‘রাজাকারের বাচ্চা-নাতিপুতি’ আখ্যা দেওয়াই আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট

জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে হামলা, গুলিবর্ষণ, হত্যাসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন নাহিদ ইসলাম। তিনি জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১নং সমন্বয়ক এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক। সাক্ষীর জবাববন্দিতে তিনি জুলাই আন্দোলনের সূচনা, আন্দোলনকারীদের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা, শহীদ পরিবারের আর্তনাদ এবং আন্দোলন দমাতে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে গুম-খুন ও দমন-পীড়নের নানা চিত্র তুলে ধরেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে আজ বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সাক্ষীর জবানবন্দি দেন নাহিদ ইসলাম।
জুলাই আন্দোলনের সুচনা কীভাবে
সাক্ষীর জবানবন্দিতে এনসিপির আহ্বায়ক ও জুলাই আন্দোলনের ১নং সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী। আমি বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক। ২০২৪ সালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১নং সমন্বয়ক ছিলাম। ২০১৮ সালে আমি প্রথম কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হই। ঐ সময় কোটা সংস্কারের জন্য একটি বড় ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। ২০১৮ সালের ৮ এপ্রিল এই আন্দোলন দমনের জন্য পুলিশ ও ছাত্রলীগ শাহবাগ এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে। পুলিশ রাবার বুলেট, টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। ছাত্রলীগ রাতের বেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে গিয়ে আক্রমণ করে।’
সাক্ষীর জবানবন্দিতে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘এ হামলার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন আরও তীব্র হয়। আন্দোলনের একপর্যায়ে শেখ হাসিনা সংসদে কোটা বাতিলের ঘোষণা দিতে বাধ্য হন। যদিও আমরা চেয়েছিলাম কোটা সংস্কার, তবে সরকার কোটা পদ্ধতি সম্পূর্ণ বাতিল করে। তবুও আমরা এটিকে আপাতত মীমাংসা হিসেবে ধরে নিয়েছিলাম। এই ঘোষণা দেওয়া সত্ত্বেও এই আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীদের গ্রেপ্তার শুরু করে এবং ছাত্রলীগ তাদের ওপর হামলা করে। পরবর্তীতে সরকার কোটা পদ্ধতি বাতিল করে গেজেট প্রকাশ করে। পরবর্তীতে সরকারের আচরণে আমরা বুঝতে পারি, সরকার আন্দোলন দমনের জন্য কোটা বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তারা কোটা পদ্ধতি বাতিল চায়নি। কিছুদিন পর শেখ হাসিনা একটি সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেন, আমি রাগের বশবর্তী হয়ে কোটা বাতিলের কথা বলেছি।’
নাহিদ ইসলাম বলেন, “আমরা ইতোমধ্যে আশঙ্কা করেছিলাম, কোটা প্রথা আবার ফিরে আসতে পারে। ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন হয়। আমি সে নির্বাচনে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্যানেল থেকে কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করি। নির্বাচনে অনিয়মের মাধ্যমে আমাদেরকে জিততে দেওয়া হয়নি। বেশিরভাগ পদে ছাত্রলীগকে জিতিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের গণরুম-গেস্টরুম নির্যাতন কালচারসহ অন্যান্য অনিয়ম, অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হই। ২০২৩ সালে আমরা ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’ নামে একটি ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করি। ছাত্রদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজ করা এবং বিভিন্ন অনিয়ম দূর করাই ছিল এই সংগঠনের মূল লক্ষ্য। একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০২৪ সালের ৫ জুন সরকারের কোটা বাতিল সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন বাতিলপূর্বক কোটা প্রথা পুনঃবহাল করেন। ঐ তারিখেই আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করি। পরবর্তীতে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও এই রায়ের প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়। আমরা হাইকোর্টের উক্ত রায়টি স্থগিত চেয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলকে স্মারকলিপি প্রদান করি। এরপর সরকারকে ৩০ জুনের মধ্যে কোটা সংস্কার সংক্রান্ত সমস্যা সমাধান করার জন্য সরকারকে আলটিমেটাম দিয়েছিলাম।”
আদালতকে ব্যবহার করে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা
নাহিদ ইসলাম সাক্ষীর জবানবন্দিতে বলেন, ‘৩০ জুনের মধ্যে সরকার কোনোরূপ সাড়া না দেওয়ায় আমরা (২০২৪ সালের) ১ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ২০১৮ সালে জারিকৃত পরিপত্র পুনঃবহালপূর্বক কোটা প্রথার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে আন্দোলন শুরু করি। ২, ৩, ৪ জুলাই আমাদের আন্দোলনের ধারাবাহিক কর্মসূচি ছিল। ৪ জুলাই আপিল বিভাগে কোটা সংক্রান্ত বিষয়ে আবেদনের শুনানি ও আদেশ প্রদানের কথা ছিল, কিন্তু সেদিন তা হয়নি। আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন বিধায় তাদের কিছু করার নেই। কোনো বক্তব্য থাকলে তা আদালতে গিয়ে বলতে হবে। তখন আমরা জানতাম, বিচার বিভাগকে দলীয়করণ করা হয়েছে। বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে সরকার পরিকল্পিতভাবে কোটা প্রথা পুনঃবহাল করে। সে কারণে আদালতে না গিয়ে আমরা রাজপথে আন্দোলন অব্যাহত রাখি।’
জুলাইয়ে আন্দোলন তীব্র করতে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি
সাক্ষী নাহিদ ইসলাম বলেন, “আন্দোলন তীব্রতর করার লক্ষ্যে ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে ৭ জুলাই সারা দেশে একটি কর্মসূচি ঘোষণা করি। সারা দেশের শিক্ষার্থীরা আমাদের কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। ১০ জুলাই আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত না করে এক মাসের স্থিতাবস্থার আদেশ জারি করে। আমরা এতে হতাশ হই এবং নিশ্চিত হই, বিচার বিভাগ থেকে এ বিষয়ে কোনো সমাধান পাওয়া যাবে না। অতঃপর আমাদের দাবি কিছুটা পরিবর্তন করে সরকারি চাকরিতে সব পর্যায়ে কোটা প্রথার যৌক্তিক সংস্কার দাবি করি। আন্দোলনের এ পর্যায়ে আমরা বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হই। আমরা কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর গেটগুলো ছাত্রলীগ বন্ধ করে দেয়, যাতে ছাত্ররা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে না পারে। আমাদের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা দেওয়া হয়। সারা দেশেই এ ধরনের বাধা সৃষ্টি করা হয়েছিল। তবুও সব বাধা অতিক্রম করে আমরা আন্দোলন অব্যাহত রাখি। সারা দেশের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের যুক্ত করে আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি সমন্বয়ক কমিটি ঘোষণা করি। ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি বরাবর একটি স্মারকলিপি প্রদান করি।’
‘রাজাকারের বাচ্চা- নাতিপুতি’ গালাগালে আন্দোলন রূপ নেয়ত্রাইবুনালে
ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী নাহিদ ইসলাম বলেন, “১৪ জুলাই রাতে শেখ হাসিনা একটি সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী ছাত্রদেরকে ‘রাজাকারের বাচ্চা’ এবং ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ অভিহিত করে কোটা প্রথার পক্ষে অবস্থান নেন। মূলত এই বক্তব্যের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণের একটি বৈধতা প্রদান করা হয়। কারণ আমরা সবসময় দেখেছি, সরকারের বিরুদ্ধে কোনো ন্যায্য আন্দোলন করা হলে তাদেরকে ‘রাজাকার’ আখ্যা দিয়ে আন্দোলনের ন্যায্যতা নস্যাৎ করা হতো। ছাত্রদেরকে ‘রাজাকারের বাচ্চা’ এবং ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ আখ্যায়িত করায় সমগ্র দেশের ছাত্র-ছাত্রীরা অপমানিত বোধ করে। সেই রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতিবাদমুখর হয়ে রাস্তায় নেমে আসে। শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল—উক্তরূপ বক্তব্য প্রত্যাহারপূর্বক আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট শেখ হাসিনাকে ক্ষমা চাইতে হবে। ১৫ জুলাই আমরা বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেই। একই দিনে ছাত্রলীগ পাল্টা কর্মসূচির ডাক দেয়। সেদিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঘোষণা দেন, আন্দোলন দমনের জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট। তার এই ঘোষণায় উজ্জীবিত হয়ে ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ করে ব্যাপক নির্যাতন চালায়। নারী শিক্ষার্থীদের ওপর ব্যাপক হামলা চালানো হয়, কারণ তারা আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে ছিলেন।’
ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে ছাত্রলীগ-সন্ত্রাসীদের হামলা
আদালতে নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, ‘হামলাকারীদের মধ্যে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম, সাধারণ সম্পাদক ইনান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি শয়ন, সাধারণ সম্পাদক সৈকত এই হামলায় নেতৃত্বদান করে। তারা বাহির থেকেও সন্ত্রাসীদের এনে জড়ো করেছিল। এই হামলায় বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর তারা নির্যাতন চালায় এবং চিকিৎসা প্রদানে বাধা দেয়। এরপর ১৬ জুলাই আমরা এই হামলার প্রতিবাদে সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেই। এ তারিখে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। চট্টগ্রামে ওয়াসিমসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মোট ছয়জন ঐদিন আন্দোলনে শহীদ হন।’
আন্দোলন প্রত্যাহারে ডিজিএফআইয়ের চাপ প্রয়োগ
জবানবন্দিতে সাক্ষী নাহিদ ইসলাম বলেন, “এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ১৭ জুলাই আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশে গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা দেই। তার পরিপ্রেক্ষিতে ইউজিসি দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা দেয়। সেদিন যাত্রাবাড়ীতে একজন আন্দোলনকারীকে হত্যা করা হয়। সেদিন বিজিবি, পুলিশ ও র্যাব সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় ঘেরাও করে ফেলে। গায়েবানা জানাজা শেষে কফিন মিছিল শুরু করলে পুলিশ মিছিলের ওপর সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং পুলিশ আমাদেরকে হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়। সেদিন ডিজিএফআই আমাদেরকে কর্মসূচি প্রত্যাহার এবং সরকারের সঙ্গে সংলাপের জন্য চাপ দেয়। হলের বিদ্যুৎ, পানি ও খাবার সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরকারের সঙ্গে সংলাপে আমরা অস্বীকৃতি জানাই এবং বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার দাবি জানাই। ১৭ জুলাই রাতে দেশব্যাপী ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করি। আমাদের ভাই-বোনদের হত্যা করা হয়েছে বিধায় আমরা সারা দেশের সব শিক্ষার্থী এবং সর্বস্তরের জনগণকে কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানাই। আমাদের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ জুলাই সারা দেশের সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে। বিশেষত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীরা সেদিন রাজপথে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলে।”
গ্রেপ্তার এড়াতে আমরা আত্মগোপনে
আন্দোলনের ১নং সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আন্দোলনের নেতারা জীবনের হুমকির মুখে পড়ি এবং গ্রেপ্তার এড়াতে আমরা আত্মগোপনে চলে যাই। সেদিন (১৮ জুলাই) সারা দেশে অনেক ছাত্র-জনতা আহত ও নিহত হয়। সেদিন রাতে সারা দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। একইভাবে ১৯ জুলাই পুলিশ এবং আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপরে নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে অনেক ছাত্র-জনতা আহত ও নিহত হয়। ১৯ জুলাই আমরা বুঝতে পারি, সরকার ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গেছে। আমাদের আন্দোলনের এবং আহত ও নিহতদের কোনো খবর মিডিয়ায় প্রচার হচ্ছিল না।’
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের সাক্ষ্য গ্রহণের এ পর্যায়ে আজ বুধবার বিকেল সাড়ে চারটায় আদালত আজকের জন্য মুলতবি ঘোষণা করা হয়। আগামীকাল পুনরায় এ মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
ট্রাইব্যুনালে আজ আংশিক সাক্ষ্য দেওয়ার পর নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আন্দোলনের সূচনা ও আন্দোলনে পুলিশ-শেখ হাসিনাসহ যারা অপরাধী তাদের অপরাদের বর্ণনা তুলে ধরেছি। আমি দাবি জানাই, শুধু শেখ হাসিনার মামলা নয়, ট্রাইব্যুনালে গুমের সব মামলার বিচার করতে হবে। শুধু রাজনৈতিক নেতা নয়, পুলিশ ও বিভিন্ন সংস্থার লোকজন, আর্মির যারা গুম, অপরাধের সঙ্গে জড়িত—তাদেরও বিচার করতে হবে।’
গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আমলে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এই পাঁচটি অভিযোগে তাদের বিচার করা হচ্ছে। অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
গত ১ জুন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এই আসামিদের বিরুদ্ধে পাঁচ অভিযোগ আমলে নেন। আমলে নেওয়া পাঁচ অভিযোগ হলো—
প্রথম অভিযোগ
শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আমলে নেওয়া অভিযোগের প্রথমটিতে বলা হয়, শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই চীন থেকে ফিরে গণভবনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। এ সময় আন্দোলনরত ছাত্রদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে অভিহিত করে ছাত্র- জনতার ওপর নির্যাতনের উসকানি দেওয়া হয়। আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন তার অধীনস্থ বাহিনীকে হামলার জন্য সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে নির্দেশ দেন। এতে করে রাজধানীর মিরপুর, আশুলিয়া, যাত্রাবাড়ি গাজীপুরসহ সারা দেশে নিহতদের জানাজা ও সৎকার করা, হাসপাতালে লাশ হস্তান্তরে বাধা প্রদান করা হয়। এসব কর্মকাণ্ড করে আসামিরা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।
দ্বিতীয় অভিযোগ
জুলাই- আগস্ট আন্দোলনের সময় সুপিরিয়র কমান্ডার শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য (ভিসি) এস এম মাকসুদ কামাল ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। এসব ফোনকলে আন্দোলন ঠেকাতে ছাত্র-জনতার ওপর মারণাস্ত্রের ব্যবহার করার কথা বলা হয়। নির্দেশ পেয়ে হেলিকপ্টার থেকে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করা হয়। এসব ফোনের অডিও ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়েছে। নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। এ ছাড়া সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বাহিনীকে মারণাস্ত্র ব্যবহারের জন্য নির্দেশনা দিয়ে প্রায় দেড় ছাত্র-জনতাকে হত্যা এবং ২৫ হাজার মানুষকে আহত করে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।
তৃতীয় অভিযোগ
১৬ জুলাই রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে তার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন চারবার পরিবর্তন করা হয়। এ ঘটনায় নিহত আবু সাঈদের সহপাঠীদের আসামি করে মামলা করে পুলিশ। সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের নির্দেশে এই হত্যা, তথ্য গোপন ও মিথ্যা মামলা করা হয়। এসবের নির্দেশ দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন তিন আসামি।
চতুর্থ অভিযোগ
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা এক দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে আসার সময় চাঁনখারপুল এলাকায় শহীদ আনাসসহ ছয়জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে এ ছয়জনকে হত্যা করে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
পঞ্চম অভিযোগ
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা এক দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে আসার সময় আশুলিয়ায় ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে ভস্মীভূত করা হয়। এ ঘটনার নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামি মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। এই আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তির আবেদন করে প্রসিকিউশন।