জাকাত নিতে গিয়ে কাফনের কাপড়ে ২৭ জন
জাকাতের কাপড় নিতে হাজির হয়েছিলেন সহস্রাধিক মানুষ। ভেবেছিলেন ওই কাপড় পরে করবেন পবিত্র ঈদুল ফিতর। তা হয়নি। কেউ জাকাতও পাননি। হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে পদদলিত হয়ে মারা গেছেন অন্তত ২৭ জন। আহত হয়েছেন শতাধিক। আজ শুক্রবার ভোর ৫টার দিকে ময়মনসিংহ শহরের অতুল চক্রবর্তী রোড এলাকায় নুরানী জর্দা ফ্যাক্টরির মালিক শামীম তালুকদারের বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে।urgentPhoto
নিহতদের পাঁচজন শিশু ও ২২ জন নারী। এদের মধ্যে একই পরিবারের তিন সদস্য রয়েছে। এদিকে হতাহতের ঘটনায় নুরানী জর্দা ফ্যাক্টরির মালিক শামীম তালুকদার ও তাঁর ছেলে হেদায়েত তালুকদারসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ঘটনা তদন্তে দুটি কমিটি করা হয়েছে।
এর আগে সকালে ময়মনসিংহ কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিকুল ইসলাম প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে জানান, আজ শুক্রবার ভোর ৫টার দিকে অতুল চক্রবর্তী রোড এলাকায় নুরানী জর্দা ফ্যাক্টরির মালিক শামীম তালুকদারের বাসার বাইরে জাকাত নিতে সহস্রাধিক নারী ভিড় করেন। তাদের সঙ্গে কয়েকজন শিশুও ছিল। জাকাত দিতে গেট খুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হুড়োহুড়ি করে ভেতরে প্রবেশ করতে গিয়ে পদদলিত হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান ২০ নারী। পরে শিশুসহ আরো চারজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এ ঘটনায় শতাধিক আহতের খবর পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় বাড়ির মালিকসহ আটজনকে আটক করা হয়েছে। পরে থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রফিক তাঁদের আসামি করে মামলা করেন।
ময়মনসিংহ জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মঈনুল হক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এখানে ভোরে জাকাতের কাপড় দেওয়ার কথা ছিল। জাকাতের কাপড় নেওয়ার জন্য গরিব মানুষ জড়ো হয়। মানুষের চাপে পদদলিত হয়ে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।’
এসপি বলেন, ‘নিহত ব্যক্তির পরিবার-পরিজন লাশ তাদের যার যার বাড়ি নিয়ে গেছে। এ ছাড়া আহত ব্যক্তিদের স্বজনরাও তাদের নিয়ে গেছে। আমরা এ বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছি।’
শামীম তালুকদারের ছেলে হেদায়েত এ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘৩৫ বছর ধরে এভাবে জাকাত দিয়ে আসছি। আজ হঠাৎ করে এত মানুষ আসবে, ভাবতে পারিনি।’
নিহত ব্যক্তিদের নাম-পরিচয় : ময়মনসিংহ সদরের চরপাড়ার হায়দার আলীর স্ত্রী হামিদা বেগম (৪৫), বালুচরের থানাঘাটের আবদুর বারেকের স্ত্রী খোদেজা বেগম (৬০), পাটগুদাম বিহারী ক্যাম্পের সিরাজুল ইসলামের ছেলে সিদ্দিক (১২), একই ক্যাম্পের মৃত বারেকের স্ত্রী শামীমা বেগম (৬০), তাঁর মেয়ে সখিনা (৪০) ও নাতনি লামিয়া (৫), মৃত লাল মিয়ার স্ত্রী হাজেরা বেগম (৭০), গোবিন্দ বসাকের স্ত্রী মেঘনা বসাক (৩৫), বসাকপট্টির সোলেমানের স্ত্রী মরিয়ম (৫০), কাচারী রোডের মৃত মাহতাব আলীর স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা (৭০), লালু মিয়ার স্ত্রী সুফিয়া খাতুন (৪৫), চর ঈশ্বরদিয়ার রবির স্ত্রী ফাতেমা (৩২), মোড়লপাড়ার ইসমাইলের স্ত্রী জোহরা খাতুন (৫২), আবদুল মজিদের স্ত্রী রেজিয়া আক্তার (৪০), দরগাপাড়ার মৃত আবদুস সালামের স্ত্রী ফাতেমা বেগম (৬০), ঢোলাদিয়ার নারায়ণ চন্দ্র সরকারের স্ত্রী সুধারানী সরকার (৫৫), শামসুল হকের স্ত্রী রহিমা বেগম (৫৫) ও রাজা মিয়ার স্ত্রী নাজমা আক্তার (৬০), ধোপাখোলার বজেন্দ্রর স্ত্রী রিনা রানী দে (৬০), ফজলু মিয়ার স্ত্রী জামেরন মেওয়া (৫৫) ও ফজলু মিয়ার স্ত্রী বেগম টুকু (৪০), আকুয়া এলাকার রতন মিয়ার মেয়ে রুবিয়া আক্তার (১২), সদরের আকুয়া খালপাড়ের হরমুজ আলীর স্ত্রী খোদেজা ও তাঁর নাতি বৃষ্টি (১২), ত্রিশাল উপজেলার বালিপাড়ার আমজাদের স্ত্রী সাহারন বেগম (৪০), তারাকান্দা উপজেলার মালিডাঙ্গার শফিকুল ইসলামের স্ত্রী সমলা বেগম (৩০) ও জামালপুর জেলার ইতি (১২)।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আ ন ম ফয়জুল হক এনটিভি অনলাইনকে জানান, পদদলিত হয়ে আরো দুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। নিহতদের স্বজনেরা মৃত্যুর পর প্রশাসনকে না জানিয়েই লাশ বাড়িতে নিয়ে দাফন করেন। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের নাম : নুরানী জর্দা ফ্যাক্টরির মালিক শামীম তালুকদার, তাঁর ছেলে হেদায়েত তালুকদার, কারখানার ব্যবস্থাপক ইকবাল হোসেন, আরমান হোসেন, আলমগীর হোসেন, আরশাদুল, চালক পারভেজ ও কর্মচারী আবদুল হমিদ। মামলার পর তাঁদের ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন কোতোয়ালি থানার ওসি কামরুল ইসলাম।
তদন্ত কমিটি : এদিকে হতাহতের ঘটনায় পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজি) নির্দেশে ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি শফিকুল ইসলামকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মল্লিকা খাতুনকে প্রধান করে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আ ন ম ফয়জুল হক ও এনডিসি তৌহিদুল ইসলামকে সদস্য করে আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। উভয় কমিটিকে আগামী মঙ্গলবারের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
আর্থিক সহায়তা : এ ঘটনার খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী, পুলিশ সুপার মঈনুল হক দুর্ঘটনাস্থল ও হাসপাতাল পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শন শেষে মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী জানান, সঠিক পরিচয় নির্ণয়ের পর প্রত্যেক মৃতের জন্য ১০ হাজার ও আহতদের পরিবারকে পাঁচ হাজার টাকা করে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া হবে।
এ ছাড়া ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমানের পক্ষ থেকে নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।