হালখাতা ও পঞ্জিকার কদর নেই, বিক্রি হয় না

‘লাল কাপড়ে মোড়ানো হালখাতায় মানুষের এখন আগ্রহ একেবারেই নেই বললেই চলে। দোকানে বসে আছি কিন্তু ওই ধরনের খাতা কিনতে কেউ আসে না। আমাদেরও এ নিয়ে এখন তেমন কোনো ভাবনা নেই। এখন সব হিসাবই মানুষ কম্পিউটারে সংরক্ষণ করে।’
এনটিভি অনলাইনকে এভাবেই বলছিলেন দেশের প্রকাশনা জগতের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাবাজারের মেসার্স ‘প্রিয় প্রাঙ্গণ স্টেশনারির’ মালিক মোহাম্মদ আলামিন।
আলামিন বলেন,‘বাকি বকেয়া বিক্রিও এখন আর আগের মতো নেই। আগাম টাকা দিয়ে ক্রেতাদের ব্যবসায়ী বা বিক্রেতাদের কাছ থেকে মালপত্র কিনে নিতে হয়। ফলে এখন আর হালখাতার প্রয়োজন খুব একটা হয় না।’
আলামিন বলেন, ‘আগে আমরা বাংলা নববর্ষ বৈশাখ উপলক্ষে নানা সাইজের বিভিন্ন ধরনের হালখাতা তৈরি করে দোকানে টালি করে রাখতাম। ফাল্গুন ও চৈত্র মাসের শুরুতেই খুচরা বিক্রেতারা এসে টালি দেওয়া হালখাতা কিনে নিয়ে যেত। পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানের অনেক বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লোকজনও আসত খাতা নিতে। এখন আর কেউ আসে না। খবরও নেয় না কেউ। মাঝেমধ্যে দুই একজন আসে নিতে।’
নিজের দোকানের সাজানো হালখাতাগুলোর দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে আলামিন বলেন, ‘এই যে দেখুন এখানে কিছু খাতা বানিয়ে রেখেছি। মনে মানে না। যদি কেউ চায়। এজন্যই রাখা আর কি। আসলেই এগুলোর এখন আর কোনো চাহিদা নেই।’
দুদিন ধরে বাংলাবাজারসহ আশপাশের প্রকাশা সংস্থাগুলো সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা গেছে শত শত দোকানের মধ্যে মাত্র দু-একটিতে লাল সালু কাপড়ে মোড়ানো মোটা মোটা বলিউমের বিভিন্ন সাইজের খাতা রয়েছে। কিন্তু কোনো ক্রেতা নেই এগুলোর জন্য।
হালখাতার বেচাবিক্রি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিক্রেতা লোকমান আহমেদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আগে এক সময় প্রচুর বিক্রি হতো। কয়েকবছর ধরে এগুলোর বেচাবিক্রি একদমই নেই। বেচাবিক্রি কম হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখজন মানুষ কম্পিউটারেই হিসাব সংরক্ষণ করে। তা ছাড়া আমাদের জানামতে বড় বড় আড়ৎদার ও ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসার ধরন পাল্টেছে। এখন নগদ বিক্রি হয় বেশি। সবচেয়ে বড় কারণ হলো এখন ব্যবসা, আর্থিক লেনদেন ও হিসাব-নিকাশ সবই হয় জাতীয় বাজেট কেন্দ্রিক।’
লোকমান আহমেদ বলেন, ‘এখন মানুষের হিসাব-নিকাশ হয় ইংরেজি সাল অনুযায়ী। বাংলা সালের হিসাব এখন একেবারেই নাই বললেই চলে। ফলে পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ব্যবসার হিসেবের সঙ্গে কোনো মিল নেই। এটা এখন শুধু একটা অনুষ্ঠান নির্ভর দিবস হয়ে গেছে। বকেয়া আদায় ও হালখাতায় নতুন হিসাব খোলার রেওয়াজ এখন আর নেই। ফলে এখন পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানের সাথে হালখাতা বা নতুন ব্যবসার কোনো সম্পর্ক বাকি নেই।’
তাঁতিবাজারে চোখে পড়ে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের ব্যস্ততা। সেখানেও তেমন কোনো আয়োজন চোখে পড়েনি।
আকাল চলছে বাংলা পঞ্জিকা বিক্রিতেও
হালখাতার পাশাপাশি আগে পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে বাংলা পঞ্জিকার ব্যাপক কদর ছিল। প্রতি বাংলা নববর্ষে একটি করে বাংলা পঞ্জিকা সংগ্রহ করত মানুষ। বাংলাবাজারসহ আশপাশের প্রকাশনা সংস্থা ও বইয়ের লাইব্ররিগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, লাইব্রেরিতে কিছু পঞ্জিকা থাকলেও এগুলোর ক্রেতার সংখ্যা একেবারেই নেই।
ঢাকা টাউন লাইব্রেরির মালিক অপু মল্লিক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এবার বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে কিছু পঞ্জিকা প্রকাশ করেছিলাম। বেচাবিক্রি একেবারেই নেই। সবই অবিক্রিত রয়েছে। আগামী বছর হয়তো আর ছাপাবই না। ছাপিয়ে যদি বিক্রিই না হয়, তাহলে অনর্থক লোকসান দেওয়ার তো কোনো মানে হয় না।’
পঞ্জিকা বিক্রিতে ভাটার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে অপু মল্লিক বলেন, ‘এখন সবই চলে ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। বাংলা নববর্ষের গুরুত্ব শুধু পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ। এর বাইরে বছরের অন্যান্য দিন বাংলা সনের কোনো গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা নেই বললেই চলে। এ কারণেই পঞ্জিকা বিক্রি নেই।’
অন্যান্য বছর ঢাকা টাউন লাইব্রেরি অনেক ধরনের পঞ্জিকা প্রকাশ করলেও এবার শুধু লোকনাথ পঞ্জিকা ও মোহাম্মদী পঞ্জিকা নামে দুটি পঞ্জিকা প্রকাশ করেছে। বেচাবিক্রি সম্পর্কে জানতে চাইলে অপু বলেন, ‘কোনো বেচাবিক্রি নেই। আগামীতে আর প্রকাশ করব না।’