২৫ বছর শিকলে বাঁধা জীবন, বিল্লালের নীরব আর্তনাদ শুনবে কে!

একটি দীর্ঘশ্বাস, যা শিকলের ঝনঝনানিতে মেশে। একটি নীরব আর্তনাদ, যা চার দেয়ালের বন্দিত্বে প্রতিধ্বনিত হয়। বিল্লাল হোসেন, ৩৫ বছর বয়সী এক যুবক, যার জীবনের ২৫টি বছর কেটেছে শিকলের কঠিন বন্ধনে। শৈশবের স্বাভাবিক হাসি-কান্না, স্বপ্ন দেখা চোখ আজ বন্দিত্বের নির্মম প্রতীকে পরিণত।
রাজশাহী নগরীর তালাইমারি বাদুড়তলা এলাকার হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান বিল্লাল। বাবা প্রয়াত হওয়ার পর দুই ভাইয়ের সামান্য রোজগারে কোনোমতে চলতো তাদের সংসার। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে মাস দুয়েক আগে বড় ভাই স্ট্রোক করে দৃষ্টিশক্তি হারালে, সংসারের ভার পড়ে দিনমজুর ছোট ভাইয়ের কাঁধে। এতে বিল্লালের চিকিৎসার ক্ষীণ আশাটুকুও নিভে যায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিল্লালের বর্তমান ঠিকানা, বাড়ির সামনের একটি ছোট্ট খুপরি ঘর। যেখানে ছাগল বাঁধা থাকে, সেখানেই চেয়ারের সাথে এক পায়ে লোহার শিকলে বন্দি বিল্লাল। বাকপ্রতিবন্ধী ও মানসিক ভারসাম্যহীন হলেও তার চোখে এক নীরব আকুতি। ক্ষুধা পেলে শিকল বাঁধা হাতে নিজের পেট চাপড়ে জানান দেন। শিকলের ছোট্ট গণ্ডিই যেন তার জগৎ, তার হাসি-কান্নার সাক্ষী।
প্রায় নয় বছর বয়স থেকে বিল্লাল শিকলবন্দি জীবন কাটাচ্ছেন। পরিবারের অসহায়ত্ব, অর্থাভাব তার উন্নত চিকিৎসার পথে অন্তরায়। একসময়ের দুরন্ত কিশোর, যে চোখের আড়াল হলেই ছুটে যেত দিগ্বিদিক, আজ শিকলের ভারে ন্যুব্জ।
পরিবারের সদস্যরা জানান, বিল্লাল স্বাভাবিক শিশুই ছিল, শুধু কথা বলতে পারত না। হাঁটতে শেখার পর থেকেই তার অস্থিরতা বাড়ে। কবিরাজ থেকে শুরু করে স্থানীয় ডাক্তার—সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। বাধ্য হয়েই তাকে শিকলে বাঁধতে হয়, দুর্ঘটনা আর হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে।
বিল্লালের মা সাহেরা বেগমের চোখে জল। বলেন, ‘দিন-রাত ছেলেকে বেঁধে রাখি। মা হয়ে এ দৃশ্য সহ্য করা কঠিন। আমরা গরিব মানুষ, সংসার চালাতেই হিমশিম খাই, চিকিৎসা করাব কী করে?’
বিল্লার ভাবী সেলিনা বেগমের কণ্ঠেও একই অসহায়তা। ‘বিয়ে হয়ে আসার পর থেকেই বিল্লালকে বাঁধা দেখি। অভাবের তাড়নায় চিকিৎসা করাতে পারিনি, তাই এই বন্দিদশা।’
স্থানীয়রা জানান, বছরের পর বছর ধরে বিল্লাল শিকলবন্দি জীবন কাটাচ্ছেন। খাবার, ওষুধ আর যত্নের অভাবে তার শারীরিক অবস্থাও ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। শিকলের ব্যথায় নীরব আর্তনাদ জানান দেয় তার নিষ্পাপ চোখ।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই অবস্থাকে সুস্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছে। মানসিক স্বাস্থ্য আইন ২০১৮ অনুযায়ী, মানসিক প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। মানবাধিকার কর্মীরা স্থানীয় প্রশাসন ও সমাজসেবা অধিদপ্তরকে দ্রুত বিল্লালের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
সুশাসন বিশ্লেষক সুব্রত কুমার পাল বলেন, ‘কোনো মানুষকেই এভাবে বেঁধে রাখা চরম নিষ্ঠুরতা ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। মানসিক স্বাস্থ্য আইন অনুযায়ী, রাষ্ট্রের দায়িত্ব বিল্লালের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন করা। সমাজসেবা অধিদপ্তর এবং সমাজের বিত্তবানদেরও এই অসহায় মানুষটির পাশে দাঁড়ানো উচিত।’
বিল্লালের শিকলমুক্তির জন্য, তার উন্নত চিকিৎসার জন্য সমাজের সংবেদনশীল হৃদয়গুলো কি এগিয়ে আসবে? একটি জীবন, শিকলের অন্ধকারে ধুঁকছে— এই নীরব কান্নার কি কোনো উত্তর মিলবে?