ছাগল ব্যবসায়ী শরিফ ও ফারুকের চোখে অন্ধকার

বরিশাল থেকে ৭৫টি ছাগল কিনে এনে ঈদের এক সপ্তাহ আগে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী আড়তে তোলেন ব্যবসায়ী শরিফ হোসেন। ঈদের আগের দিন পর্যন্ত ছাগল বিক্রি হয়েছে ২৭টি। এখনো বাকি আছে ৪৮টি। ২৭টির মধ্যে ১৫টিই বিক্রি করেছেন কেনা দামে। বাকি ১২টিতে কিছু লাভ হলেও পথের খরচ আর ছাগলের খাবার কিনতে তা শেষ হয়ে গেছে। ৪৮টি ছাগল নিয়ে এখন তিনি বিপাকে পড়েছেন। এলাকায় ফিরত নিলে লোকসান বেশি হবে। তাই এখন নিয়ে এসেছেন যাত্রাবাড়ী থানাধীন কোনাপাড়া এলাকার কনকর্ড মাঠে ছাগলগুলোকে ঘাস খাওয়াতে। কোনো আড়তে আবার ওঠানো যায় কি না, সে চেষ্টা করবেন।
আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় কনকর্ড মাঠে গিয়ে দেখা যায়, অনেক ব্যবসায়ী তাদের অবিক্রীত ছাগল চড়াতে নিয়ে এসেছেন। সেখানেই কথা হয় শরিফের সঙ্গে।
ফারুক হোসেন নামের আরেক ব্যবসায়ী যশোর থেকে ছাগল এনেছেন ৮০টি। বিক্রি হয়েছে ৩৭টি। অবিক্রীত আছে ৪৩টি। যাত্রাবাড়ী ছাগলের হাট থেকে বের করে এখন তিনি ভাবছেন ছাগলগুলো নিয়ে কোথায় যাবেন। রাজ্যের হতাশা তাঁর চোখেমুখে।
কোথায় যাবেন জানতে চাইলে কিছুক্ষণ শূন্যে দৃষ্টি ফারুক বললেন, ‘কই যামু ভাই, নিজেও জানি না।’ ফারুক হোসেনের চেহারার দিকে তাকিয়েই বোঝা গেল গত দুই দিন দানাপানি মুখে দেননি। ভাবছিলেন ঈদের দিন হয়তো দু-একটি বিক্রি হতেও পারে। একটিও বিক্রি হয়নি। বাজার থেকে ছাগলগুলো বের করে মহাসড়ক ধরে হাঁটছেন ফারুক। ঈদের পরদিন আজ দুপুর ১২টায় যাত্রাবাড়ী এলাকায় কথা হয় ফারুকের সঙ্গে।
ছাগলগুলো বিক্রি না হওয়ার ব্যাপারে ফারুক বললেন, ‘এবার মানুষ কোরবানি দেয়নি ভাই, কোরবানি দিলে এত পানির দামে ছাগল বিক্রি হলেও কেউ কিনতে আসেনি কেন?’ তিনি বলেন, কোরবানির পশুর হাটে এবার পশুর জোগান তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল, এটা ঠিক। কিন্তু কোরবানি দেওয়ার মতো লোকের এবার অভাব ছিল বেশি। গতবার বাজারে যত ক্রেতা ছিল, এবার তার তুলনায় অনেক কম ছিল। একই কথা বললেন বরিশালের ব্যবসায়ী শরিফও। তাঁরও একই কথা, এবার বাজারে গতবারের তুলনায় ক্রেতা অনেক কম ছিল।
প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এবার কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ছিল এক কোটি ১৬ লাখের মতো। কোরবানি দেওয়ার লোকের সংখ্যা ধার্য করা হয়েছে এক কোটি চার থেকে ছয় লাখ। এ হিসাবে প্রায় ১০ লাখ পশু উদ্বৃত্ত থাকার কথা।
ছাগলের মতো একই অবস্থা গরুর হাটেও। ঢাকার অন্যতম বড় গরুর হাট ডেমরার সারুলিয়ায় আজও শতাধিক গরু দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন এক প্রত্যক্ষদর্শী। ঈদের দিনের পরে আরো দুদিন পর্যন্ত কোরবানি করা যায়। এ সময়ে হয়তো কেউ গরু বা ছাগল কিনতে আসতে পারেন, এমন আশা নিয়েই এখনো বাজারে অবস্থান করছেন ব্যবসায়ীরা। অন্যান্য বছর কোরবানির ঈদের দিনেও গরু-ছাগল কিনে অনেকে কোরবানি করেন। এবার কম দামে গরু-ছাগল পাওয়ার পরও কেউ তা কিনতে যায়নি।
মৌসুমি ছাগল ব্যবসায়ী শরিফ হোসেন এনটি অনলাইনকে বলেন, ‘প্রতিবছরই কোরবানির দেড়-দুই মাস আগে থেকে বরিশাল জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে গৃহস্থদের কাছ থেকে ছাগল কিনে লঞ্চে বা ট্রলারে করে ঢাকায় এনে বিক্রি করি। খরচ বাবদ দিয়ে প্রতি ছাগলে ৫০০ কিংবা এক হাজার টাকা থাকলেই আমরা সন্তুষ্ট। গত ৮/১০ বছর ধরে এভাবেই ব্যবসা করে আসছি। এবারের মতো কোনো বছরই ধরা খাইনি। যে কয়েকটি ছাগল বিক্রি করেছি, তাতে কোনো লাভ হয়নি।’ তাঁর মতে, গতবার যে ছাগলের দাম ছিল ১০ হাজার টাকা, এবার সেটার দাম সাত হাজার টাকায়ও কেউ কিনছে না।
শরিফ হোসেন বলেন, ‘আমার ৭৫টি ছাগলের মধ্যে অন্তত ২০টি ছাগল আছে, যেগুলোর দিকে কোনো ক্রেতা একবারের জন্যও হাত দিয়ে দেখেনি। শেষ দিন ক্রেতা যা বলেছে, সেই দামেই বিক্রি করেছি। কী করব এগুলো রেখে দিয়ে।’
শরিফ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘কই যামু, কার কাছে নালিশ করমু? সামনের দিনে কীভাবে চলমু। কিছইু মাথায় আসছে না। মাথার ওপর বিরাট দেনার বোঝা।’ তিনি বলেন, ‘নিজের সামান্য পুঁজির সঙ্গে কড়া সুদে দাদন নিয়ে ছাগলগুলো কিনে আনছি। এ ঋণ এখন কীভাবে শোধ করব। এ চিন্তায় মাথায় এলেই আর স্থির থাকতে পারছি না। বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানের কী অবস্থা, সেই খবর তো নেওয়ার সুযোগই নেই।’
খোলা মাঠে ছাগল নেওয়ার ব্যাপারে শরিফ বলেন, ‘বাজারে রেখে এগুলোকে এখন কী খাওয়াব? তা ছাড়া এগুলোকে তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে।’ শরীফুল জানালেন, তাঁর মতো শত শত ব্যবসায়ীরই করুণ দশা এবার। ছাগল ও গরু ব্যবসায়ী সবারই মাথায় হাত।
অপর ব্যবসায়ী মোজাম্মেল জানালেন আরো করুণ কথা। তিনি বলেন, ‘যার কাছ থেকে টাকা এনে ছাগল কিনে ঢাকায় এনেছি, তিনি তো আর তার টাকা মাফ করবেন না। সুদ বা লাভের টাকা হয়তো কিছু কম দিতে পারবো। কিন্তু তার আসল টাকা তো আগে ফেরত দিতে হবে। ছাগল বিক্রি হয়নি। এখন টাকা দেবো কোথা থেকে। আর এ ছাগল এখন আমরা কোথায় নিয়ে যাব? কার কাছে বিক্রি করব? কোথায় রাখব? এ চিন্তাই সর্বক্ষণ মাথায় ঘুরে। গত এক সপ্তাহ ধরে গোসল নেই। তিন ধরে মুখে ভাত দিতে পারছি না। কপালে কী আছে, জানি না।’