নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে শেখ হাসিনা পালানোর ছয় মাস
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2025/02/05/naarkiiy_htyaayjny.jpg)
১৫ বছরে হত্যা, নির্যাতন, গুম-খুন ও দেশের মানুষের কণ্ঠরোধ করে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার ছয় মাস পূর্তি আজ। আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জুলাই-আগস্টের হত্যা মামলায় প্রধান আসামি হিসেবে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হলেও কোনো অগ্রগতি নেই। বরং নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে পালানোর পর গত ছয় মাস ধরেই ভারতে আশ্রয়ে রয়েছে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। সেখানে বসেই পরিচালনা করছেন রাজনৈতিক কার্যক্রম। এখনও অনলাইনে ভার্চুয়ালি মিটিং করে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। মোবাইলে নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে।
আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মো. তাজুল ইসলাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘‘দেশের সকল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেশের মানুষের সকল মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়েছিল শেখ হাসিনা। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বল প্রয়োগ করে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। এ ছাড়া গত ১৫ বছরে গুম-খুন, আয়নাঘর তৈরিসহ ভারতের সঙ্গে বহু দেশবিরোধী চুক্তি করেছিল শেখ হাসিনা। তিনি আরও বলেন, জুলাই-আগস্টের দেশের বিচার বিভাগ ও প্রশাসনকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল শেখ হাসিনা। ১৫ বছরে তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পায়নি।’’
জানুয়ারির শেষে দিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এর প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে প্রায় দুই হাজারের কাছাকাছি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এ সময়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বাহিনীর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্তের মুখোমুখি করার ঘটনা নেই বললেই চলে। তদন্তকালীন বেআইনি মৃত্যু ঠেকাতে প্রয়োজনে মিনেসোটা প্রটোকল অনুসরণ করে অন্তর্বর্তী সরকারকে নতুন নিয়ম প্রতিষ্ঠা করতে সুপারিশ করা হয়েছে।
যেভাবে স্বৈরাচারের মসনদ তৈরি করেন শেখ হাসিনা
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন শেখ হাসিনা। নানা আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে মইন ইউ আহমেদ ও ফখরুদ্দিনের কাঁধে ভর করে মসনদে বসেন তিনি। তারপর থেকেই খুলে ফেলেন তার নতুন মুখোশ। শুরু করেন বিরোধীদল ও মতকে দমন। এতে ব্যবহার করেন বিচার বিভাগকে। একইসঙ্গে রাজপথের আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে দিয়ে বল প্রয়োগ, মামলা, হামলা, গুম, হত্যার পথ বেছে নেন তিনি। ২০১৪ সালে বিনা ভোটে গদি টিকিয়ে রাখেন শেখ হাসিনা। ২০১৮ সালে দিনের ভোট করেন রাতে। প্রশাসনের সব স্তরকে ব্যবহার করে ভোট জালিয়াতি, ভোট ডাকাতি ও মরা ব্যক্তির ভোটে ক্ষমতায় এলেও ২০২৪ সালের নির্বাচন খ্যাতি পায় ডামি নির্বাচন নামে। এভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে অবস্থান টিকিয়ে রাখা শেখ হাসিনা হয়ে ওঠেন একগুঁয়েমি, বেপরোয়া, অহঙ্কারী, হিংস্র ‘ওয়ানম্যান আর্মি। এই অহঙ্কারের আগুনে পুড়ে অবমূল্যায়িত হন দলীয় জ্যেষ্ঠ নেতারাও।
যদিও ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির ডামি নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার বেপরোয়া একগুঁয়েমিতাই তার জন্য হয়ে ওঠে কাল। সাত মাস পূর্তির আগেই পালিয়ে যেতে বাধ্য হন তিনি। তবে, জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দলীয় কর্মীদের ব্যবহার, বাহিনীকে দিয়ে হত্যা-দমনের মাধ্যমে ক্ষমতা আকড়ে পড়ে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন তিনি, তারপরও হয়নি শেষ রক্ষা!
শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বের এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তার হিংস্রতার বিশদ বর্ণনা উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায়।
গত ১৭ অক্টোবর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনের চেষ্টায় গণহত্যার দুই অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তন্মধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে পৃথক একটি মামলা এবং ওবায়দুল কাদেরসহ অন্যদের বিরুদ্ধে পৃথক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গত ১৫ বছরে সেনাবাহিনীকে ধ্বংসে পিলখানা হত্যাকাণ্ড, পিতৃহত্যার প্রতিশোধে ছিলেন মরিয়া, ভিন্ন মত দমন, ট্রাইবুনাল,,জামায়াত দমনে প্রোপাগান্ডা, গণজাগরণ মঞ্চ ব্যবহার, ইসলামি চেতনা দমন, রিজার্ভ চুরি, সাগর-রুনিসহ সাবাদিকদের হত্যা, প্রধান বিচারপতিকে, অপসারণ, ২০১৪ সালে এক তরফা নির্বাচন, ২০১৮ সালের নির্বাচনে রাতের কাণ্ড, ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচন, নির্বাচনের আগে সাজা দিয়ে খালেদা জিয়াকে কারাগারে প্রেরণ, ভয়ভীতি, গুম-খুনের রাজনীতি, জুলাই-আগস্টে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়।
যেভাবে পতন আসে শেখ হাসিনার
জুলাই-আগস্টে গণহত্যা
কোটাবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর জুলাই-আগস্টে গণহত্যা চালানো হয়। রংপুরে আবু সাঈদকে সরাসরি গুলি করে হত্যা করা হয়। যে ভিডিও দেখে সারা বিশ্বের মানুষ কেঁদেছে। হত্যাকাণ্ডের পরিণতি এত ভয়াবহ ছিল মানুষ এখনও আঁতকে ওঠে। এ হত্যাযজ্ঞ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা এতটা নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছে যে, ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে ছাই করে ফেলে। ছাত্র-জনতাকে হত্যার পর এপিসোড গাড়ি থেকে ফেলে দেওয়া হয়। এ ছাড়া সামনে দাঁড় করিয়ে বুকে মাথায় গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়। আন্দোলন কেন্দ্রিক হাজারও ছাত্র-জনতাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়।
পতন তরান্বিত
দেশের ভেতরে আওয়ামী লীগ একা হয়ে পড়েছিল। দীর্ঘ শাসনে সবাইকে খেপিয়ে তুলেছিলেন শেখ হাসিনা। তাঁর সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ও অর্থনীতির মন্দা পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। আর রাজনৈতিক দিক থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের বাইরে অন্য সব দল সরকারবিরোধী অবস্থানে চলে যায়। এর ফলে শেখ হাসিনা রাজনৈতিক দিক থেকেও একা হয়ে পড়েন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনেও সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে ভূ-রাজনীতিতে শেখ হাসিনার সরকার ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পরপর তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন করেও টিকে থাকে। এই আলোচনা চলছিল অনেক দিন ধরে। সরকার চীনের সঙ্গেও একটা সম্পর্ক রেখে চলছিল। গত জুলাই মাসেই ৭ তারিখ থেকে দুই দিন চীন সফর করেছিলেন শেখ হাসিনা। সর্বশেষ সেই সফরে অবশ্য ভালো ফল হয়নি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিল অনেক দিন ধরে। বিভিন্ন সময় শেখ হাসিনাসহ তাঁর নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করেন। সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন বেড়ে যায়। তবে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ দেশের মানুষ ও শিক্ষার্থীদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলে। এতে একেবারে একা হয়ে পড়েন তিনি ও তার সরকার।
শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার লড়াই, অবশেষে পলায়ন
শেখ হাসিনার পলায়নের ৩৬ দিন আগে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে মাঠে নেমেছিলেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু শেখ হাসিনার একগুয়েমি, অহঙ্কার আর প্রতিশোধ পরায়ণতা শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি পর্যবেক্ষণ থেকে দূরে রেখেছিল। এমনকি, তিনি ছাত্রছাত্রীদের দমনে তাদের পেছনে লেলিয়ে দেন তার প্রশাসনকে। নামিয়ে দেন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ সহযোগী সংগঠনগুলোকে। কিন্তু তাতে সারা দেশে সংঘাত–সংঘর্ষে শত শত জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এরপরও শক্ত হাতে দমনের কথা বলা হয়।
জানা যায়, পতনের আগের দিন ৪ আগস্ট রোববার সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গণভবনে বসে শেখ হাসিনা তাঁর সরকারের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন মন্ত্রী ও কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতা জানিয়েছেন, রোববারও সরকারের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। এরপরও পরিস্থিতি তাঁদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে তাঁরা ধারণা করেছিলেন। কিন্তু চাপ আরও বাড়তে থাকে। গতকাল সকালেই তাঁরা বুঝতে পারেন, তাঁদের সময় শেষ হয়ে গেছে। এরপর শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ৫ আগস্ট পালিয়ে যান ভারতে। যদিও ক্ষমতা ছেড়ে গেলেও প্রতিশোধের আগুনে তারই পেটোয়া বাহিনী পুলিশের হাতে তখনও জীবন দেন আরও অনেককে।
ভারত ছাড়া আশ্রয় মেলেনি কোথাও
এক সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘ভারতকে যা দিয়েছি সেটি তারা সারা জীবন মনে রাখবে।’ এর আগেপরে তার ভারতপ্রীতি নিয়ে ছিল আলোচনা, সমালোচনা, অভিযোগও। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ ভারতেই আশ্রয় নেওয়ার পর এটি ফের সামনে আসে। পরে জানা যায়, গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে অন্তত ২০টি চুক্তি ও ৬৬টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। অন্তবর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দাবি, এসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের অধিকাংশতেই উপেক্ষিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বার্থ। এভাবেই তিনি সেখানে থেকে গেছেন। যদিও যুক্তরাজ্যে যেতে চেয়েছিলেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর চাউর হয়। তবে, সেখানের তথ্য বলছে, দেশটি তাঁকে নিতে রাজি হয়নি। পরে দুবাইয়ের নামও আসে তালিকায়। বিভিন্ন সূত্রের তথ্য, আরব আমিরাতের এই রাজ্যটিও শেখ হাসিনাকে নিতে অস্বীকৃতি জানায়।