পুলিশ দুই চোখ নষ্ট করে দিয়েছে, অনাগত সন্তানকেও আর দেখতে পাব না

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় দিনে সাক্ষ্য দিয়েছেন পুলিশের গুলিতে চোখ হারানো পারভীন। এ মামলায় তৃতীয় সাক্ষীর জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘আমি একজন দিনমজুর। ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই যাত্রাবাড়ির কুতুবখালী এলাকায় থাকতাম। কাজ থেকে ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ এক ছাত্রকে উঠাতে গেলে পুলিশ আমার চোখে ও তলপেটে গুলি করে। আমার নয় বছর ও চার বছরের দুই ছেলে রয়েছে, আমি তাদের দেখি না। এ মহূর্তে আমি আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমার অনাগত সন্তানকে আমি দুই চোখ দিয়ে দেখতে পাব না। শেখ হাসিনা ছিল পুলিশের বাবা-মা। তার নির্দেশে পুলিশ আমার দুই চোখ নষ্ট করে দিয়েছে।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে জুলাই অভ্যুত্থানে আহত এই নারী বলেন, ‘আমার সন্তানরা তার মায়ের অন্ধ হওয়ার বিচার চায়। এ আদালতে শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিচার না হলে পরে আর বিচার হবে না।’
আজ সোমবার (৪ আগস্ট) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার শুনানিতে দেওয়া সাক্ষ্যে এসব কথা বলেন পারভীন।
এদিন ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে পুলিশের গুলিতে পা হারানো আব্দুল্লাহ আল ইমরানও সাক্ষ্য প্রদান করেন। রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী তাদের জেরা করেন। পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ৬ আগস্ট দিন ধার্য করেছেন আদালত।
বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে আজ এ শুনানি হয়। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন—বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে পারভীন বলেন, ‘যাত্রাবাড়ি এলাকায় কুতুবখালীতে আমার বাসা ছিল। আমি একজন দিনমজুর। কখনো সবজি বিক্রি করি, কখনো বাজারে মাছ কাটি। যখন যেটা পাই, সেই কাজ করি। ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই আমি সকাল ৯টা যাত্রাবাড়ি থেকে লেগুনা দিয়ে জুরাইনে যাই। সেখানে কাজ শেষে বিকেলে বাসায় ফেরার পথে সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে যাত্রাবাড়ির ফ্লাইওভারের নিচে এসে দেখি বহু মানুষ আহত হয়ে পড়ে আছে। একটি ছেলেকে পুলিশ গুলি করেছে। তার বয়স আনুমানিক ১৮ বছর হবে। সে আহত হয়ে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছে। তার বুকে গুলি লেগেছে। তার আশপাশে গরু জবাইয়ের মতো রক্ত বের হচ্ছে। তার পরনে সাদা প্যান্ট ও সাদা গেঞ্জি ছিল। গলায় একটি আইডি কার্ড ছিল। তার অবস্থা দেখে আমার খুবই মায়া হয়। আমি ওই ছেলেকে ধরে তুলে ধরার চেষ্টা করি। সে আমাকে ধরে আমার ঘাড়ে মাথা রাখে। আমি তাকে নেওয়ার জন্য রিকশা খুঁজছিলাম। এ অবস্থায় হঠাৎ ১৪-১৫ জন পুলিশ আসে। তারা আমাদের দিকে গুলি করতে থাকে। এমনভাবে গুলি করে যেন খই পুড়তেছে।’
‘আমি হাত তুলে পুলিশকে গুলি করতে না করি। তারপরও একজন পুলিশ আমার বাম চোখে গুলি করে। তারপর আমার তলপেটে গুলি করে। একপর্যায়ে আমার শরীর থেকে রক্ত বের হয়ে ভেসে যাচ্ছিল। আমি ব্যথায় কাতরাচ্ছিলাম। একপর্যায়ে দুর্বল হয়ে পড়ি। তারপর মাটিতে পড়ে যাই। ঐ সময় ছেলেটি আমাকে চেপে ধরে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে আমাকে ছেড়ে দেয়। তখন বুঝলাম ছেলেটি মারা গেছে’, যোগ করেন পারভীন।
জবানবন্দিতে কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাক্ষী পারভীন বলেন, ‘কিছুক্ষণ পর লোকজন জড়ো হয়। তারা ছেলেটিকে মৃত দেখে আমাকে সিএনজি (অটোরিকশা) করে ঢাকা মেডিকেলে (ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে) নিয়ে যায়। ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার পর তারা আমার চিকিৎসায় অবহেলা করে। অনেকক্ষণ ফেলে রাখার পর একজন নার্স বলে, আপনার চোখে ড্রপ দিতে হবে। আপনার কাছে আড়াইশ টাকা আছে? আমি বললাম নাই। পরে অপর রোগী টাকা দিলে আমাকে একটি ড্রপ দেওয়া হয়, কিন্তু গুলি বের করেনি। তালা মেরে রেখে চলে যায়। আমি বাসায় নয় বছর ও চার বছরের দুই সন্তানকে রেখে গিয়েছি। হাসপাতালের বারান্দায় আমার ব্যথার চিৎকার ও কান্না দেখে একজন এসে বলেন, আপনার বাসার কোনো নম্বর আছে। আমি নম্বর বললে, তিনি আমার স্বামীকে ফোন দেন। পরে আমার স্বামী বরিশাল থেকে ঢাকায় আসে। ডাক্তারের পা ধরে কান্নাকাটি করি। ডাক্তার টাকার জোগাড় করতে বলেন। পরে আমার বাসায় কানের দুল বিক্রি করে টাকা নিয়ে আসে। হাসপাতালে আসার পথে আমার স্বামীর ওপর পুলিশ হামলা করে। তার মাথা ফেটে যায়। তারপরও সে ব্যন্ডেজ করে হাসপাতালে আসে। একপর্যায়ে আমার চোখ থেকে তিনটি গুলি বের করে। তিন-চার দিন পর তারা আমাকে চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালে (জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল) পাঠায়। কিন্তু চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতালে ৫ আগস্টের পূর্বে আমার কোনো চিকিৎসা করেনি। ৫ আগস্ট দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমার চিকিৎসা করার ব্যবস্থা করা হয়। চক্ষু হাসপাতালে আমার চোখ থেকে আরও একটি বড় বুলেট বের করে। এ ছাড়া আমার তলপেটে থাকা গুলিগুলো বের করা সম্ভব নয় এবং এজন্য মেডিসিন দিয়ে ট্রিটমেন্ট করতে হবে বলে ডাক্তার জানান।’
সাক্ষী পারভীন আরও বলেন, ‘আমার নয় ও চার বছরের দুটি সন্তান রয়েছে। আমি বর্তমানে আট মাসের গর্ভবতী। অনেক কষ্ট করে এখানে সাক্ষী দিতে এসেছি। আমি বেঁচে থেকেও ছেলেদের আমি দেখতে পাই না। আমার বাম চোখ পুরো নষ্ট হয়ে গেছে, ডান চোখ ঝাপসা সামান্য দেখি। সেটিও থাকবে না। বিজ্ঞ আদালত, আমার অন্ধ হওয়ার কারণ ছিল শেখ হাসিনা। হাসিনা ছিল পুলিশের বাবা-মা। পুলিশের খাদ্যদাতা ছিল। তার নির্দেশে পুলিশ আমার মতো হাজার হাজার মানুষকে গুলি করে আহত করেছে।’
‘বিজ্ঞ আদালত এ মহূর্তে আমি আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমার অনাগত সন্তানকে আমি দুই চোখ দিয়ে দেখতে পাব না। শেখ হাসিনা ছিল পুলিশের বাবা-মা। তার নির্দেশে পুলিশ আমার দুই চোখ নষ্ট করে দিয়েছে। আমার সন্তানরা তাদের মায়ের অন্ধ হওয়ার বিচার চায়। এ আদালতে শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিচার না হলে পরে আর বিচার হবে না। যদি বিচার না হয় দেশে খুন-খারাপি নির্যাতন আরও বেড়ে যাবে। আমি চাই অন্যায়ের বিচার হোক’, যোগ করেন চোখ হারানো পারভীন।
পরে রাষ্ট্র নিযুক্ত শেখ হাসিনার আইনজীবী সাক্ষী পারভীনকে জেরা করেন।
এর আগে গতকাল রোববার (৩ আগস্ট) এ মামলার প্রথম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন মাইক্রোবাসচালক খোকন চন্দ্র বর্মণ।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় গতকাল রোববার ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন ও সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে বিচার শুরু হয়।
গত ১০ জুলাই এই মামলার রাজসাক্ষী হন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। ট্রাইব্যুনালের আদেশে তাকে দোষ স্বীকারের শর্তে ক্ষমা ঘোষণা করা হয়।
গত ১ জুন এই মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। শেখ হাসিনার পাশাপাশি আসামি করা হয় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে। প্রসিকিউশন তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনেন। অভিযোগগুলো হলো—
প্রথম. গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের রাজাকারের বাচ্চা ও রাজাকারের নাতিপুতি উল্লেখ করে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন শেখ হাসিনা। এর পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ করে। গুলি করে দেড় হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়। আহত হন প্রায় ২৫ হাজার।
দ্বিতীয়. হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে সেই নির্দেশ কার্যকর করেন। গত বছরের ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল এবং ১৮ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে কথা বলেন শেখ হাসিনা। দুজনের সঙ্গে কথোপকথনের পৃথক অডিও রেকর্ড থেকে জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোকে মারণাস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি।
শেখ হাসিনার সেই নির্দেশ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপির মাধ্যমে সব বাহিনীর কাছে দেওয়া হয়। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও তার অন্যান্য অঙ্গসংগঠন এবং ১৪ দলীয় জোটের কাছেও এই নির্দেশ যায়। সেই নির্দেশের আলোকে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। এর দায়ে তাদের (হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও মামুন) বিরুদ্ধে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির (সর্বোচ্চ দায়) আওতায় অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।
তৃতীয়. রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করার ঘটনায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি আসাদুজ্জামান ও মামুনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
চতুর্থ. রাজধানীর চানখাঁরপুলে আন্দোলনরত নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায়ও শেখ হাসিনার পাশাপাশি ওই দুজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
পঞ্চম. শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও মামুনের বিরুদ্ধে আশুলিয়ায় নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জনকে আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনায়ও অভিযুক্ত করা হয়েছে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালে মোট চারটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ২ জুলাই আদালত অবমাননার একটি মামলায় তাকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এটিই প্রথম কোনো মামলা, যেখানে হাসিনার কারাদণ্ড হয়েছে।
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে অংশ নেন তাজুল ইসলাম, গাজী এম এইচ তামিম ও মিজানুল ইসলাম। শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন শুনানি করেন।