চলনবিলের ঐতিহ্যবাহী ‘গোলাঘর’ এখন শুধুই স্মৃতি

গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ আর গোলা ভরা ধান–এগুলো এখন চলনবিলের মানুষের শুধুই স্মৃতি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে গেছে সেই ধানের গোলাঘর। এক সময় কৃষকরা তাদের ক্ষেতের উৎপাদিত ধান গোলাঘরে মজুদ রাখতেন।
বসতবাড়ির আঙিনায় মাটি, বাঁশ আর টিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি করা হতো ধান রাখার এ গোলাঘর। ধানের গোলাগুলো বসানো হতো বেশ উঁচুতে। যেন বর্ষায় পানি ঢুকে ধান নষ্ট না হয়। গোলাঘরে প্রবেশের জন্য রাখা হতো একটি দরজা। দরজায় বাইরে থেকে তালা মেরে রাখা হতো চোরের হাত থেকে ফসল রক্ষার জন্য। এটি দেখতে অনেকটা পিরামিডের মতো। আধুনিক যুগে গোলাঘরের জায়গা দখল করেছে বিশেষ সুবিধা সম্পন্ন গুদামঘর। তবে চলনবিলের কিছু মানুষ বাপ-দাদার স্মৃতি ধরে রাখতে এখনও এই গোলাঘর বাড়িতে রেখে দিয়েছেন।
তেমনি একজন পাবনার আলহাজ কে এম আনোয়ারুল ইসলাম। পাবনার চাটমোহর পৌর সদরের জিরো পয়েন্টে তাঁর নিজ বাড়ির উঠানের পাশে আজও দাঁড়িয়ে আছে তিনটি ধান রাখার গোলাঘর। প্রায় ৭০ বছর আগে তৈরি করা হয়েছিল ধানের গোলাঘর তিনটি। এখনও মাঝেমধ্যে মেরামত করা হয় এই গোলাঘর।
জানা যায়, গোলাঘর নির্মাণ করার জন্য বিভিন্ন এলাকায় আগে দক্ষ শ্রমিক ছিল। গ্রাম-গঞ্জে প্রায় কৃষকের বাড়িতেই ধান মজুদ রাখার জন্য বাঁশ, বেত ও কাদা দিয়ে তৈরি করা হতো এসব গোলাঘর। পরে গোলার গায়ে ভেতরে ও বাইরে বেশ পুরু করে লাগানো হতো মাটির আস্তরণ। গোলাঘরের প্রবেশ পথ রাখা হতো উঁচুতে, যাতে সহজেই চোর ধান চুরি না করতে পারে। তখন সমাজের নেতৃত্ব নির্ভর করত কার কয়টি ধানের গোলাঘর আছে এই হিসাব করে। শুধু তাই নয়, কন্যা ও বরপক্ষের বাড়ির ধানের গোলাঘরের খবর নিত উভয় পক্ষের লোকজন–যা এখন শুনলে শুধু কল্পকাহিনি মনে হয়।
গোলাঘরের স্মৃতি তুলে ধরে বিলচলন ইউনিয়নের ৭৬ বছর বয়সী সবুজ মোল্লা বলেন, ইট, পাথর, বালি, সিমেন্ট আর রডের আবিষ্কার হওয়ায় অতীতের অনেক জিনিস এখন অচল হয়ে গেছে। আমাদের সময় ভাদ্র মাসে জমিতে পানি থাকত। পানির মধ্যে আউশ ধান কেটে ভেজা অবস্থায় গোলায় রাখতাম। ভেজা ধান গোলায় শুকিয়ে যেত। আবার ওই ধানের চাল অনেক শক্ত হতো, ভাত খেতেও স্বাদ পেতাম। এখন এসব আর হয় না। আধুনিকতার ছোঁয়ায় সব হারিয়ে যাচ্ছে।
৭০ বছর বয়সী আবেদা খাতুন বলেন, আমাদের সময় প্রায় সব বাড়িতেই ধানের গোলাঘর ছিল। সারা বছর গোলাঘর থেকে ধান বের করে তা সিদ্ধ করে শুকিয়ে ঢেঁকি দিয়ে চাল বের করতাম। এখন আর তা করতে হয় না। মিল-কারখানা আর চাতালে এসব কাজ হয়। ওই সময় বড় বড় গৃহস্থদের বাড়িতে বড় বড় ধানের গোলাঘর থাকত। আমাকেও পরিবারের লোকজন গোলাঘর দেখে বিয়ে দিয়েছিল।
কে এম আনোয়ারুল ইসলাম এনটিভি অনলাইনকে জানান, আমাদের এই গোলাঘরটির বয়স প্রায় ৭০ বছর। আমি ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। মা-বাবা এই গোলাঘর বোঝাই করে ধান রাখতেন। সারা বছর তিনটি গোলাঘরে প্রায় ৬০০ মণ ধান থাকত। এখনও প্রতি বছর গোলাঘরগুলো মেরামত করে ধান রাখি। চলনবিলের ঐতিহ্য হিসেবে আজও আমরা ধানের গোলাঘর রেখে দিয়েছি। অনেকেই গোলাঘরগুলো দেখতে আসে।