চেক প্রতারণার লক্ষাধিক মামলা ঝুলে আছে
শেখ আরফান আহম্মেদ। ঢাকার মিরপুরে একটি ইলেকট্রনিক বিপণনের মালিক। তিনি ব্যবসায়িক প্রয়োজনে আরমান হোসেনকে সাড়ে ১২ লাখ ধার দেন। যথাসময়ে আরমান হোসেনের টাকা দেওয়ায় কথা থাকলেও তিনি তা না দিয়ে ঘোরাতে থাকেন।
আরফান আহম্মেদ তাঁর পাওনা টাকার জন্য বিভিন্ন মাধ্যম ঘুরে অবশেষে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে দুটি চেক পান। আরমান হোসেন সে চেকগুলো তিন মাস পরে ব্যাংকে উপস্থাপন করার জন্য আরফান আহম্মেদকে বলেন। আরফান সে অনুযায়ী ব্যাংকে পাওনা টাকার জন্য চেকগুলো নগদায়নের জন্য ২০১৫ সালের মার্চ মাসে জমা দেন। কিন্তু ব্যাংক থেকে জানানো হয়, নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা আরমানের অ্যাকাউন্টে নেই। তখন আরফান আহম্মেদকে ব্যাংক থেকে ‘ডিজঅনার’ স্লিপ দেওয়া হয়।
আরফান আহম্মেদ সেই ডিজঅনার স্লিপ নিয়ে আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আইনজীবী তাঁকে বিবাদী বরাবর লিগ্যাল নোটিশ পাঠানোর পরামর্শ দেন। পরে আরফান আহম্মেদ বিবাদীর ঠিকানায় লিগ্যাল নোটিশ পাঠান। এতে টাকা দেওয়ার জন্য ৩০ দিনের সময় বেঁধে দেন আরফান। পরবর্তী সময়ে আরমান সে লিগ্যাল নোটিশ পেলেও টাকা দেননি। আরফান টাকা না পাওয়ায় ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে ২০১৫ সালের মে মাসে আরমান হোসেনের বিরুদ্ধে দুটি চেকের মামলা করেন। মামলা দায়েরের পর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালত থেকে আরমান হোসেনের ঠিকানায় সমন জারি করা হয়। কিন্তু আরমান আদালতে হাজির না হওয়ায় আদালত তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। এর পরদিন আরমান আদালত থেকে আপসের শর্তে জামিন নেন।
পরবর্তী সময়ে মামলা দুটি ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে বদলি হয়ে আসে।
সে আদালতেও আরমান হাজির না হওয়ায় আদালত থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। আসামি পরবর্তী সময়ে আইনজীবীর মাধ্যমে জামিন নেন। জামিন নেওয়ার পর আসামি আদালতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে আরফানকে ঘোরাতে থাকেন। আরফান আহম্মেদ একপর্যায়ে এ দুটি মামলায় রায় পাবেন কি না বেশ ভাবনায় পড়ে যান। সম্প্রতি ১৯ জানুয়ারি ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে আরফান আহম্মেদ এনটিভি অনলাইনকে এ বিষয়ে বলেন।
আরফান আহম্মেদ জানান, আসামি একের পর এক মিথ্যা তথ্য দিয়ে ও বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে মামলার সময় নিচ্ছেন। তাঁর মামলা দুটি ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ও তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি গত দুই বছরে ১৫ বার আদালতে এসেছি। কিন্তু আসামি মাত্র দুবার আদালতে এসে লাপাত্তা হয়ে যান। যখনই আদালত কোনো আদেশ দিতে যান, তখনই আসামি তাঁর আইনজীবীর মাধ্যমে বিভিন্নভাবে সময় নিয়ে কালক্ষেপণ করেন। আমি এখন ব্যবসায়িকভাবে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত। কিন্তু আসামি বেশ বহাল তবিয়তে ঘুরছেন।’
এদিকে এনটিভি অনলাইনের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঢাকার আদালতে লক্ষাধিক চেকের মামলা বিচারাধীন আছে। এসব মামলায় আসামির তালিকায় রয়েছেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য, সরকারি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের (সিএমএম) আদালতের সূত্র অনুযায়ী, আদালতে প্রতিদিন গড়ে ২০০ চেক প্রতারণার মামলা করা হয়। গত বছরের সিএমএম আদালতে ৬০ হাজারের বেশি চেক প্রতারণার মামলা হয়েছে।
এদিকে ঢাকার আদালতের সূত্র অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরের ৫৮টি আদালতে প্রায় এক লাখ ১৫ হাজার চেক জালিয়াতির মামলা বিচারাধীন রয়েছে। সংশ্লিষ্ট আদালতের বেঞ্চ সহকারীরা এনটিভি অনলাইনকে এ তথ্য জানান।
এ বিষয়ে ঢাকা বারের আইনজীবী মুনজুর আলম জানান, পাওনাদারের টাকা (ব্যবসায়ী কিংবা ব্যক্তি) পরিশোধের জন্য ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিরা চেক ইস্যু করে থাকেন। ৬০ ভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের চেক ডিজঅনার হয়ে থাকে। অ্যাকাউন্টে যথেষ্ট পরিমাণ টাকা নেই বলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয়। ফলে পাওনাদাররা টাকা তুলতে পারেন না।
মুনজুর আলম আরো জানান, আইন না জানার কারণে প্রতারণার শিকার অনেকেই থানায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করেন। এ আইনে মামলা করে তাঁরা কোনো দিনও টাকা উদ্ধার করতে পারেন না। নিয়ম হচ্ছে, চেক ডিজঅনার ঘোষণার ৩০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আইনজীবীর মাধ্যমে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি নোটিশ দেবেন। এরপরও পাওনাদারের টাকা পরিশোধ না করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আদালতে চেকদাতার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন। ঋণের টাকা আদায়ে প্রতারকের বিরুদ্ধে এনআই অ্যাক্টের ১৩৮ ধারায় মামলা করতে হয়। এ প্রক্রিয়ায় প্রতারিত ব্যক্তিরা টাকা উদ্ধার করতে সক্ষম হচ্ছেন।
আইনজীবী আরো জানান, এ ছাড়া আসামি যদি বাদীকে টাকা না দেন, তখন বাদী আদালতে সাক্ষ্য প্রদানের মাধ্যমে রায় করাতে পারেন। আদালত সবকিছু পর্যালোচনা করে আসামিকে এক বছরের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা দ্বিগুণ টাকা জরিমানা করেন। আর রায়ের পরে আসামি গ্রেপ্তার হলে অর্ধেক টাকা আদালতে জমা দিয়ে ৩০ দিন আপিলের শর্তে জামিন পাবেন।