বেবিচক দুর্নীতির আখড়া, দুদকের প্রতিবেদন

উড়োজাহাজ কেনা ও ইজারাসহ বিভিন্ন কেনাকাটায় ব্যাপক দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বিমানের রক্ষণাবেক্ষণ ও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণেও অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণ রয়েছে এ সংস্থাটির হাতে।
দুদকের একটি প্রতিবেদনে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে (বেবিচক) দুর্নীতির আখড়া হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঠিকাদাররা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বড় অঙ্কের ঘুষ দিয়ে কাজ বাগিয়ে নেয়। গত ৩ মার্চ কমিশনের পক্ষ থেকে বিমানের দুর্নীত ও অনিয়মের এ বিবরণ বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান লিখিতভাবে বিমানের এ দুর্নীতির বিবরণ প্রতিমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন। ওই প্রতিবেদনের একটি কপি এনটিভি অনলাইনের হাতে এসেছে।
উড়োজাহাজ কেনায় ব্যাপক দুর্নীতি
উড়োজাহাজ কেনায় দুর্নীতির বিষয়ে দুদকের এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিমান, বিমানের যন্ত্রাংশ, গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং ইকুইপমেন্টসহ বড় অনেক কেনাকাটা এবং বিমান ইজারার ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি হয়ে থাকে। কিছু মধ্যস্বত্বভোগী প্রতিষ্ঠান এবং বিমান সংস্থার সঙ্গে লিঁয়াজো করার নামে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কতিপয় বোর্ড ডিরেক্টরকে অনৈতিকভাবে ‘কনভিন্স’ করে পরস্পর যোগসাজসের মাধ্যমে মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেয়। বড় অঙ্কের অর্থ লগ্নি করে এসব ফার্ম দরপত্রের স্পেসিফিকেশন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এমনভাবে নির্ধারণ করে যাতে পছন্দসই কোম্পানি কাজ পায়। প্রাক্কলিত মূল্য প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দেখানোর ব্যবস্থা করে দেয়। ফলে নিম্নমানের উপকরণ দুই থেকে তিনগুণ দামে কিনতে হয়। বিমানের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং বোর্ড ডিরেক্টর এসব ফার্মের সঙ্গে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে মালিক বা অংশীদার হিসেবে রয়েছেন।
বিমান ইজারায় দুর্নীতি
বিমান ইজারায় দুর্নীতির বিবরণ দিয়ে দুদকের এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিমান ইজারার ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগী ফার্ম কর্তৃক এমন শর্তে বিমান ইজারা নেওয়া হয় যে, বাংলাদেশ বিমানকে হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়। ইঞ্জিন পরীক্ষাসহ আনুষঙ্গিক বিষয়াদি যাচাই-বাছাই না করেই উড়োজাহাজ ইজারা নেওয়ার ফলে মেয়াদ শেষে হাজার কোটি টাকা দিয়ে নতুন ইঞ্জিন প্রতিস্থাপন করে উড়োজাহাজ ফেরত দিতে হয়েছিল। এমনভাবে দরপত্র আহ্বান করা হয় যে, যখন ভালো কোম্পানির হাতে ইজারা দেওয়ার মতো বিমান থাকে না। বাধ্য হয়ে বেশি মূল্যে অসাধু ব্যক্তিদের পছন্দের কোম্পানি থেকে নিম্নমানের বিমান ইজারা নিতে হয়। এসব বিষয়ে প্রতিবছর অভ্যন্তরীণ ও সরকারি নিরীক্ষাদল কর্তৃক অজস্র আপত্তি প্রদান করা হলেও শেষ পর্যন্ত তা অনিষ্পন্নই থেকে যায়।
রক্ষণাবেক্ষণে দুর্নীতি
রক্ষণাবেক্ষণ ও ওভারহোলিং খাতে দুর্নীতির বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিমান এবং গ্রাইন্ড হ্যান্ডলিং ইকুপমেন্ট রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনাকাটায় শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি হয়ে থাকে। বিমানের বোর্ড ডিরেক্টর ও কর্মকর্তারা নিজেরা লাভবান হওয়ার জন্য তাদের পছন্দসই প্রতিষ্ঠানকে ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ করে কার্যাদেশ প্রদান করে থাকেন। নিম্নমানের যন্ত্রাংশ অতি উচ্চ মূল্যে ক্রয় দেখিয়ে ঠিকাদার ও প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশ করে টাকা আত্মসাৎ করা হয়। তা ছাড়া বিমান রি-চেকের জন্য তাদের পছন্দসই বিদেশি প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ করে অতি উচ্চ মূল্যের বিল দেখিয়ে ভাগাভাগির মাধ্যমে টাকা আত্মসাৎ করা হয়।
এ ছাড়া বিমানবন্দরে টাওয়ার, বোডিংব্রিজসহ বড় বড় ক্রয়েও ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে দুদকের প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, ঠিকাদাররা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বড় অঙ্কের ঘুষ দিয়ে এসব কাজ বাগিয়ে নেয়।
স্থাপনা নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজে দুর্নীতি
বিমানবন্দরের স্থাপনা নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজ সম্পর্কিত খাতকে দুর্নীতির আখড়া হিসেবে উল্লেখ করে দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ খাতটি বেবিচকে দুর্নীতির আখড়া হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এখানকার ইঞ্জিনিয়ারদের বিদেশে একাধিক বাড়ি রয়েছে। কাগজপত্র ঠিক রেখে কাজের কোয়ালিটি কমপ্রোমাইজ করে যেনতেনোভাবে কাজের মাধ্যমে ঠিকাদার ও ইঞ্জিনিয়াররা অর্থ ভাগবাটোয়ারা করে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। দু-একজন সৎ ও দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার থাকলেও অসৎদের দাপটের কাছে তারা অসহায়।
প্রতিবেদনে বিমানবন্দরের স্পেস ও স্লট এবং বিলবোর্ড ভাড়া প্রদানেও ব্যাপক দুর্নীতি হয় বলে অভিযোগ আনা হয়েছে। বিমানবন্দরের দোকানসহ অন্য স্থাপনাগুলো বেবিচকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মালিকানায় রয়েছে বলেও অভিযোগ আনে দুদক।
বিমান মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য
দুর্নীতি দমন কমিশনের এ প্রতিবেদনের বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মহিবুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এনটিভি অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিবেদনটি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। এ প্রতিবেদনের আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও আমরা গ্রহণ করেছি।’
সচিব বলেন, ‘দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম অঙ্গীকার। আমাদের মন্ত্রণালয়ের অধীন সব সংস্থাকেই আমরা দুর্নীতিমুক্ত করে সেবার মান আরো বৃদ্ধি করতে বদ্ধপরিকর। এরইমধ্যেই আমরা বেশকিছু পদক্ষেপও হাতে নিয়েছি। ’
মহিবুল হক বলেন, ‘বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ এবং বিমানবন্দরগুলোর সঙ্গে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ জড়িত। এটা মাথায় রেখেই আমরা প্রতিবেদনটি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি যাতে বিমানবন্দরে সেবার মান বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে গোটা বেবিচক দুর্নীতিমুক্ত হয়।’
এদিকে বিমানমন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, দুদকের প্রতিবেদন দাখিলের পর অনেকটা নড়েচড়ে বসেছে মন্ত্রণালয়। গঠন করা হয়েছে উচ্চ পর্যায়ের দুটি কমিটি। প্রতিবেদনের আলোকে বেবিচকের দুর্নীতির উৎসগুলো এবং দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের চিহ্নিত করতে এ কমিটিগুলো এরইমধ্যে কাজ শুরু করেছে।