রঙিন চকে নারীদের স্বপ্নের গল্প

কালের পরিক্রমায় হারাতে বসেছে অনেক ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প। তবে কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার আলামপুর ইউনিয়নের দহকুলা বাগান পাড়ার একদল নারী এখনো ধরে রেখেছেন এক অনন্য শিল্প— হাতে তৈরি রঙিন চক। এই ছোট্ট গ্রামটির ‘জুনাইদ চক ফ্যাক্টরি’ এখন ২৮ নারীর জীবনের রঙিন স্বপ্নের ভিত্তি হয়ে উঠেছে।
সাদা চকের সীমা ছাড়িয়ে রঙিন চকের জগতে পা রেখেছেন তারা। একসময় চক মানেই ছিল সাদা, যা স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে বা কারিগরি কাজে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেই একঘেয়েমি সাদা রঙের বাইরে বেরিয়ে এখন এসেছে রঙিন চক। দহকুলা বাগান পাড়ার এই ছোট্ট ফ্যাক্টরিতে তৈরি হচ্ছে নানা রঙের চক। যা শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই নয়, শিল্পকর্ম ও সৃজনশীল কাজেও ব্যবহার হচ্ছে।
ফ্যাক্টরিতে সাতজন দক্ষ নারী কারিগর প্রতিদিন রঙিন ও সাদা চক তৈরি করছেন। পানি ও চক পাউডার মিশিয়ে তৈরি করা হয় ঘন মিশ্রণ, যা ঢেলে দেওয়া হয় কাঠের ডাইসে। প্রতিটি ডাইস ২০ মিনিটের মধ্যে তৈরি করে ফেলে চক। রঙিন চকের জন্য আলাদা করে রং মেশানো হয়, যা চকগুলোকে করে তোলে আরও আকর্ষণীয়। সাদা, গোলাপি, লাল, হলুদ সব রঙের চক তৈরি হয় এখানে।
চকগুলো ডাইস থেকে বের করে শুকানোর জন্য রাখা হয় পাশের খোলা মাঠে। সেখানে ২১ জন নারী ব্যস্ত থাকেন চকগুলো সাজিয়ে রোদে শুকানোর কাজে। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কাজ করেন তারা। বিনিময়ে পান ১৫০ টাকা হাজিরা।
মাহিনা খাতুন বলেন, ‘আগে শুধু সাদা চক বানাতাম, এখন রঙিন চকও করছি। বাচ্চারা স্কুলে বেশি পছন্দ করে এই রঙিন চকগুলো।’
এখানকার কারিগর রোজিনা বলেন, ফ্যাক্টরি থেকে যে হাজিরা পান তা দিয়ে তার সংসারে বেশ সহযোগিতা হয়। যদিও হাজিরা সামান্য টাকা। তবে বসে থাকার থেকে কাজ করাই ভালো বলে মনে করেন তিনি। এছাড়াও বাড়ির পাশে ফ্যাক্টরি থাকায় দরকার হলে দ্রুত বাড়ি গিয়ে কাজ সেরে আসতেও পারেন।

তিস্না খাতুন নামের আরেক কারিগর বলেন, ‘শুধু কুষ্টিয়া নয়, আমাদের তৈরি চক দেশের বিভিন্ন জেলার বাজারেও যায়। খুব ভালো লাগে যখন ভাবি, আমাদের হাতে তৈরি চকে শিশুরা লেখাপড়া করছে। এটা আমাদের খুব ভালো লাগে।’
তানিয়া বুলবুল নামের আরেক কারিগরের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘বাড়ির কাজ শেষ করে সকাল ৯টায় ফ্যাক্টরিতে আসি। সাদা, গোলাপি, হলুদ বা লাল যে রঙের দরকার হয়, তাই তৈরি করি। অন্যদিকে এখান থেকে যে হাজিরাটা পাই, সেটি আমার সংসারে কাজে লেগে যায়।’
সাদা চকের পাশাপাশি রঙিন চকের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। স্থানীয় বাজার ছাড়িয়ে এই চক এখন দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হচ্ছে। স্কুল, কলেজ, আর্ট স্কুল, এমনকি বিভিন্ন শিল্পকর্মের জন্যও এই রঙিন চক ব্যবহৃত হচ্ছে।
ফ্যাক্টরির মালিক আব্দুল মতিন বলেন, ‘বাজারে চকের আবেদন অনেক আগেই হারিয়েছে। যখন এই ফ্যাক্টরি শুরু করি, তখন বাজার পড়তির দিকে। তারপরও গ্রামের পরিবেশে ফ্যাক্টরিটা টিকিয়ে রেখেছি। এতে অন্তত কিছু নারীর পার্ট-টাইম কাজের সুযোগ হয়েছে।’

ফ্যাক্টরির মালিক আব্দুল মতিন আরও বলেন, ‘মাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকার চক বিক্রি হয়। এই জুনাইদ চক কুষ্টিয়া ছাড়াও আশপাশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় সরবরাহ করা হয়।’
কুষ্টিয়ার দহকুলা বাগান পাড়ার এই ২৮ নারী প্রতিদিন তাদের হাতে গড়ে তুলছেন রঙিন চক। এই শিল্প শুধু তাদের জীবনের চাকা ঘোরাচ্ছে না, বরং সমাজে নারীদের শক্ত অবস্থান তৈরি করতেও সহায়ক হচ্ছে। প্রতিটি রঙিন চক যেন তাদের কঠোর পরিশ্রম ও হারিয়ে যেতে বসা এক শিল্পকে টিকিয়ে রাখার গল্প বলে। এই নারীরা শুধু চক তৈরি করছেন না—তারা গড়ছেন স্বপ্ন, সম্ভাবনা। যা সমাজে নারীর অগ্রযাত্রার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।