শেষ হলো জাতীয় ঐক্যমত কমিশনের বৈঠক, যেসব ইস্যু আলোচনায়

এক ব্যক্তি জীবনে ১০ বছর প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকতে পারবেন, গোপন ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, তিন বাহিনী ও দুই গোয়েন্দা প্রধান নিয়োগ সরাসরি রাষ্ট্রপতির হাতে রাখা, পিআর পদ্ধতিতে একশ আসনের উচ্চকক্ষ ঘোষণাসহ বেশ কিছু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা শেষ করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তবে এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আরও একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
আজ বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) দ্বিতীয় ধাপের ২৩তম দিনের সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠক শেষে এ তথ্য জানা গেছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি করে সাত সদস্যের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজকে এই কমিশনের সহসভাপতি করা হয়।
ঐকমত্য কমিশনের সদস্য হিসেবে রয়েছেন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফররাজ হোসেন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান বিচারপতি এমদাদুল হক এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান।
দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, বামদলসহ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে জাতীয় ঐক্যমত কমিশন।
বৈঠকে উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্তগুলো হলো—
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হবে উভয় কক্ষের সদস্যদের গোপন ভোটে : আইনসভার উভয় কক্ষের (জাতীয় সংসদ ও উচকক্ষ) সদস্যদের গোপন ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে।
কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়, বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রপতি থাকবেন, যিনি আইন অনুযায়ী আইনসভার উভয় কক্ষের (নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ) সদস্যদের গোপন ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্বাচিত হবেন।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে বিদ্যমান সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮(৪)-এ উল্লিখিত যোগ্যতাসমূহ প্রযোজ্য হবে এবং রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হওয়ার সময় কোনো ব্যক্তি কোনো রাষ্ট্রীয়, সরকারি বা রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের পদে থাকতে পারবেন না—এই মর্মে অনুচ্ছেদ ৪৮(৪)(ঘ) যুক্ত হবে।
এক ব্যক্তি ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন, একমত সব দল : এক ব্যক্তি জীবনে ১০ বছর প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকতে পারবেন বলে একমত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। একইসঙ্গে তারা স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনেও একমত হয়েছে।
আলী রীয়াজ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ১০ বছর মেয়াদে দায়িত্ব পালন করবেন। সনদে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ১০ বছর উল্লেখ করব। এ বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি।’
পিআর পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ ১০০ আসন : জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংসদে ১০০ আসনের একটি উচ্চকক্ষ গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উচ্চকক্ষের সদস্যরা নিম্নকক্ষে প্রতিটি দলের প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ অনুযায়ী ‘সংখ্যাগত প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি’তে (পিআর) মনোনীত হবেন।
কমিশনের সিদ্ধান্তের বিষয়ে বলা হয়, জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব ক্রমান্বয়ে ১০০ আসনে উন্নীত করা হবে। নারী আসন ১০০-তে উন্নীত করার পক্ষে রাজনৈতিক মতৈক্য হলেও বেশিরভাগ দল ১০০ আসনে নারীদের সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিপক্ষে।
এই অবস্থায় বিদ্যমান ৫০ সংরক্ষিত নারী আসন রাখার পাশাপাশি জুলাই সনদ স্বাক্ষরের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে ৩০০ সংসদীয় আসনের মনোনয়নের ক্ষেত্রে ন্যূনতম পাঁচ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে কমিশন। সেই সঙ্গে চতুর্দশ জাতীয় নির্বাচনের মনোনয়নের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ আসনে নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
তিন বাহিনী ও দুই গোয়েন্দা প্রধান নিয়োগ সরাসরি রাষ্ট্রপতির হাতে রাখার প্রস্তাব :
তিন বাহিনীর প্রধান, অ্যাটর্নি জেনারেল ও দুটি প্রধান গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান নিয়োগের ক্ষমতা সরাসরি রাষ্ট্রপতির হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
প্রস্তাবিত সংশোধিত খসড়া অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি নিম্নলিখিত বিষয়াবলিতে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়াই কার্যনির্বাহ করতে পারবেন—অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ, তথ্য কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নিয়োগ, আইন কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ, সশস্ত্র বাহিনীসমূহের (সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী) প্রধানদের নিয়োগ, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) মহাপরিচালক নিয়োগ, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দার (এনএসআই) মহাপরিচালক নিয়োগ।
বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণসহ তিনটি এজেন্ডা নিয়ে আলোচনায় ঐকমত্য কমিশন :
বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন ও জরুরি অবস্থা ঘোষণা—এই তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।
এক ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা হতে পারবেন, দলীয় প্রধান নয় :
ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব হচ্ছে, যেকোনো একটি, তিনটির ভেতরে—প্রধানমন্ত্রী, লিডার অব দ্য হাউস ও দলের প্রধান। এই তিনটির ভেতরে যেকোনো একটি একজন ব্যক্তি দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো এক্ষেত্রে একজন দুটি দায়িত্বে থাকতে পারেন। একটি হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী, আরেকটি হচ্ছে লিডার অব দ্য হাউস এমন প্রস্তাব দিয়েছেন।
এছাড়াও তত্বাধায়ক সরকাররের অধীনে নির্বাচন করার প্রস্তাবে সব দল ঐকমত্য পোষণ করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের পদ্ধতি বিষয়ে অধিকাংশ দল একমত হয়েছেন।