নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে কমিটি গঠনের আশা কাউন্সিলরদের

দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে নওগাঁ জেলা বিএনপির দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল। আগামী ১১ আগস্ট দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হয়েছে। দীর্ঘ দিন পর অনুষ্ঠিতব্য কাউন্সিলকে ঘিরে জমে উঠেছে প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা।
আসন্ন কাউন্সিল ঘিরে জেলা, উপজেলা ও পৌর বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে প্রাণ চাঞ্চল্য। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর জেলে থাকা ও বিভিন্ন মিথ্যা মামলা মাথায় নিয়ে আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীরা এখন যেন প্রাণ খুলে নিশ্বাস নিচ্ছেন। ছুটছেন পছন্দের প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণায়।
গত ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটার এক বছরে বিএনপির জেলা ও উপজেলার নেতারা তাদের কর্মীদের নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করে সক্রিয় ভাবে রাজনীতিতে মনোনিবেশ করার এবং দেশ ও জাতির পাশে দাঁড়ানোর জন্য মনোবল তৈরি করতে সহযোগিতা করছেন। আর তারই ফলশ্রুতিতে দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল ঘিরে বিভিন্ন স্তরের নেতা ও সমর্থকরা বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে গ্রামগঞ্জে, মাঠে-ময়দানে ভোট প্রার্থনা করছেন।
নওগাঁর ১১ উপজেলা ও তিনটি পৌরসভায় ১৪টি ইউনিটের ১০১ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি ইতোমধ্যে গঠন করা হয়েছে।
১৪টি ইউনিটের মধ্যে শুধু পত্নীতলা উপজেলা কমিটি এবং নজিপুর পৌর কমিটি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে উপজেলা ও পৌর বিএনপির কমিটি। সম্প্রতি পত্নীতলা উপজেলা কমিটিতে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে দুটি কমিটি করার হয়েছে বলে অভিযোগ উত্থাপন করে সংবাদ সম্মেলন, বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন কর্মসুচি পালন করেছে পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা।
নবীন-প্রবীণ নেতাদের সমন্বয়ে আগামীতে একটি গতিশীল জেলা বিএনপির কমিটি গঠনের লক্ষ্যে এখন নেতাকর্মীরা মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। কাউন্সিলে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং তিনটি সাংগঠনিক সম্পাদক পদে এক হাজার ৪১৪ ভোটারের প্রত্যক্ষ ভোটে জেলা বিএনপির কমিটি গঠনের লক্ষ্য নিয়ে মাঠে কাজ করছেন জেলা বিএনপির নেতারা।
গত ৩১ জুলাই বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা আব্দুস সালাম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি রেজাউর করিম বাদশাকে এই দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের বিষয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে দায়িত্ব দেওয়া হয়। চিঠি পাওয়ার পর তিনি গত শনিবার রাতে নওগাঁ জেলা বিএনপির কার্যালয়ে আহ্বায়ক কমিটি এবং দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলের প্রার্থীদের সঙ্গে প্রথম বারের মতো মতবিনিময় সভা করেন।
সভায় রেজাউর করিম বাদশা জানান, আগামী ১১ আগস্ট নওগাঁ জেলা বিএনপির দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল প্রতীক ও ভোটের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হবে। এ লক্ষে গত ৪ আগস্ট সোমবার এক দিনে প্রার্থীদের মধ্যে মনোনয়নপত্র বিক্রি, মনোনয়নপত্র জমা, বাছাই এবং প্রতীক বরাদ্দ সম্পন্ন হয়। ৫ আগস্ট থেকে প্রার্থীরা প্রতীক নিয়ে তাদের প্রচার-প্রচারণা শুরু করেন। তিনি কাউন্সিল সফল করার জন্য দলীয় নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানান। দু-একজন নেতা কাউন্সিলের তারিখ পরিবর্তনের দাবি জানালে তিনি জানান, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে আগামী ১১ আগস্ট এ তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। সম্মেলন পেছানোর কোনো সুযোগ নেই। সম্মেলনে ভার্চুয়ালি লন্ডন থেকে প্রধান অতিথি হিসেবে যুক্ত থাকবেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
এ ছাড়া বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আব্দুস সালামসহ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ও বিভাগীয় নেতা সম্মেলনে উপস্থিত থাকবেন।
জানা গেছে, ২০১২ সালের পর জেলা বিএনপির কোনো কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়নি। সর্বশেষ কমিটিতে মো. নজমুল হক সনি সভাপতি ও জাহিদুল ইসলাম ধলুকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি গঠন করা হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি জমা দেয়ার পর ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা আসায় আর পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়নি। এরপর মাস্টার হাফিজুর রহমানকে আহ্বায়ক ও নাসির উদ্দিনকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এই আহ্বায়য়ক কমিটি জেলার ১৪টি ইউনিটের মধ্যে শুধু মহাদেবপুর উপজেলা বিএনপির কমিটি গঠন ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখতে না পারায় ওই কমিটি বাতিল করে মো. আবু বক্কর সিদ্দিক নান্নুকে আহ্বায়ক ও বায়েজিদ হোসেন পলাশকে সদস্য সচিব করে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দেয় বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি।
জেলা বিএনপির সদস্য সচিব বায়েজিদ হোসেন পলাশ বলেন, আমরা দায়িত্বভার পাওয়ার পরে নওগাঁর ১১ উপজেলা ও তিনটি পৌরসভার ১৪ ইউনিট ত্যাগী, পরিশ্রমী নেতাদর সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা চেষ্টা করেছি। ইতোমধ্যে ৯৯টি ইউনিয়নের ইউনিয়ন বিএনপির কমিটি গঠন সম্পন্ন হয়েছে। বিএনপি একটি বড় দল এ দলে একাধিক প্রার্থী দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে মাঠে সরব আছেন। ১১ আগস্ট সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত নওগাঁ কনভেনশন সেন্টারে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ভোট গণনার পর বিকেলে দ্বিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।
মান্দা উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ডা. ইকরামুল বারী টিপু অভিযোগ করেন, দীর্ঘ ১৫ বছর পর জেলা বিএনপির কাউন্সিল হতে যাচ্ছে-এতে আমরা দলীয় নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত। কিন্তু বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা যেভাবে সাজানো পাতানো কাউন্সিল করার ছক সাজিয়েছেন তা দলের জন্য মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনবে। বর্তমান আহ্বায়ক কমিটি বিভিন্ন উপজেলায় একতরফা উপজেলা কমিটি তৈরি করে দলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছে। নিজেদের পদ-পদবি করায়ত্ত করতে তারা এমনটা করেছে। অথচ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি যখন গঠিত হয় তখন কেন্দ্র থেকে চিঠি দেয় যে, আহ্বায়ক হলে জেলা কমিটির সভাপতি হতে পারবেন না। কিন্তু এখন সেটা আর কেউ মানছে না। এসব বিষয় বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাবে দেখা দরকার।
যুগ্ম আহ্বায়ক আমিনুল হক বেলাল বলেন, ১১ উপজেলা ও তিনটি পৌরসভাসহ ১৪টি ইউনিটের ভোটার সংখ্যা এক হাজার ৪১৪ জন। প্রতীক বরাদ্দ নিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালাতে সময় মাত্র পাঁচ দিন। এতে এক হাজার ৪১৪ ভোটারকে তাদের করণীয়, দিকনির্দেশনা এবং প্রতীক বুঝাতে প্রার্থীদের খুব বেগ পেতে হচ্ছে।
সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম ধলু বলেন, সময় স্বল্পতার কারণে প্রার্থীরা প্রজেকশন মিটিংয়ের মাধ্যমে এক দিনে তিনটি উপজেলায় প্রচার-প্রচারণা অনুষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। প্রজেকশন মিটিংয়ে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং তিনটি সাংগঠনিক সম্পাদক পদপ্রার্থীরা এক মঞ্চে থেকে নিজ নিজ প্রচার-প্রচারণা চালাবেন। প্রতিটি প্রার্থীকেই কথা বলা ও তার পক্ষে প্রচার চালানোর জন্য ন্যূনতম একটা সময় দেওয়া হবে। এ জন্য পাঁচদিন সময় হাতে থাকলেও প্রচার প্রচারণায় কোনো সমস্যা হবে না।
আহ্বায়ক আবু বক্কর সিদ্দিক নান্নু বলেন, দ্বিবার্ষিক সম্মেলন কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক আগামী ১১ আগস্ট ব্যালট এবং প্রতীকের মাধ্যমে ভোট অনুষ্ঠিত হবে। শনিবার রাতে নির্বাচন প্রস্তুত কমিটির প্রধান বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি রেজাউর করিম বাদশা নওগাঁয় প্রথম বারের মতো আহ্বায়ক কমিটি ও প্রার্থীদের নিয়ে মতবিনিময় করেছেন।
কতজন প্রার্থী দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলে অংশ গ্রহণ করছেন জানতে চাইলে আবু বক্কর সিদ্দিব নান্নু বলেন, সভাপতি পদে সাকজন, সাধারণ সম্পাদক পদে চারজন এবং সাংগঠনিক সম্পাদকের দুটি পদে আটজন মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন এবং বৈধ প্রার্থী হিসেবে তাদের মধ্যে প্রতিক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
সম্মেলনে সভাপতি পদে প্রার্থী কেন্দ্রীয় বিএনপির সহসমবায়বিষয়ক সম্পাদক নজমুল হক সনি, জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম ধলু, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু বক্কর সিদ্দিক নান্নু, সাবেক আহ্বায়ক হাফিজুর রহমান মাস্টার, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদ হাসান তুহিন,পৌর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক মো. আব্দুস শুকুর, সাবেক কোষাধ্যক্ষ এস এম মামুনুর রহমান ও সাবেক সদস্য এ বি এম আমিনুর রহমান। সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী বায়েজিদ হোসেন পলাশ, মামুনুর রহমান রিপন, আমিনুল হক বেলাল ও শহিদুল ইসলাম টুকু। সাংগঠনিক সম্পাদকের দুটি পদের জন্য প্রার্থী শফিউল আযম রানা, নুর ই আলম মিঠু, ফরিদুজ্জামান ফরিদ, খায়রুল আলম গোল্ডেন, শবনম মোস্তারি কলি, সুলতান মামুনুর রশীদ, কামরুজ্জামান কামাল ও জহুরুর হক।