চাঁদপুরে উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে বিচ্ছেদ, প্রতিদিন ২১ তালাক

চাঁদপুরে বিয়ের তুলনায় তালাক বা বিয়ে বিচ্ছেদের হার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। প্রবাসী অধ্যুষিত জেলা হওয়ায় একদিকে যেমন দাম্পত্য জীবনে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে দ্রুত গড়ে উঠছে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক। স্বামী-স্ত্রী থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও জড়িয়ে পড়ছে এসব সম্পর্কে, যার পরিণতিতে প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন স্থানে নিখোঁজ ও ঘরছাড়া হওয়ার ঘটনা ঘটছে।
জেলার থানাগুলোর তথ্যমতে, বর্তমানে সহস্রাধিক নিখোঁজের সাধারণ ডায়েরি (জিডি) রয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে বিয়ে বিচ্ছেদের হার দিন দিন বাড়লেও তা নিয়ন্ত্রণে আনতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
চাঁদপুর সদর সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চাঁদপুরের ৮টি উপজেলায় গত এক বছরে বিয়ে রেজিস্ট্রি হয়েছে ১৪ হাজার ৪৬৫টি। একই সময়ে তালাক হয়েছে ৭ হাজার ৮৯১টি, অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ২১টি তালাক হচ্ছে। এর মধ্যে নারীদের পক্ষ থেকেই বেশি তালাকের আবেদন আসছে। বিশেষ করে চাঁদপুর সদর, ফরিদগঞ্জ ও হাজীগঞ্জ উপজেলায় বিবাহবিচ্ছেদ এবং পরকীয়ার কারণে ঘরছাড়ার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
চাঁদপুরের আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা থেকেও বিষয়টি স্পষ্ট। চাঁদপুর আদালত সূত্রে জানা যায়, গেলো এক বছরে এমন ২ হাজার ৭৫৪টি মামলা বিচারাধীন ছিল, যার মধ্যে ৯৮৮টি নিষ্পত্তি হয়েছে। নিষ্পত্তিকৃত মামলাগুলোর বড় একটি অংশই শেষ হয়েছে তালাক বা বিচ্ছেদের মাধ্যমে।
জেলার থানাগুলোতে পরকীয়া ও পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে ঘরছাড়া হয়েছেন সহস্রাধিক নারী-পুরুষ। এর মধ্যে স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। তালাকের পেছনে মূল কারণ হিসেবে উঠে এসেছে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, নারী নির্যাতন, বাল্যবিবাহ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার, যৌন অক্ষমতা ও পারিবারিক বন্ধনের অভাব। বাস্তবে তালাকের চিত্র সরকারি পরিসংখ্যানের চেয়েও ভয়াবহ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ফরিদগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা নাছির পাঠান বলেন, এই উপজেলাটি প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকা। বিয়ের পর পুরুষরা যখন বিদেশে চলে যায়, তখন নারীরা একাকিত্ব অনুভব করেন। তখনই শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের সঙ্গে নানা কারণে দ্বন্দ্ব শুরু হয়, যা বিবাহবিচ্ছেদে গড়ায়। এর পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুকের মাধ্যমে নতুন সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা অনেক সময় পরিবারের অমতে বিয়েতে রূপ নেয়। কিন্তু সেই বিয়েগুলো টেকে না।
চাঁদপুর পৌর এলাকার বাসিন্দা আব্দুল জব্বার বলেন, দেশ যত ডিজিটাল হচ্ছে, পারিবারিক বন্ধন ততই কমছে। পরকীয়া ও বিবাহ বিচ্ছেদের বড় কারণ স্মার্টফোন। এখনকার প্রজন্ম পরিবারকে সময় না দিয়ে মোবাইলফোনে ডুবে থাকে। ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়, যা শেষ পর্যন্ত সংসার ভাঙনের দিকে নিয়ে যায়। স্কুল-কলেজে পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা হঠাৎ করে উধাও হয়ে যাচ্ছে, পরে জানা যাচ্ছে তারা পরিবারের অমতে বিয়ে করেছে। কিন্তু সেই সম্পর্কগুলো স্থায়ী হয় না। সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ গড়ে না তুললে এ সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।
চাঁদপুর কাজী সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাজী সুফিয়ান দেওয়ান বলেন, বিয়ের ক্ষেত্রে সরকার কিছু নিয়ম বেধে দিয়েছেন। কাজীরা আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে চাকরি করেন এবং তাদের জবাবদিহিতা রয়েছে। কিন্তু কোর্টে কোনো জবাবদিহিতা না থাকায় রেজিস্ট্রারদের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বাল্যবিবাহ হচ্ছে। দেশের অনেক জেলায় এটি বন্ধ হলেও চাঁদপুরে এখনও রোটারির মাধ্যমে বিয়ে চলছে। যদি এটি বন্ধ করা যায়, তাহলে বিয়ে ও বিচ্ছেদ দুইই কমে যাবে।
চাঁদপুর নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের পিপি অ্যাডভোকেট শিরিন সুলতানা মুক্তা বলেন, আমাদের কোর্টে যেসব মামলা হয়, বিচারক ও আমরা আপসের পক্ষে থাকি। আমরা দুই পক্ষের আইনজীবীরা চেষ্টা করি যাতে বিচ্ছেদ না হয়। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই বিচ্ছেদ হয়ে যায়। বলা চলে, মামলার প্রায় ৮০ ভাগই শেষ হয় বিবাহ বিচ্ছেদে।
চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক (রাষ্ট্রবিজ্ঞান) মো. এনামুল হক বলেন, ইদানিং চাঁদপুরে নিখোঁজ ও ডিভোর্সের সংখ্যা ভয়াবহ হারে বেড়েছে। এর পেছনে দায়ী সোশ্যাল মিডিয়া, প্রবাসী অধ্যুষিত পরিবেশ ও পারিবারিক বন্ধনের অভাব। বিদেশে অবস্থানকারী স্বামীরা দূরে থাকায় অনেক পরিবারে টানাপোড়েন দেখা দেয়। নারীরা অনেক সময় আবেগের বশে বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। কেউ কেউ ডিভোর্স দিচ্ছেন, কেউ পরিবার ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। এর সমাধান হচ্ছে পারিবারিক মূল্যবোধ ও যৌথ পরিবার ব্যবস্থা পুনরায় শক্তিশালী করা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা।
চাঁদপুর জেলা পুলিশ সুপার মুহম্মদ আব্দুর রকিব বলেন, প্রবাসী পরিবারে নিখোঁজ বা বিচ্ছেদের ঘটনা তুলনামূলকভাবে বেশি। থানাগুলোতে এসব ঘটনায় আমরা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করি। বেশির ভাগ নিখোঁজ ব্যক্তিকে উদ্ধার করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরকীয়া ও বিবাহ বিচ্ছেদ রোধে সামাজিক সচেতনতা, পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করা ও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ বৃদ্ধিই একমাত্র সমাধান।