নগরে শতবর্ষী মেরাদিয়া হাট!

‘হাট বার’ মানেই তো গ্রামের গল্প। কোনো এক বটগাছকে ঘিরে হয়তো বসা বিশাল কোনো বাজার। নগর জীবনে এমন ‘হাট বার’ শব্দটিই তো বিলীন। আর যদি সেটা হয়ে থাকে ঢাকার মতো মহানগরীতে! এখানে হাট বার বা হাট বসার গল্প ভাবাটাও কঠিন। তবে এই বিলীন হয়ে যাওয়া গল্পটি এখনো বেঁচে আছে মেরাদিয়া হাটকে ঘিরে ।
যারা না জানে তারা অনেকেই অবাক হবে এই হাটবারের গল্প শুনে। রামপুরা বনশ্রীতে প্রতি বুধবার হল হাটবার। মেরাদিয়া এলাকাতে বসছে মেরাদিয়া হাট। শাক সবজি ফল থেকে শুরু করে মাটির তৈজসপত্র, জামা-কাপড়, খেলনা, খাবার, পশু-পাখি সবই পাওয়া যায়। বুধবার এই হাটকে ঘিরে প্রচুর মানুষের সমাগম ঘটে এখানে। দূরদুরান্ত থেকেও আসে হাটুরেরা। সাজিয়ে বসে বেঁচা-বিক্রির পসরা।
এই হাটের বয়স কত তা ঠিক করে বলতে না পারলেও স্থানীয়দের ভাষায় প্রায় দেড়শ থেকে দুইশ বছর হবে। যদিও নির্দিষ্ট করে কবে থেকে এই হাট বসছে এখানে তা বলতে পারছে না কেউ। স্থানীয় অনেকেই বলেন প্রায় দুইশ বছর আগে এই হাট বসতে শুরু করে। ব্রিটিশ আমলেও এই হাট বেশ জমজমাট ভাবে বসত। নড়াই নদীর তীড়বর্তী এই স্থানটিতে একটি বড় বটগাছ এবং তার পাশে বিশাল এক পুকুর ঘিরেই বসতে শুরু করে হাট। দূর দূরান্ত থেকে নৌকায় করে হাটুরেরা আসত এই মেরাদিয়া হাটে।
কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা আমির আলীর সঙ্গে। তাঁর বয়স ৭৫ বছর। হাটের অতীতের কথা বলতে গিয়ে তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এই হাটের বয়সতো দেড়শো বছর হবেই। আমার বাপ দাদারাও এই হাটে নিয়মিত আসতেন। আমার বাপের একটা মুদির দোকান ছিল। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন থেকেই এই হাট দেখে আসছি। তখন অনেক জমজমাট ছিল। অখনত আর ওই দৃশ্য নাই। হাট জমে ঠিকই কিন্তু হাটের চেহারা বদল হইয়া গেছে।’
আমীর আলী বলেন, ‘এইখানে পাহাড়ের মতো বিশাল এক বটগাছ ছিল। রাতে দেখলে ভয় লাগত। অনেকে কইতো জ্বিন পরী আছে। ভয়ে আমরা আসতাম না অন্য সময়। বুধবার ওই বট গাছের চারিপাশেই বসত এই হাট। বেশ শান্তি আছিল। অখন তো সেই গাছ নাই। আছে বড় বড় বিল্ডিং। হাটের মজাটাও আগের মতো নাই।’
৬৫ বছর বয়স্ক রুহুল আমিনের মতে এই হাটের বয়স দুইশ বছর পার হয়েছে। তিনি জানান, প্রথম থেকেই এই হাট বুধবারে বসত। অনেক দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসত এই হাটে।
রুহুল আমিন বলেন, ‘আমার দাদার বাপে এই হাট করছে ( হাটে আসত), দাদায় করছে, বাবায় করছে, অহন আমি করি...। নড়াই নদী অনেক বড় ছিল। পানি ছিলো পরিস্কার। শত শত নৌকা আসত হাটে। অখন তো আর সেই দিন নাই। আগে আশপাশে আর কোনো বাজার হাট ছিল না। সবাই আসত এইখানে।’
তাঁদের কথার রেশ ধরেই হাটে ঘুরতে ঘুরতে বেড়িয়ে এলো সেই সময় আর এই সময়ে চিত্রের ফারাক। যে বটগাছ ঘিরে মেরাদিয়া হাট বসার গল্প শোনা যায়। সেই বট গাছটি নেই। বড় বড় গাছপালারও কোনো সমারোহ নেই। তার বদলে এখন বড় বড় ভবন। যে নড়াই নদীর কথা বলা হয়, যার বুক চিরে শত শত নৌকা নিয়ে আসত হাটুরে ও ক্রেতারা। সেই নদীও এখন খালে পরিণত হয়েছে। বিষাক্ত কালো পানি বুকে নিয়ে সেই নদী এখন রামপুরা খাল নামেই পরিচিত। যার তীর ধরে যত দূর চোখ যাবে আবর্জনার স্তূপ। এখনো এর পাশেই বসছে এই হাট।
রামপুরা বনশ্রীর মেরাদিয়া বাজার ঘেঁষে বসে এই হাট। প্রধান সড়কের দুই পাশে, বাজের পাশে খোলা জায়গায়, রাস্তার পাশে গলির ভেতর ঢুকে হাটুরেরা তাদের পসরা সাজিয়ে বসে। সকাল থেকে শুরু হয়ে রাত পর্যন্ত সরব থাকে এই মেরাদিয়া হাট।
সকাল থেকে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত, শত বছর পার করেও সরব এই হাট। সময় গড়াতে গড়াতে এক সময় কমে আসে ব্যস্ততা। হাটুরেরা ফিরতে শুরু করে সারাদিনের হিসাব মেলাতে মেলাতে। বিভিন্ন এলাকা থেকে দল বেধে আসা হাটুরেরা ফিরতে শুরু করে নানা ধরনের যানবাহনে করে। অনেকে আবার নৌকায় করে ফেরার পথ ধরে। মৃত প্রায় নদীটির বুক চিরে মহানগরীর বুকে জেগে থাকা মেরাদিয়া হাটের গল্প নিয়ে জলের বুকে রেখা একে ফিরতে থাকে হাটুরেদের নৌকা।