‘ভাবছিলাম প্রাণে বাঁচতে পারব কি না’
বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হোসাইন মুহাম্মদ আল মুজাহিদ। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী উম্মুল ওয়ারা ঢাকা থেকে বরগুনাগামী ‘এমভি অভিযান-১০’ লঞ্চে রওনা দিয়েছিলেন। ছিলেন একটি দোতলার ভিআইপি কেবিনে। রাত তখন আনুমানিক ৩টা। সে সময় হঠাৎ একজন রুমবয় কেবিনের দরজায় সজোরে ধাক্কা দিয়ে আগুনের বিষয়টি জানিয়ে যান।
রুমবয়ের বরাত দিয়ে হোসাইন মুহাম্মদ আল মুজাহিদ বলেন, ‘‘রুমবয় দরজায় ধাক্কা দিয়ে বললেন, ‘লঞ্চে আগুন লেগেছে। দ্রুত উঠুন। যে যার মতো বাঁচার চেষ্টা করেন।’ উঠে দেখি চারিদিকে ধোঁয়া আর ধোঁয়া। এ দৃশ্য দেখেই দিশেহারা হয়ে পড়ি।’’
গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা থেকে পাঁচ শতাধিক যাত্রী নিয়ে বরগুনা যাচ্ছিল ‘এমভি অভিযান-১০’ নামের যাত্রীবাহী লঞ্চটি। ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীর দপদপিয়া এলাকায় পৌঁছালে রাত ৩টার দিকে ইঞ্জিন কক্ষে আগুন লাগে। পরে লঞ্চটি সদর উপজেলার দিয়াকুল এলাকায় গিয়ে নদীর তীরে নোঙর করে।
এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ৩৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া শতাধিক মানুষ দগ্ধ হয়েছে বলে জানা গেছে।
আজ শুক্রবার বিকেলে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে মুঠোফোনে যখন লঞ্চের যাত্রী ইউএনও হোসাইন মুহাম্মদ আল মুজাহিদের কথা হয়, তখন তিনি ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার বয়ান দেন।
ইউএনও মুজাহিদ বলছিলেন, ‘দিশেহারা হয়ে ভাবছিলাম, প্রাণে বাঁচতে পারব কি না। এরই মধ্যে পরিবারের সঙ্গে শেষ দেখা হয়ে গেছে কি না, আমি একা থাকলে ভিন্ন কথা, সঙ্গে ছিল আমার স্ত্রীও। তখন আমরা নদীর মাঝখানে। তাকিয়ে দেখলাম, কেউ কেউ নদীতে লাফ দিচ্ছেন। কিন্তু আমার সেই সুযোগ নেই। একা হলে হয়তো আমিও তাই করতাম। লঞ্চের সামনের দিকে গিয়ে দেখি অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। আহাজারি করছে। প্রাণে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে সৃষ্টিকর্তার কাছে।’
হোসাইন মুহাম্মদ আল মুজাহিদ আরও বলেন, ‘আগুন লেগেছিল মূলত দ্বিতীয় তলায়। আমাদের কেবিনের পেছনের অংশে। নদীতে যেহেতু লাফ দিতে পারছি না, সেহেতু নিচতলায় যাওয়ার চেষ্টা করলাম। এ সময় তড়িঘড়ি করতে গিয়ে আমার স্ত্রী উম্মুল ওয়ারা পায়ে আঘাত পান। তারপর আমরা লঞ্চের নিচতলায় প্রায় ঘণ্টাখানেক নিরাপদেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেখানে কোনো আগুন কিংবা ধোঁয়া ছিল না।’
‘পরে শুনলাম, আগুন ধরে রাত আড়াইটার দিকে। লঞ্চ সংশ্লিষ্টরা প্রায় ৩০ মিনিট আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। কিন্তু নেভাতে না পেরে রাত ৩টার দিকে আমাদের জানায়। এরপর ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। তখন লঞ্চটি ভাসতে ভাসতে তীরে এসে ভিড়ে। এরপর আমরা লঞ্চ থেকে তীরে নেমে পড়ি’, যোগ করেন ইউএনও।
ইউএনও বলেন, ‘এই পুরো সময়ের মধ্যে আমার মতো দিশেহারা হয়ে অনেকেই নানাভাবে বাঁচার চেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ কল করেছেন। কিন্তু তেমন কাউকে আসতে দেখিনি আমি। এর মধ্যে যারা মাঝনদীতে লাফ দেন, তারা সাঁতরে নদীর তীরে আসতে পেরেছেন কি না আমি জানি না। তবে শুনেছি, নদীতে ঝাঁপ দেওয়া অনেক শিশু ও তাদের অভিভাবক মারা গেছেন।’