একসময়ের প্রমত্তা নড়াই নদী এখন শুধুই ময়লার ভাগাড়

রাজধানীর রামপুরা সেতু ও বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনের মাঝ দিয়ে পুব দিকে ত্রিমোহিনীর দিকে চলে গেছে প্রশস্ত একটি সড়ক। সড়কের বাঁ পাশের ফুটপাত দিয়ে হাঁটা দিলে আচমকা উৎকট দুর্গন্ধ এসে নাকের ভেতরে ঢুকে পড়ে। এখানে সিটি করপোরেশনের একটি ময়লা ভাগাড় রয়েছে। কোনোরকম নাক-মুখ চেপে সামনে এগোলে সবার আগে চোখে পড়বে একটি মরা নদী। হরেক গাছগাছালিতে ভরা নদীটির তীর কংক্রিকেটের বেড়া দিয়ে ঘেরা।
নদী হলেও আসলে সেটিকে সরু খাল বা জলরেখা বলা চলে। সেই খালের তীরেই ছোট্ট একটি সাইনবোর্ডে লেখা ‘নড়াই নদী’। সাইনবোর্ড না দেখলে যে কেউ মরা খালই ভাববে নদীটিকে। নদীর তীর ধরেই এগিয়ে গেছে সড়কটি। নদীর একপাশে বনশ্রী এলাকা, অপরপাশে আফতাবনগর।
ফুটপাত দিয়ে আরও কিছুদূর গেলে বনশ্রীর ‘সি’ ব্লকের মাথায় আরেকটি ময়লার উন্মুক্ত ভাগাড় দেখা যাবে। বাসাবাড়ি থেকে ময়লা এনে সিটি করপোরেশনের লোকজন এখানে ফেলছে। পরে ময়লার গাড়িতে করে তা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অন্যত্র।
গত রোববার (৬ এপ্রিল) সকালে নদীতীর ধরে মাইলখানেক হাঁটার পর রামপুরা সেতু থেকে মেরাদিয়া বাজার পর্যন্ত সিটি করপোরেশনের এমন তিনটি ভাগাড় চোখে পড়েছে। কেবল তাই নয়, ময়লা-আবর্জনায় ঢাকা পড়েছে নদীতীরের পুরোটা। কোথাও কোথাও আবার আগুন দিয়ে পোড়ানো হচ্ছে সেই ময়লা।

সরেজমিনে দেখা যায়, বনশ্রীর আইডিয়ালের পাশেই একটি বহুতল কনডোমিনিয়াম (আবাসিক ভবন) নির্মাণ করা হচ্ছে। সেখানের ইট-বালুর বস্তা নদীতীরে ফেলা হচ্ছে। আরেকটু হাঁটলে চোখে পড়ে, ফরাজি হাসপাতালের সামনে নদী দখল করে অ্যাম্বুলেন্স রাখা হয়েছে।
মেরাদিয়া হাট এলাকায় নদীতীর দখল করে বিভিন্ন দোকানপাট গড়ে উঠেছে। সিটি করপোরেশনের আরও একটি ভাগাড় রয়েছে এখানে। নদীর তীরে খোলা জায়গায় ময়লা ফেলা হচ্ছে। এতে আশপাশের বাসিন্দাদের অসহনীয় ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।
নদীর বনশ্রী অংশে ময়লার ভাগাড় হলেও অপরপাশের আফতাবনগর অংশে তীর দখল করে গড়ে উঠেছে উঁচু উঁচু ভবন, অ্যাপার্টমেন্ট ও হাসপাতাল। কোনো কোনো ভবন নদীর ভেতরে ঢুকে গেছে। সড়ক সম্প্রসারণের নামেও নদীর জায়গা দখল করে ফুটপাত নির্মাণ করা হয়েছে।

বনশ্রীর ‘সি’ ব্লকে কথা হচ্ছিল রুহুল নামের স্থানীয় এক বাসিন্দার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বনশ্রী ও আফতাবনগরের সব আবর্জনা এই নদীতে ফেলা হয়। উন্মুক্ত স্থানে ময়লার ভাগাড় করায় আশপাশের এলাকার বাসিন্দাদের দুর্ভোগের শেষ নেই। ঠিকমতো প্রাণভরে শ্বাস নিতে পারি না দুর্গন্ধের কারণে।’
এরপর কিছুদূর এগিয়ে কথা হচ্ছিল আফতাবনগরের বাসিন্দা সিফাতুল ইসলামের (৪৩) সঙ্গে। নড়াই নদীর কথা বলতে গিয়ে তিনি কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। কারণ এই নদীর সঙ্গে তার অনেক স্মৃতি জড়িত।সিফাতুল বলেন, ‘১৯৯১ সালের কথা। আফতাবনগর থেকে নৌকায় করে ভাসতে ভাসতে বনশ্রী আইডিয়ালে ক্লাস করতে আসতাম। নৌকায় প্রথমে আফতাবনগর আসতাম, সেখান থেকে আরেকটি নৌকায় আবার বনশ্রীতে পা রাখতাম। আধঘণ্টা সময় লাগত আসতে।’
‘তখন এই বনশ্রী ও আফতাবনগর পুরোটাই ছিল উত্তাল নদী। এটি ছিল সীতালক্ষ্মীর শাখা নদী।’
সিফাতুল বলেন, ‘আমাদের একটা প্রাইভেট নৌকা ছিল। এখন যেমন সবাই প্রাইভেট কার কেনেন, তখন সবাই প্রাইভেট নৌকা কিনতেন। সেটিতে যাতায়াত করতেন তারা।’
বনশ্রীর ‘এফ’ ব্লকে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল তার সঙ্গে। বর্তমানে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেন সিফাতুল।
সিফাতুল যোগ করেন, ‘একটা সময় নদী দখল শুরু হয়। তখন সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের আমল। এসব এলাকা বালু দিয়ে ভরাট হতে শুরু করে। যেখানে বালু ভরাট করা হতো, সেখানে গিয়ে আমরা ফুটবল ও ক্রিকেট খেলতাম। তারপর ধীরে ধীরে বনশ্রী ও আফতাবনগর পুরোটাই ভরাট করে বড় বড় ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।’
এগুলো তার চোখের সামনেই হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নৌকায় করে মেরাদিয়া হাটে যেতাম। একটা মাটির ঢিবির মতো জায়গায় বসত এই হাট। আমরা সেখান থেকে মাছ ধরার বিভিন্ন হাতিয়ার কিনে নিতাম।’
নদীটি মরে গেছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘এখন আমরা এটিকে গন্ধরাজ খাল বলে ডাকি। কারণ খালটি থেকে কেবল অসহনীয় দুর্গন্ধ আসে। গুলশান-বনানীর পয়ঃনিষ্কাশন করা হয় এই খাল দিয়ে। যে কারণে পানি দেখতে আলকাতরার মতো কালো হয়ে গেছে।’
সমন্বিত পদক্ষেপের অভাব
সমন্বিত পদক্ষেপের অভাবে নড়াই নদী মরে গেছে বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাবেক সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল। তিনি বলেন, ‘নড়াই নদীর সঙ্গে মূলত হাতিরঝিলের সংযোগ ছিল। রামপুরা ব্রিজ নির্মাণ করে প্রথমে এটিকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। তারপরে বনশ্রী ও আফতাবনগর চেপে এটিকে একটি খালে পরিণত করেছে।’
শরীফ জামিল বলেন, ‘এখন যেটুকু আছে, সেটুকুও যদি রাখা হতো, তাহলেও কিছুটা রক্ষা হতো খালটির। প্রথমতো হাতিরঝিল থেকে যে ময়লা যায়, সেটা পরিশোধন করার জন্য দাসেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার করা হয়েছে। আগে থেকে এই পরিশোধনটা করা হলে হয়ত এই অংশটা ভালো থাকত। আবার এই পয়ঃশোধনাগার দিয়ে সবগুলো খালের ময়লা শোধন করা হয় না। যে কারণে দাসেরকান্দির পরেও যে পানিটা ছাড়া হয়, সেটাও দূষিত পানি।’
এই পরিবেশবিদ বলেন, ‘দাসেরকান্দির পয়ঃশোধনাগারের পর ত্রিমোহিনীর পানি ভালো হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। ত্রিমোহিনী এলাকায় মানুষ এই নদীর পানির দুর্গন্ধের কারণে বসবাস করতে পারেন না। হাতিরঝিল, নড়াই নদী, জিরানী খাল ও ত্রিমোহনী সংশ্লিষ্ট যেসব খাল বা নদী রয়েছে, এগুলোকে দূষণমুক্ত করার নামে সরকার অনেক আগ থেকেই অনেক প্রকল্প গ্রহণ করেছে। কিন্তু এসব কোনো সমন্বিত পরিকল্পনার অধীন হয়নি। যে কারণে এতকিছুর পরও নড়াই নদী মরে যাচ্ছে।’
‘ত্রিমোহিনীর ১২ গ্রামের মানুষ দূষণের শিকার। কাজেই টাকা নষ্ট না করে একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে, যেটি স্বচ্ছ ও বিজ্ঞানভিত্তিক হবে। পাশাপাশি স্থানীয় মানুষেরও অংশগ্রহণ থাকতে হবে।’

কেমন ছিল নড়াই নদী?
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘আগে এই নদীটি রামপুরা খাল হিসেবে পরিচিত ছিল। আমি নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান হওয়ার পর এটিকেও নদী হিসেবে তালিকাভুক্ত করি।’
গবেষক আমীন আল রশীদ বলেন, ‘ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বেগুনবাড়ি ও গুলশান এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া যে জলরাশিটি এখন হাতিরঝিল লেক নামে পরিচিত, সেটি আসলে নড়াই নদীর অংশ। এই নদীটি রামপুরার পাশ দিয়ে পূর্বদিকে বালু নদীতে গিয়ে মিশেছে।’
‘প্রাচীনকাল থেকে আশির দশকের শুরু পর্যন্ত ঢাকার মধ্যাঞ্চলের প্রধান নৌপথ ছিল নড়াই নদী। এই নদীর দুই তীরে পাল, সেন, সুলতানি ও মোগল আমলের বিভিন্ন স্থাপত্য নিদর্শন প্রমাণ দেয় এখানে শহর গড়ে উঠেছিল অনেককাল আগে থেকেই। পূর্ব দিকের বালু নদী থেকে পশ্চিম দিকের তুরাগ নদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল নড়াইয়ের ধারা। পরে এর পশ্চিমাংশ পুরোই ভরাট করা হয়।’
আমীন আল রশীদ বলেন, ‘এক সময়ের প্রমত্তা এই নদী দিয়ে পণ্য আনা হতো কারওয়ান বাজারে। সেখানে ছিল এই নদীর ঘাট।’
কবে হবে নড়াই নদী উদ্ধার?
নড়াই নদী তো আপনার আওতায়, এটি উদ্ধারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে কি—জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘না, এটি আমার আওতার মধ্যে পড়ে না। তবে জোর করে আমি কাজ করি। এই নদীর একটি অংশ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক), একটি অংশ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আর আরেকটি অংশ আমার আওতাধীন।’
মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘আমরা নদীটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছি। আমাদের পরিকল্পনা আছে। আমাকে পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব দিলে আমি এটিকে উদ্ধার করে দিতে পারব।’
‘এখন একপ্রকার দোদুল্যমান অবস্থার মধ্যে আছি। রাষ্ট্রীয় একটি সিদ্ধান্ত নিতে হলে অর্থের দিকে তাকাতে হবে। আমাদের অর্থের সংকুলান নেই।’
‘তাছাড়া আমরা কতদিন থাকব—সেটার ওপরও অনেককিছু নির্ভর করছে। আমলারাও সে অনুযায়ী সহযোগিতা করেন। ধরে নিতে হবে, আমরা স্বল্পসময়ের জন্য আছি। প্রধান উপদেষ্টা বলেই দিয়েছেন যে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে দেবেন। আমার মনে হয়, এই পারসেপশনগুলো একেকটি বড় বাধা। এগুলো সিদ্ধান্ত নিতে বাধা তৈরি করে। তবে আমাদের কাজের বাধা নেই।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, ‘মানুষের প্রত্যাশার চেয়ে আমি নিজেই চাপ অনুভব করি যে নদীটিকে উদ্ধার করতে হবে। আমি এক মাসের মধ্যে উত্তরার কনাই নদী উদ্ধার করেছি। এত কম সময়ে একটি নদী উদ্ধার করার ঘটনা আর নেই। যদি জনগণ ও সরকারের পারসেপশন এমন থাকে যে, আমরা যতদিন আছি বড় কাজগুলো হাতে নিতে পারব, সেই সিগন্যাল রাষ্ট্র থেকে দিলে এই কাজ করা আমার জন্য সকাল-বিকালের ব্যাপার।’