সাক্ষাৎকার : ড. কামাল হোসেন
‘বিয়ে করলাম, কারো পরিবার মেনে নেয়নি’

ড. কামাল হোসেন। বাংলাদেশের সংবিধান বললে ওই নামটিই চলে আসে। তিনি ছিলেন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রধান। কিংবদন্তি আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত কাছের ব্যক্তি ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আমলে প্রথমে আইনমন্ত্রী ও পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন দীর্ঘদিন হয়েছে। গণফোরাম নামে একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
গত ২০ এপ্রিল ছিল কামাল হোসেনের ৮০তম জন্মদিন। ১৯৩৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পা দিয়েছেন ৮১ বছর বয়সে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে, সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হবে এ স্বপ্ন দেখেন তিনি। এ নিয়ে তিনি আশাবাদীও।
কামাল হোসেনের স্ত্রী মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন। দুই সন্তান। সারা হোসেন একজন ব্যারিস্টার। দিনা হোসেন চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করেন।
নিজের জীবন ও বাংলাদেশ নিয়ে কামাল হোসেন এনটিভি অনলাইনকে দিয়েছেন দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। আজ প্রকাশিত হলো এর প্রথম পর্ব। রাজধানীর নিউ বেইলি রোডের (নাটক সরণি) বাসায় ওই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাকের হোসেন।
এনটিভি অনলাইন : আপনার শৈশব নিয়ে কিছু বলুন। ছোটবেলা, স্কুলজীবন কেমন ছিল?
ড. কামাল হোসেন : আমার জন্ম কলকাতায়। চৌরঙ্গী রোডে। বাবার বাড়ি ওখানেই ছিল। ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর ১৯৪৯ সালে ঢাকায় চলে আসি। তখন আমার বয়স ১২ বছর। প্রাথমিক শিক্ষাটা বাসায় পিতার কাছে শুরু করি। কবে থেকে স্কুলে আসা যাওয়া শুরু করেছি তা মনে নেই। তবে কলকাতার লরেন্টো হাউস থেকে পঞ্চম শ্রেণি এবং কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণি সমাপ্ত করি।
এরই মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশভাগ হয়। এরপর আমরা সপরিবারে ঢাকায় চলে আসি। এসে বর্তমান অফিসার্স ক্লাবের বিপরীতে গুলফিশান নামের একটি বাড়িতে উঠি। আমার বাবা তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইলেক্ট্রো থেরাপি বিভাগের বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্ম শুরু করেন। আমি লক্ষ্মীবাজার সেন্ট গ্রেগরিয়াস স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হলাম। এরপর ১৯৫১ সালে ওই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করি। এরপর সেন্ট গ্রেগোরিয়াস কলেজ (বর্তমানে নটর ডেম কলেজ) থেকে ১৯৫৩ সালে এইচএসসিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হই। আমার এই সাফল্যের পর একই বছর যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নটর ডেম ইন্ডিয়ানা থেকে আমাকে স্কলারশিপ দেওয়া হলো। ওই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে পদোন্নতি দিয়ে সরাসরি তৃতীয় বর্ষে পড়ার সুযোগ করে দেয়।
পরে সেখান থেকে দুই বছরে ১৯৫৫ সালে অর্থনীতিতে সফলতার সঙ্গে অনার্স সম্পন্ন করি। এরপর আমি আইন বিষয়ে পড়াশোনার জন্য ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। সেখানে আইনি বিষয় ‘জুরিসপ্রুডেন্স’ শেষ করি ১৯৫৭ সালে। এরপর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অব সিভিল লয়ের (বিসিএল) ওপর ডিগ্রি লাভ করি। আইনজীবীদের জন্য এটি একটি অনেক বড় ডিগ্রি। এরপর ১৯৫৯ সালে লিঙ্কনস ইন থেকে ‘ব্যারিস্টার’ (বার-এট-ল) পাস করি। এরপর পিএইচডি ডিগ্রির জন্য অক্সফোর্ডে নিবন্ধন করে দেশে চলে আসি। পরে ১৯৬৪ সালে থিসিস পেপার সাবমিট করি। মাত্র চার মাসে পিএইচডির কাজ সম্পন্ন করি।
এনটিভি অনলাইন : হামিদা আপার সঙ্গে কীভাবে পরিচয়? বিয়ে কীভাবে?
ড. কামাল হোসেন : ঢাকায় ১৯৬৩ সালে হামিদা বেগমের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। তখন তাঁর এক ভগ্নিপতি সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন (বর্তমানে বিসিএস ক্যাডার)। উনার ভগ্নিপতির সঙ্গে আমার পরিচয় ছিলো। সে সুবাদে বোনের বাসায় হামিদা বেড়াতে আসে। সেখানে একদিন সন্ধ্যায় আমি যাওয়ার পর হামিদার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। পরিচয়ের পর ভালো লাগতে শুরু করে। এভাবে অনেকদিন দেখা হতো, কথা হতো। চিঠি দিতো আমাকে। আমিও লিখতাম। তখন তিনি ইতিহাস বিভাগে মাস্টার্স করছেন। আর আমি পড়ালেখা শেষ করে কাজ শুরু করেছি। তবে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। একদিন হামিদাকে বললাম আমি পিএইচডি ডিগ্রির জন্য ইংল্যান্ডে চলে যাচ্ছি। তুমিও ডিগ্রি নিতে অক্সফোর্ডে চলে আস।
হামিদার বাড়ি ছিল পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে। পরবর্তীতে তাঁরা করাচিতে স্থায়ী হন। ১৯৬৪ সালে আমি ইংল্যান্ডে যাওয়ার আগে করাচি বিমানবন্দরে হামিদার সঙ্গে দেখা করি। উনিও আমার জন্য অপেক্ষায় থাকেন। আমার জন্য বিমানবন্দরে ফুলসহ কিছু খাওয়ার জিনিস নিয়ে আসেন। বিমানবন্দরে বিদায় দেওয়ার পর বললাম ইংল্যান্ডে চলে আসার জন্য। আমি অপেক্ষায় থাকলাম। পরে তিনিও ইংল্যান্ডে চলে আসেন। ইংল্যান্ডেই ১৯৬৪ সালে আমরা বিয়ে করলাম। প্রথমে দুজনের পরিবার মেনে নেয়নি। পরে আমার পরিবার ও তাঁর পরিবারকে মানিয়ে নিয়ে দেশে এসে একটি অনুষ্ঠান করেছি। এভাবে সংসার জীবনও শুরু করলাম। হামিদাও কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থার সঙ্গে জড়িত।
(চলবে)