সেতু পরিত্যক্ত হলেও চলাচল করছে যানবাহন, দুর্ভোগে ৪০ গ্রামের মানুষ

সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার ভীমখালী ইউনিয়নের দৌলতা নদীর উপর ৯৫ মিটার তেরানগর সেতুটি ৪০ গ্রামের মানুষের চলাচলের একমাত্র ভরসা। নির্মাণের সময়ে ত্রুটি থাকায় অল্প সময়ে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে, ঘোষণা করা হয়েছে পরিত্যক্ত। তবুও ঝুঁকি নিয়েই চলাচল করছে অটোরিকশা সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, ট্রলিসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। ফলে যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।
স্থানীয়রা বলছে, পুরোনো এই সেতুর নির্মাণকালেই ত্রুটি ছিল। এ কারণে ২২ বছরের মাথায় যানবাহনের ভার সইতে পারছে না সেতুটি। এদিকে নতুন সেতু নির্মাণে এলাকাবাসীকে বারবার আশ্বাস দেওয়া হলেও বাস্তবে কোনো পদক্ষেপ নেই। এ কারণে চলাচলকারী মানুষজনের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে।
জামালগঞ্জ উপজেলার চলাচলের ভরসার সেতুটি ৪০টি গ্রামের মানুষকে দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হেমন্তে এটি ছাড়া ফেনারবাক ইউনিয়নের এসব গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগের আর কোনো উপায় নেই। জানা যায়, তৎকালীন সংসদ সদস্য প্রয়াত নজির হোসেন উপজেলার গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় জামালগঞ্জে চারটি সেতু নির্মাণ করেন। সাচনা বেহেলী রোডে চৌধুরী বাড়ির পাশে, সাচনা পলক গ্রামের পিয়াইন নদীতে, তেরানগর দৌলতা নদীর উপর তেরানগর সেতু, দৌলতপুর বীনাজুরার কানাইখালী নদীর উপর তেরানগর সেতু।
এই সেতুর নির্মাণ কাজ ২০০২ সালে শুরু হয়ে ২০০৪ সালে শেষ হয়। ওই সময়ে এই পথে সাইকেল, মোটরসাইকেল ছাড়া কোনো যানবাহন চলত না। হেঁটে সেতু দিয়ে চলাচল করত ৪০ গ্রামের হাজার হাজার মানুষ। গেল প্রায় ২০ বছর হয় জামালগঞ্জ হয়ে তেরানগর সেতু পার হয়ে ফেনারবাক ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর বাজার, নবীনচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় পর্যন্ত পাকা সড়ক হয়েছে। প্রতিদিন এই সড়কে শত শত মোটরসাইকেল অটোরিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মিনিট্রাক, ট্রলি চলাচল করে। একটি উচ্চ বিদ্যালয়, দুটি বাজার, একটি মাদ্রাসা এবং প্রায় অর্ধশত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সড়ক যোগাযোগের পথ যুক্ত হয়েছে এই সেতুকে ঘিরে।
এ ছাড়া মাতারগাঁও, রাজাপুর রসুলপুর লালপুর দৌলতপুর, উজান দৌলতপুর, রাজাবাজ, খোজারগাঁও, বীনাজুরা তেঘরিয়া গঙ্গাধরপুর, ছয়হারা, কামারগাঁও, ইনাতনগর, বিজয়নগর, কাশীপুর, উদয়পুর লক্ষ্মীপুর ভেদারপুর ফেনারবাক, চাটনিপাড়া, নাজিমনগর হটামারা, উদয়পুর ছাড়াও দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া ইউনিয়নের ভাটিপাড়া, নূরনগর, আলীনগর, ইসলামপুর, সেচনী, রফীনগর ইউনিয়নের খাগাউরা, সেচনী, কিত্তাগাঁও, স্বজনপুরসহ ১২টি গ্রামের মানুষকে এই ব্রিজ পার হয়েই যাতায়াত করতে হয়।
গত কয়েক বছর হয় ভারী যানবাহন সেতুর উপর উঠলে কাঁপতে থাকে এটি। প্রতি বছরেই উপজেলা প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদের বরাদ্দ থেকে সংস্কার করে অর্থের অপচয় হয়। কিছু দিনের মধ্যেই আবার খানাখন্দসহ সেতুর রেলিং ও অ্যাপ্রোচ ভেঙে যায়। ২০১৪ সালে সেতুটি জামালগঞ্জ এলজিইডি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। পরিত্যক্ত লেখা সাইনবোর্ড টাঙানোর পরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেতুর উপর দিয়ে প্রতিদিন চলাচল করছে শত শত যানবাহন।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সেতুর বিভিন্ন অংশে ছোট ছোট গর্ত এবং খানাখন্দে ভরা। মাঝে মাঝে কিছু গর্ত ইট বালু দিয়ে জোড়াতালি দেওয়া হলেও বাকি গর্তগুলোর উপর দিয়ে প্রতিদিন চলছে শতশত যানবাহন।
অটোরিকশাচালক নাসির বলেন, প্রতিদিন সেতুর গর্তে পড়ে কোনো না কোনো গাড়ি নষ্ট হচ্ছে। গাড়ি উঠলেই সেতু কাঁপতে থাকে, মনে হয় হেলে পড়ে যাবে। সেতুর রেলিং গাড়ির ধাক্কায় ভেঙে আরও ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। সংকীর্ণ এই সেতু দিয়ে দুইটি গাড়ি একসঙ্গে চলাচল করতে পারে না।
স্থানীয় জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক অঞ্জন পুরকায়স্থ বলেন, ২০১৪ সালে সেতুটি পরিত্যক্ত ঘোষণা হয়, কিন্তু নতুন করে সেতু তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এই সেতু দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছেন ৩ জন, আহত হয়েছেন কমপক্ষে দুই শতাধিক মানুষ। এ ছাড়া ছাগল ভেড়া গবাদিপশু মারা গেছে অর্ধশত। প্রতিনিয়ত ভোগান্তি আর হয়রানির শিকার হচ্ছে ৪০টি গ্রামের মানুষ। বিগত দিনে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা আশ্বাস দিলেও নতুন সেতু বাস্তবায়ন হয়নি।
নবীন চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুজিত চন্দ্র সরকার বলেন, প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে, কেউ খবর রাখছে না। সেতু ভেঙে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে দায় কে বহন করবে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন এই ঝুঁকিপূর্ণ সেতুর উপর দিয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে। দ্রুত দৌলতা নদীর উপর সেতু নির্মাণের দাবি আমাদের সবার।
ভীমখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. আখতারুজ্জামান তালুকদার বলেন, এই সেতু দিয়ে ৪০টি গ্রামের মানুষ যাতায়াত করেন। সেতুটি দীর্ঘদিন ধরে ঝুঁকিপূর্ণ থাকায় জনগণের ভোগান্তি হচ্ছে। ২০১৪ সালে পরিত্যক্ত ঘোষণার পরও প্রতিদিন শতশত যানবাহন সেতু দিয়ে চলাচল করছে। এতে যেকোনো মুহূর্তে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
জামালগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী মো. ছানোয়ার হোসেন জানান, দৌলতা নদীর উপর তেরানগর সেতুটি ২০০২ সালে শুধু হেঁটে পারাপারের জন্য করা হয়েছিল। তখন এই উপজেলার কোথাও গাড়ির যোগাযোগ ছিল না। এখন এই সেতুর উপর দিয়ে প্রতিদিন শত শত গাড়ি চলাচল করছে। সেতুটিও এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। ইতোপূর্বে উপজেলা প্রকৌশল কার্যালয় থেকে প্রকল্পের আওতায় দৌলতা নদীর সেতুসহ এই সংস্থার মাধ্যমে আগামী অর্থবছরে আরও কয়েকটি সেতুর প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আশাকরি, আগামী অর্থবছরে অর্থ বরাদ্দ হবে এবং এই এলাকার জনসাধারণের অতিগুরুত্বপূর্ণ এই সেতু নতুন করে করা যাবে।