সাতক্ষীরা দিয়ে আসছে না ভারতীয় গরু!

ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বিভিন্ন সীমান্ত পথ দিয়ে ভারতীয় গরু দেশে ঢুকছে। কিন্তু সাতক্ষীরা সীমান্ত পথ দিয়ে বর্তমানে কোনো গরুই আসছে না। গত বছর প্রতি মাসে এক লাখ গরু এ পথে দেশে ঢুকত। সেখানে গত আট মাসে এ পথে এসেছে মাত্র ৫৩ হাজার গরু।
স্থানীয় গরু ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, চলতি বছরের বিভিন্ন সময়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাসহ গরু ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিক্ষিপ্ত সংঘাতসহ বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে।
ব্যবসায়ীদের ধারণা, ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের বাংলাদেশে গরুর পাঠানোর নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি এসব বিক্ষিপ্ত সংঘাত ও সম্পর্কের টানাপড়েনও দায়ী।
সাতক্ষীরা সীমান্তের জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, গরু রাখাল ও খাটাল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টদের অনেকের অভিযোগ, সাতক্ষীরা সীমান্তের বিপরীতে দায়িত্বরত বিএসএফের দুটি ব্যটালিয়ন কর্মকর্তাদের কঠোর মনোভাবের কারণে ভারতের গরু আসছে না।
আট মাসে ১৯ বিক্ষিপ্ত ঘটনা, ‘ক্ষিপ্ত বিএসএফ’
গত ৮ জানুয়ারি সাতক্ষীরা সীমান্তের বিপরীতে এক সংঘর্ষে নিহত হন রাশিকুল ইসলাম নামের একজন বিএসএফ সদস্য। বিএসএফ অভিযোগ করে, চোরাচালানের সঙ্গে জড়িতরা এ ঘটনার জন্য দায়ী। তবে ঘটনার পর বিজিবি জানায়, যেসব চোরাচালানি এই হামলা চালিয়েছিল তারা বাংলাদেশি নাগরিক এমন কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি বিএসএফ।
এদিকে এ ঘটনার পরই ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং গত ২ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরা সীমান্তের বিপরীতে ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় এসে গরু পাচার বন্ধে কঠোর নির্দেশ দেন। এরপর থেকেই এই সীমান্তে ভারতীয় গরু আসা বন্ধ হয়ে যায়।
এদিকে এ ঘোষণার পর গত ৫ মার্চ সাতক্ষীরার হিজলদি বিওপির বিপরীতে ভারতের গণরাজপুরে বিএসএফ সদস্যকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করার অভিযোগ ওঠে চোরাচালানিদের বিরুদ্ধে। গত ১১ মার্চ চান্দুড়িয়া সীমান্তের বিপরীতে বিএসএফকে লক্ষ্য করে পাথর ছুড়ে মারার ঘটনা ঘটে। গত ২০ মার্চ কাকডাঙ্গার বিপরীতে তারালিতে, ২৪ মার্চ ভোমরার বিপরীতে ঘোজাডাঙ্গায়, ১২ এপ্রিল বৈকারির বিপরীতে গাবোরডায় বিএসএএফের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। ২৭ এপ্রিল ভারতের খলিসা বিএসএফ ক্যাম্প সদস্যদের গুলিতে তিন ভারতীয় গরু রাখাল নিহত হন। ২৮ এপ্রিল কুশখালি সীমান্তের বিপরীতে ভারতের খলিসায় চোরাচালানিদের হামলায় একজন বিএসএফ সদস্য আহত হন। এ ছাড়া ৫ মে আরো কয়েকজন ভারতীয় নাগরিক বিএসএফের গুলিতে আহত হন। ২১ মে কাকডাঙ্গার বিপরীতে এবং ২৩ মে কেড়াগাছির বিপরীতে বিএসএফ গরু রাখালদের ওপর কয়েকটি গুলি ছোড়ে। অন্যদিকে ১৬ জুন কাকডাঙ্গার সোনাই নদীতে গোসল করার সময় বিএসএফের ছোড়া গুলতির মার্বেলের আঘাতে ইমন হোসেন জনি নামের ১৪ বছর বয়সী এক কিশোর তার একটি চোখ হারায়। একই সময়ে একইভাবে আহত হন আরো দুজন। গত ৯ জুন কালিয়ানি সীমান্তের বিপরীতে দুবলিতে একজন, ১০ জুলাই কাকডাঙ্গার বিপরীতে তারালিতে এবং ২৩ আগস্ট গাজীপুর সীমান্তের বিপরীতে ঘোজাডাঙ্গায় আরো এক বিএসএফ সদস্যের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।
অন্যদিকে গত ২১ জুন সাতক্ষীরার কুশখালি হাইস্কুলের সামনে একটি পাটক্ষেতে আলমগীর হোসেন নামের এক বাংলাদেশি গরু ব্যবসায়ীর গলা কাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২৫ জুন গরু আনতে ভারতে যাওয়ায় হাড়দ্দহার আবু সালেক নামের এক যুবককে ভারতীয়রা পিটিয়ে হত্যা করে লাশ ফেলে রাখে। ঘটনার দুদিন পর সালেকের গলিত লাশ ফেরত দেয় বিএসএফ। গত ২ জুলাই ভারত থেকে গরু নিয়ে ফেরার পথে ইছামতি নদীতে বিএসএফের রিভার উইংয়ের সদস্যরা গরুর রাখাল রুবেলের ওপর স্পিডবোট চালিয়ে দেয়। পরে বিএসএফের নির্যাতনে রুবেলের মৃত্যু হয়।
৭ জুলাই গরু নিয়ে ভারত থেকে ফেরার সময় চান্দুড়িয়ার বিপরীতে ভারতের কালাঞ্চীতে ধরা পড়ে তিন বাংলাদেশি। তাঁদের মারধর করে ফেলে রেখে যায় বিএসএফ। স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁদের উদ্ধার করে। এ ছাড়া গত ১০ জুলাই কুশখালি সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশি গরু রাখাল মুকুল হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। স্থানীয়রা এ ব্যাপারে বিএসএফকে দায়ী করলেও বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) বিএসএফের বরাত দিয়ে জানায়, এই হত্যার সঙ্গে বিএসএফ জড়িত নয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাটাল মালিকসহ গরু ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সাতক্ষীরা সীমান্তে এত ঘটনার কারণে বিএসএফ গরু ব্যবসায়ীদের ওপর ক্ষেপে আছে। যে কারণে বাংলাদেশের কোনো গরু রাখালকে দেখলেই গুলি করার চেষ্টা করছে তারা। অপরদিকে বিজিবিও বাংলাদেশের কোনো নাগরিককে ভারতে গিয়ে গরু আনতে নিষেধ করে দিয়েছে। এ বিষয় নিয়ে সীমান্তে বিজিবি দফায় দফায় সচেতনতামূলক সমাবেশ করেছে। এ কারণে গরু আনতে কেউ ভারতে যাচ্ছে না। ফলে গরুও আসছে না।
খরচ পড়ছে বেশি
সদর উপজেলার বৈকারি ইউনিয়নের খাটাল মালিক অসলেহ উদ্দিন বলেন, গরু আমদানিতে শুল্কসহ বিভিন্ন বিষয়ে খরচ পড়ছে বেশি। আইন অনুযায়ী ভারত থেকে গরু আনার ক্ষেত্রে গরু প্রতি ৫০০ টাকা শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে।
কিন্তু সত্যিকার অর্থে প্রতি গরুর পেছনে শুল্কবাবদ খরচ পড়ে তিন হাজার টাকা। কোনো কাগজপত্রে বাকি আড়াই হাজার টাকার হিসাব নেই।
একই কথা জানিয়ে ঘোনা ইউনিয়নের খাটাল মালিক ফজলুর রহমান বলেন, ‘তিন হাজার টাকা শুল্ক দেওয়ার পাশাপাশি রাখালকে দিতে হয় দুই হাজার টাকা। এক গরুতে খরচ পড়ছে পাঁচ হাজার টাকা। এরপর আছে ঘাটে পারাপার আবার পরিবহন খরচ। দেশে পৌঁছাতে সব মিলিয়ে গরু প্রতি খরচ হয় প্রায় আট হাজার টাকা।
সীমান্তে বিভিন্ন ঘটনার পাশাপাশি এ রকম খরচের কারণেও গরু আমদানিতে ব্যবসায়ীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন বলে জানালেন খাটাল মালিকসহ একাধিক ব্যবসায়ী। খাটাল মালিকরা আরো জানান, দেশে আনার পর ভারতের গরু বিভিন্ন খাটালে রাখতে হয়। গরু না আসায় এর প্রভাব পড়ছে খাটাল ব্যবসা ও ব্যবস্থাপনাতেও।