একদিকে তদন্ত, অন্যদিকে মন্ত্রণালয়ের সাফাই
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/07/16/photo-1437053532.jpg)
কিছুদিন আগেই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘সচিবের কাছে অপমাণিত হয়ে’ মুক্তিযোদ্ধার আত্মহত্যার খবর প্রকাশিত হয়। একই অভিযোগ করেন ওই মুক্তিযোদ্ধার স্বজনরাও। এর পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটিও গঠন করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। সেই তদন্ত কমিটি গঠনের সাতদিনের মাথায় ওই সচিবের পক্ষে সাফাই গেয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়।
গত ৭ জুলাই মঙ্গলবার রাজধানীর তোপখানা রোডের কর্ণফুলী হোটেল থেকে মুক্তিযোদ্ধা আইয়ুব খানকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি মারা যান। তিনি কীটনাশক পানে আত্মহত্যা করেন বলে ধারণা করা হয়।
আইয়ুব খানের সঙ্গে একটি চিরকুট পাওয়া যায়। তাতে লেখা, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ইউনিট ঘোষণার জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এ হান্নানকে টাকা দিয়েছিলেন তিনি। পরে বারবার আবেদন করার পরও তিনি দক্ষিণ জেলা ইউনিট ঘোষণা করেননি। সচিবের বাসায় গিয়ে টাকা ফেরত চাইলে তিনি গলাধাক্কা দিয়ে অপমান করে তাঁকে বের করে দেন। অপমানে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এম এ হান্নান।
মুক্তিযোদ্ধার আত্মহত্যার খবরটি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই আরো অভিযোগ করে বলেন যে, সচিব এম এ হান্নান একসময় মতিউর রহমান নিজামী-এর একান্ত সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সে জন্য তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধাকে অপমান করার সাহস দেখিয়েছেন।
এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৯ জুলাই এম এ হান্নানের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। যুগ্ম সচিব শেখ মিজানুর রহমানকে এ তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে আত্মহত্যার প্ররোচণার ক্ষেত্রে সচিবের কোনো সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) নথিপত্র পাঠানো হয়।
আজ বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে দাবি করা হয়, ‘বর্তমান সচিব (এম এ হান্নান) এ মন্ত্রণালয়ে যোগদানের পর ইতোমধ্যে প্রায় ৬১টি জেলা ও শতাধিক উপজেলায় নির্মাণাধীন জেলা ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সসমূহ সরেজমিনে পরিদর্শনপূর্বক এ সকল স্থাপনার নির্মাণকাজে ত্রুটি সম্পর্কে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন এবং প্রতিকারের উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছেন। এ ছাড়া এ মন্ত্রণালয়ের কাজের গতি ফিরিয়ে আনার জন্য পূর্বের বহু অমীমাংসিত বিষয়ে তড়িৎ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে যাচ্ছেন।’
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য কর্মকর্তা সুফি আবদুল্লাহিল মারুফের সই করা ওই বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, এম এ হান্নান ‘জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামীর একান্ত সচিব (পিএস) হিসেবে বর্তমান সচিব দায়িত্ব পালনে করেছিলেন বলে অনেকে যে বক্তব্য দিচ্ছেন-তা সম্পূর্ণরূপে অসত্য, ভিত্তিহীন এবং বাস্তবতাবিবর্জিত। বর্তমান সচিব ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদকালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এবং মান্যবর ব্যক্তিত্ব মরহুম শাহ এ এম এস কিবরিয়ার সহকারী একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। উক্ত দায়িত্ব পালনের কারণে জোট সরকারের আমলে তাঁকে বিভিন্নভাবে নিগৃহীত হতে হয়।’
একই সঙ্গে কোনো ‘অসত্য তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কোনো মন্তব্য’ না করতে দেশের মুক্তিযোদ্ধাসহ সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রী কিছু জানেন না
এম এ হান্নানের বিষয়ে আজ গণমাধ্যমে পাঠানো প্রেস রিলিজের বিষয়ে কিছুই জানেন না মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। তদন্তাধীন ব্যক্তির বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কোনো একটা বিচার চলাকালে জজ সাহেবের সামনে তো উভয় পক্ষের উকিলরাই বক্তব্য দেন। তাই না?’
তাহলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কি এম এ হান্নানের পক্ষের উকিলের দায়িত্ব পালন করছে? -এ প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘আপনি যদি তা মনে করেন তাহলে তাই।’
তদন্ত চলাকালে বা তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার আগেই এম এ হান্নান বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে ‘উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছেন’, বিভিন্ন ইস্যুতে ‘তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন’ এই ধরনের শব্দ ব্যবহার তদন্তকে প্রভাবিত করবে কি না তা জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘আমি তো এলাকায় চলে এসেছি। কী লিখেছে আমি জানি না। আচ্ছা খোঁজ নিয়ে দেখি।’
তবে যার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে, সেই সচিব এম এ হান্নান দাবি করেছেন, মন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে (সুপারভিশনে) এই সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে।
সচিব এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ওটা মন্ত্রী লিখেছেন। এটার (সংবাদ বিজ্ঞপ্তি) সাথে ওইটার (তদন্তের) কোনো সম্পর্ক নেই। মন্ত্রী এটা দেখে ফাইনাল করে দিয়েছেন। তারপর পিআরও (তথ্য কর্মকর্তা) এটা পাবলিশ করেছে। যেহেতু ঘটনাটি আমার সাথে ইনভলভড (সংযুক্ত) তাই আমি বিষয়টা নিয়ে খুব বেশি খেয়াল করি না। মাননীয় মন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিতেই পারেন।’
মন্ত্রী এই বিষয়ে কিছু জানেন না বলে এনটিভি অনলাইনকে বলেছেন -জানালে এম এ হান্নান বলেন, ‘আপনারা তো দ্যাখেনই আমি মিডিয়াকে ফেস করি না। আমি খুব বেশি বক্তব্য দিই না। মন্ত্রণালয়ের পক্ষে যা বলার তা মন্ত্রীই বলে থাকেন। নরমালি পিআরও মন্ত্রীকে দেখিয়েই সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠায়। এ ক্ষেত্রেও তাই করার কথা। উনি কেনো এটা বললেন আমি জানি না। হয়তো এলাকায় গিয়েছেন, ব্যস্ত তাই খেয়াল করেননি।’
তদন্তে প্রভাব পড়বে কি না, তা জানতে চাইলে সচিব বলেন, ‘যদি মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় আমার সম্পর্কে কিছু লিখে থাকেন, তাহলে সেটা তদন্তের সাথে সাংঘর্ষিক না। উনি আমার সম্পর্কে যা জানেন, তাই লিখেছেন। এখন কেউ ভালো বললে, যদি আমি দোষী হই তাহলে সেটা তো ঢাকা পড়ে যাবে না তাই না? আমি যদি দোষী হই, তাহলে এই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কিছু যাবে আসবে না।’
‘তবে আমি আমার কর্মজীবনে একবারই একজন মন্ত্রীর পিএস ছিলাম। তিনি হচ্ছেন শাহ এম এস কিবরিয়া। আর কোনো মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর পিএস হিসেবে আমি কাজ করিনি। সম্ভবত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এটাই বলার চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে তদন্তকে প্রভাবিত করার মতো কোনো বিষয় নেই। কারণ আমি যদি অন্যায় করেই থাকি, তাহলে কারো বক্তব্যই সেটাকে ভুল প্রমাণ করতে পারবে না। তদন্তেই প্রকাশ হবে যে অন্যায়টি আমি করেছি কি না। তদন্ত তার নিজের গতিতে চলবে,’ বলেন সচিব।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের তথ্য কর্মকর্তা সুফি আবদুল্লাহিল মারুফ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘দেখুন, তদন্ত যাঁরা করছেন, তাঁরা তাঁদের নিজের গতিতে তদন্ত করবেন। সে ক্ষেত্রে আমাদের কিছু বলার নেই। তবে শাহরিয়ার কবিরসহ অনেকেই অভিযোগ করছেন যে তিনি একসময় মতিউর রহমান নিজামীর পিএস ছিলেন। কিন্তু এই অভিযোগটি যে অসত্য সেই বিষয়টা ক্লিয়ার করতেই আসলে এই সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে।’
এই সংবাদ বিজ্ঞপ্তির কারণে তদন্ত কোনোভাবে প্রভাবিত হবে কি না তা জানতে চাইল তথ্য কর্মকর্তা বলেন, ‘তদন্ত করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আর পুলিশ। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এখানে শুধু এটুকু হাইলাইট করেছে যে উনি এর আগে কোথায় কোথায় কাজ করেছেন। উনি যে মতিউর রহমান নিজামির পিএস ছিলেন না সেটাই শুধু ক্লিয়ার করা হয়েছে।’
তদন্তাধীন ব্যক্তির বিষয়ে এভাবে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া উচিত নয় বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এটা তো কখনোই উচিত নয়। এটা অপ্রাসঙ্গিক। যেহেতু তদন্ত চলছে সে সময় এই ধরনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলে সেটা তদন্তকে প্রভাবিত করার প্রকাশ্য প্রচেষ্টা। ভেতরে ভেতরে আরো কিছু চলছে কি না, তা তো আমরা জানি না। এটা কাঙ্ক্ষিত নয়। এ ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত। আমরা অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধার আত্মহত্যার ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই।’
সুজন সম্পাদক বলেন, ‘সরকারের পলিসি হলো তুষ্ট করার পলিসি। যারাই প্রভাবশালী, প্রতিপত্তিশালী তাদেরকে তুষ্ট করার প্রচেষ্টা চলে। যখন কোনো একটা বিশেষ গোষ্ঠীকে বা বিশেষ পক্ষকে তুষ্ট করা হয়, তখন অন্যদের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই যথার্থ ন্যায় প্রদর্শন করা হয় কি না, সে ব্যাপারে প্রশ্ন ওঠে। তাই সরকারের এই তুষ্ট করার নীতিও কাঙ্ক্ষিত নয়।’