালে উৎপাদন করা যাবে, তেমনি গ্রীষ্মকালের সবজিও শীতে উৎপাদন করা যাবে খুব সহজেই। হাতের মুঠোয় নতুন এই প্রযুক্তি চলে আসায় কৃষককে কোনো বেগ পেতে হবে না। তারা জানান, পলিনেট হাউস প্রযুক্তির মাধ্যমে ভারি বৃষ্টিপাত, তীব্র তাপদাহ, কীটপতঙ্গ, ভাইরাসজনিত রোগ ইত্যাদির মতো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও নিরাপদ থাকবে শাক-সবজি এবং ফলমূলসহ সব ধরনের কৃষি উৎপাদন।
রাজশাহীর পবা উপজেলার খড়খড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ‘কৃষক বন্ধন বিসমিল্লাহ্ নার্সারি’র স্বত্বাধিকারী শামসুল আলম কাদুর ২৫ শতক জমিতে সম্পূর্ণ সরকারি সহযোগিতায় পলিনেট হাউস করে দেওয়া হয়েছে। এতে উন্নত মানের পলি ওয়ালপেপার ব্যবহার করা হয়েছে। জিআই পাইপের ওপর পলিপেপার দিয়ে তিনটি শেডে এই পলিনেট হাউস নির্মাণ করা হয়েছে। এরপর রক্ষণাবেক্ষণসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে পারে। প্রথমবার কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে পুরো খরচ দেওয়া হয়েছে। এই টাকা শোধ দিতে হবে না। তবে এজন্য শামসুল আলমকে একটি শর্ত দিয়েছে কৃষি বিভাগ। শর্তটি হচ্ছে- এখানে উৎপাদিত বীজ, শাক-সবজি ও ফলমূল স্থানীয়ভাবে সবার কাছে ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে হবে। আর এ জন্য রশিদ বই রাখতে হবে।
নার্সারির স্বত্বাধিকারী শামসুল আলম কাদু জানান, পলিনেট হাউসের ভেতর জুলাই মাস থেকে চাষাবাদ শুরু করেছেন তিনি। এখানে শীতকালীন টমেটো, ফুলকপি ও কাঁটা বেগুন এবং চায়না বেগুনের বীজ বুনেছেন। আপাততঃ তিনি বীজ থেকে চারা উৎপাদন করছেন। পলিনেট হাউসের মধ্যে এই দুই মাসের মধ্যেই তিনি উন্নতমানের বীজ উৎপাদনে সফলতা পেয়েছেন।
শামসুল আলম কাদু বলেন, ‘এতোদিন স্থানীয় কৃষকরা নিম্নমানের ও মেয়াদোত্তীর্ণ চারা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকতেন। কিন্তু তারা এখান থেকে উন্নতমাণের বীজের চারা পেয়ে অনেক খুশি। বাজারের চেয়ে দামও কম। তাই তাদের অনেকে এখন ব্যক্তি উদ্যোগেই এই পলিনেট হাউস নির্মাণের কথা ভাবছেন।’
স্থানীয় কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পলিনেট হাউসে উচ্চমূল্যের ফসল যেমন ক্যাপসিকাম, ব্রকলি, রকমেলন, রঙিন (হলুদ) তরমুজ, রঙিন ফুলকপি, বাধাকপি, লেটুস ও অন্যান্য অসময়ের সবজির পাশাপাশি চারা উৎপাদনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এছাড়া গ্রীষ্মকালেও ফলবে শীতকালীন সবজি। এর মধ্যে টমেটো, ফুলকপি, বেগুন, গাজর ইত্যাদি ফসল রয়েছে। এর ফলে সবজি চাষে যেমন বৈচিত্র্য আসবে, তেমনি অনেকেই আয়ের নতুন উৎসের সন্ধান পাবে। পলিনেট হাউজের ওপরে উন্নতমানের পলিথিনের আচ্ছাদন থাকে। তাই এতে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি ভেতরে প্রবেশে বাধা পায়। এছাড়া অতিবৃষ্টি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগেও ফসল অক্ষত থাকে। আবার অতিরিক্ত খরায় যখন পানির প্রয়েজিন হবে, তখন দেওয়া যাবে সেচ। আর এই পদ্ধতিতে কৃষক সারা বছর সবজি চাষ করতে পারবেন। এতে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে সব ধরনের সবজি চাষ করে কৃষক আর্থিকভাবে সফলতা পাবেন।