সরকার গঠনে ৪ আগস্ট ড. ইউনূসের সঙ্গে যোগাযোগ
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে হামলা, গুলিবর্ষণ, হত্যাসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জবানবিন্দ শেষ করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম। এ নিয়ে ৪৭ জন সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করেছেন।
বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) দ্বিতীয় দিনের জবানবন্দিতে নাহিদ ইসলাম আন্দোলন দমনে ডিজিএফআইয়ের বলপ্রয়োগ, ডিবির তুলে নিয়ে গুম ও নির্যাতন, ৩০ ঘণ্টার অধিক সময় ডিবি অফিসে অনশন পালন, ৫ আগস্ট মানুষের ঢাকায় আসা দেখে শেখ হাসিনার পলায়ন ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞ, সরকার গঠনে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়গুলো তুলে ধরেন।
নির্যাতন করে পূর্বাচলে চোখ বাঁধা অবস্থায় রেখে যায়
দ্বিতীয় দিনের জবানবন্দিতে মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, মিডিয়ার মাধ্যমে কোনো সংবাদ না পাওয়ায় আন্দোলনের অন্যান্য সমন্বয়কদের সঙ্গে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে ১৮ ও ১৯ জুলাই দেশব্যাপী যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চলেছে সে সম্পর্কে জানতে পারি। ১৯ তারিখ বিকেলে সমন্বয়ক আব্দুল কাদেরের সঙ্গে আমার কথা হয়। আমাদের পরামর্শ মতো সে ৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। সেদিন বিকেলে আমি নন্দীপাড়ায় আমার এক বন্ধুর বাসায় আশ্রয় নিই। পরবর্তীতে সমন্বয়ক হাসনাত ও সারজিসের সঙ্গে আমার কথা হয়। তখন তারা ডিজিএফআইয়ের হেফাজতে ছিল যা আমি জানতাম না। আমি অন্যান্য সমন্বয়ক ও ছাত্র নেতাদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে ২০ জুলাই কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেই। সকল মিডিয়াতে এই ঘোষণাটি পাঠালেও কোনো ইলেকট্রনিক মিডিয়া তা প্রচার করেনি। সেদিন দিবাগত রাতে আমি জানতে পারি যে, সরকার কারফিউ ঘোষণা করেছে। কারফিউতে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ ছিল। নন্দীপাড়ার বন্ধুর বাসাতেই আমি রাতে অবস্থান করি। রাত আনুমানিক আড়াইটার সময় ডিবি পুলিশ পরিচয়ে কয়েকজন ব্যক্তি সে বাসায় প্রবেশ করে আমাকে হাতে হ্যান্ডকাফ, চোখে কালো কাপড় বেঁধে আটক করে একটি প্রাইভেট কারে করে তুলে নিয়ে যায়। প্রাইভেট কারে উঠিয়েই আমাকে মারধর করতে থাকে। এরপর আমাকে একটি রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাকে কিছুক্ষণ পর পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় আমার হাতে হ্যান্ডকাফ ও চোখে কালো কাপড় বেঁধে রাখতো।
আন্দোলনে কারা জড়িত, কেন আন্দোলন বন্ধ হচ্ছে না এসব জিজ্ঞাসা করতো। তারা আমাকে শারীরিক নির্যাতন করতে থাকে। নির্যাতনের ফলে আমি কয়েকদফা জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তারা আমাকে জানায়, আমাকে গুম করা হয়েছে, যদি আন্দোলন না থামাই তাহলে আমি আর কখনো বের হতে পারবো না। আনুমানিক ২৪ ঘণ্টা পর শেষ রাতের দিকে আমাকে পূর্বাচল এলাকায় একটি ব্রিজের পাশে চোখ বাঁধা অবস্থায় রেখে চলে যায়। সেখান থেকে আমি আমার বনশ্রীর বাসায় যাই। আমার পরিবার আমাকে ঢাকার গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে ভর্তি করে।
হাসানাত-সারজিসকে ডিজিএফআই তুলে নিয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে বসায়
জবানবন্দিতে মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, প্রেস ব্রিফিং করে আমাকে গুম ও নির্যাতনের কথা প্রকাশ করি। গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে থাকা অবস্থায় সেদিনই আমি জানতে পারি যে, অন্যান্য অনেক সমন্বয়ককেও গুম করা হয়েছে। আরও জানতে পারি যে, সমন্বয়ক হাসানাত, সারজিস ও হাসিবকে ডিজিএফআই জোর করে তুলে নিয়ে তিন জন মন্ত্রীর সঙ্গে বসিয়েছে। সেই ছবি মিডিয়ায় প্রচার করা হয়।
২২ জুলাই ডিজিএফআই অফিসার লে. কর্নেল সারোয়ার হাসপাতালে আমার রুমে জোরপূর্বক প্রবেশ করে আন্দোলন স্থগিত করার জন্য চাপ দেয় এবং হুমকি দিয়ে বলে, গুম হওয়া অন্যান্য সমন্বয়কদের যদি জীবিত ফিরে পেতে চাই, তবে আন্দোলন প্রত্যাহার করতে হবে।
ডিজিএফআইয়ের কথামতো সংবাদ সম্মেলনে কথা না বলায় তারা আমাকে পুনরায় গুম করার হুমকি দেয়। ২৪ জুলাই সমন্বয়ক বাকের ও আসিফকে গুম অবস্থা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। তখন তারা এই হাসপাতালে ভর্তি হয়। তখন থেকে হাসপাতালকে সম্পূর্ণ নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। হাসপাতালে ইন্টারনেট, টেলিফোন, পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমাদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। আমাদের সাথে কাউকে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয় না। ডাক্তার ও নার্সদেরকে আমাদের কোনো তথ্য প্রদানে সহযোগিতা না করতে ভয়-ভীতি দেখানো হয়।
৩০ ঘণ্টার অধিক সময় ডিবি অফিসে অনশনে ছিলাম
ডিবি অফিসে মো. নাহিদ ইসলাম নির্যাতনের চিত্র তুলে বলেন, ২৬ জুলাই দুপুরের দিকে ডিবি পরিচয়ে কয়েকজন ব্যক্তি হাসপাতালে এসে আসিফ, বাকের ও আমাকে একটি মাইক্রোতে করে ডিবি অফিসে তুলে নিয়ে যায়। সেখানে ডিবি প্রধান হারুন আমাদেরকে আন্দোলন স্থগিত করতে বলে অন্যথায় আমাদের বিরুদ্ধে এই আন্দোলনের কারণে বিভিন্ন মামলা দায়ের করা হবে বলে হুমকি দেয়। আমরা প্রথমে রাজি হইনি। পরদিন সমন্বয় হাসনাত ও সারজিসকে ডিবি অফিসে তুলে আনা হয়। পরবর্তীতে সমন্বয়ক নুসরাতকেও ডিবি অফিসে নিয়ে আসা হয়। সেখানে আমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ ও শারীরিক নির্যাতন করা হয়। আমাকে ঔষধ সরবরাহ করা হয়নি। আমাদের অভিবাবকদেরকেও সেখানে আনা হয়। আন্দোলন বন্ধ করার জন্য চাপ দেওয়া হয় এবং আন্দোলন বন্ধ না করলে বিভিন্ন রকম মামলা, নির্যাতন ও হয়রানির হুমকি দেওয়া হয়। আমাদেরকে বলা হয় যে, আমরা আন্দোলন প্রত্যাহার না করলে আরও নারী সমন্বয়কদের তুলে আনা হবে ও নির্যাতন করা হবে। এক পর্যায়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের জন্য তাদের লিখিত একটি বক্তব্য আমাকে দিয়ে জোরপূর্বক পাঠ করিয়ে তা ভিডিও করে মিডিয়ায় প্রচার করা হয়। তারা আমাদেরকে জানায়, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশনায় আমাদেরকে তুলে আনা, আটক রাখা ও নির্যাতন করা হয়েছে।
এক পর্যায়ে ডিবি প্রধান হারুন আমাদেরকে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবটি আমরা প্রত্যাখ্যান করি এবং আমরণ অনশন শুরু করি। আমরা প্রায় ৩০ ঘণ্টার অধিক সময় ডিবি অফিসে অনশনে ছিলাম। ডিবি অফিসে অবস্থানকালে জানতে পারি যে, আমাদের মুক্তির জন্য হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের হয়েছে এবং আন্দোলন চলমান আছে। অসুস্থ অবস্থায় ১ আগস্ট আমাদেরকে ডিবি অফিস থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
১ আগস্ট একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আমরা ছয়জন সমন্বয়ক জানাই যে, ডিবি অফিসে আমাদেরকে দিয়ে জোরপূর্বক আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেই।
এর আগে ১৭ জুলাই গায়েবানা জানাজা কর্মসূচি থেকে ছাত্রনেতা আক্তার হোসেনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
আমরা বাইরে এসে দেখতে পাই অন্য সমন্বয়ক- মাহিন, রিফাত, কাদের, মাসুদরা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। অন্যান্য সমন্বয়ক ও অন্যান্য ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্র সংগঠন যেমন, ছাত্রদল, ছাত্রশিবির এবং বামপন্থি কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে ৩ আগস্ট শহীদ মিনারে সরকার পতনের এক দফা ঘোষণা করি। এক দফায় আমরা ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থার বিলোপ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানাই। সরকার পতনের এক দফা দাবিতে দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করি।
৪ আগস্ট শাহবাগে অবস্থান ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করি। ঐ দিন ৬ আগস্ট "মার্চ টু ঢাকা" কর্মসূচি ঘোষণা করি। সরকার কারফিউ ঘোষণা করে এবং দেশব্যাপী ব্যপক হত্যাকাণ্ড চালায়। আমরা জানতে পারি যে, ৬ তারিখ মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ব্যর্থ করার উদ্দেশ্যে সরকার ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। আরও জানতে পারি যে, সরকার মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট বন্ধ করে দিবে, আমাদেরকে হত্যা বা গুম করা হতে পারে। তাই আমরা আমাদের "মার্চ টু ঢাকা" কর্মসূচি এক দিন এগিয়ে ৫ আগস্ট নির্ধারণ করি। ঘোষণা দেই।
"মার্চ টু ঢাকা" কর্মসূচি সফল করার উদ্দেশ্যে সমন্বয়কদের পক্ষে মাহফুজ আলম অন্যান্য ছাত্রসংঠন এবং নাগরিক সমাজের সঙ্গে লিয়াজোঁ করছিলেন। পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে আমরা নতুন সরকার গঠনের জন্য ড. ইউনূস স্যারের সঙ্গে আলোচনা করি। তাঁকে নতুন সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালনের প্রস্তাব দেই।
৫ আগস্ট মানুষের ঢাকায় আসা দেখে হাসিনা পালিয়ে যায়
৫ আগস্ট সারা দেশের মানুষ ঢাকায় আসতে থাকে। আমরা শাহবাগে অবস্থান গ্রহণের চেষ্টা করি। শহীদ মিনার ও চানখারপুল এলাকায় আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালানো হয়। সেনাবাহিনী এক পর্যায়ে রাস্তা ছেড়ে দিলে আমরা শাহবাগে অবস্থান গ্রহণ করি। কিছুক্ষণের মধ্যে শাহবাগ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। আমরা শুনতে পাই ঢাকার প্রবেশ মুখগুলো যেমন, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়াসহ বিভিন্ন এলাকা দিয়ে লাখ লাখ মানুষ ঢাকায় প্রবেশ করছে। শাহবাগ থেকে মিছিল নিয়ে আমরা গণভবনের উদ্দেশে রওনা দেই। পথিমধ্যে সংবাদ পাই যে, গণবিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে হেলিকপ্টারে করে পালিয়ে গেছে। আরও শুনতে পাই যে, ছাত্রজনতা গণভবনে প্রবেশ করেছে।
সন্ধ্যায় আমরা সংবাদ সম্মেলন করে অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠনের এবং সকল রাজবন্দিদের মুক্তির দাবি জানাই। আমরা কোনো ধরনের সেনা শাসন বা সেনা সমর্থিত শাসন মেনে নিবো না বলে ঘোষণা দেই।
হাসিনাসহ হত্যাযজ্ঞ অপরাধের কঠোর শাস্তি দাবি করছি
৫ আগস্ট ঢাকাসহ সারা দেশে সরকার কর্তৃক ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের সংবাদ পাই। সেদিন আমাদের বহুসংখ্যক আন্দোলনকারী ছাত্রজনতা শহীদ ও আহত হয়।
পুরো আন্দোলনের সময় জুড়ে আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নির্বিচারে গুলি চালায়। হেলিকপ্টার থেকেও আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালানো হয়।
আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সংগঠনের সন্ত্রাসীরা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালায় ও নির্যাতন করে। আন্দোলনকারীদের ব্লক রেইড দিয়ে গণগ্রেপ্তার করা হয়, গুম করা হয়। হেফাজতে নির্যাতন করা হয়। অসংখ্য মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়। আহতের চিকিৎসা প্রদানে নানাভাবে বাধা দেওয়া হয়। শহীদদের দাফনে বাধা দেওয়া হয়। লাশ গুম করা হয় ও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। শহীদ ও আহতদের পরিবারকে হুমকি দেওয়া হয়।
এ সকল ঘটনার জন্য শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধানদের এবং যারা হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনে অংশগ্রহণ করেছে তাদের দায়ী করছি। যেহেতু শেখ হাসিনা সরকার প্রধান ছিলেন এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান ছিলেন, সেহেতু তাদের নির্দেশেই হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। তারা ক্ষমতা পাকাপোক্ত ও নিরঙ্কুষ করতেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
পরবর্তীতে বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারি যে, শেখ হাসিনা হেলিকপ্টার ও লেথাল উইপেন ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে। এই ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও নৃশংসতা বন্ধের জন্য সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা ও সংশ্লিষ্ট প্রধানগণ এই ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ, নৃশংসতা বন্ধের জন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। মানবতাবিরোধী এমন অপরাধের জন্য যারা দায়ী তাদের বিচার চাই এবং কঠোর শাস্তি দাবি করছি। ভিকটিমরা যাতে ন্যয়বিচার পায় সেই প্রার্থনা করছি।
তদন্তকারী কর্মকর্তা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এই আমার জবানবন্দি। পরে তাকে জেরা করেন শেখ হাসিনার রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী।
গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আমলে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এই পাঁচটি অভিযোগে তাদের বিচার করা হচ্ছে। অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
গত ১ জুন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এই আসামিদের বিরুদ্ধে পাঁচ অভিযোগ আমলে নেন। আমলে নেওয়া পাঁচ অভিযোগ হলো—
প্রথম অভিযোগ
শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আমলে নেওয়া অভিযোগের প্রথমটিতে বলা হয়, শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই চীন থেকে ফিরে গণভবনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। এ সময় আন্দোলনরত ছাত্রদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে অভিহিত করে ছাত্র- জনতার ওপর নির্যাতনের উসকানি দেওয়া হয়। আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন তার অধীনস্থ বাহিনীকে হামলার জন্য সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে নির্দেশ দেন। এতে করে রাজধানীর মিরপুর, আশুলিয়া, যাত্রাবাড়ি, গাজীপুরসহ সারা দেশে নিহতদের জানাজা ও সৎকার করা, হাসপাতালে লাশ হস্তান্তরে বাধা প্রদান করা হয়। এসব কর্মকাণ্ড করে আসামিরা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।
দ্বিতীয় অভিযোগ
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় সুপিরিয়র কমান্ডার শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য (ভিসি) এস এম মাকসুদ কামাল ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। এসব ফোনকলে আন্দোলন ঠেকাতে ছাত্র-জনতার ওপর মারণাস্ত্রের ব্যবহার করার কথা বলা হয়। নির্দেশ পেয়ে হেলিকপ্টার থেকে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করা হয়। এসব ফোনের অডিও ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়েছে। নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। এছাড়া সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বাহিনীকে মারণাস্ত্র ব্যবহারের জন্য নির্দেশনা দিয়ে প্রায় দেড় হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা এবং ২৫ হাজার মানুষকে আহত করে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।
তৃতীয় অভিযোগ
১৬ জুলাই রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে তার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন চারবার পরিবর্তন করা হয়। এ ঘটনায় নিহত আবু সাঈদের সহপাঠীদের আসামি করে মামলা করে পুলিশ। সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের নির্দেশে এই হত্যা, তথ্য গোপন ও মিথ্যা মামলা করা হয়। এসবের নির্দেশ দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন তিন আসামি।
চতুর্থ অভিযোগ
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা এক দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে আসার সময় চাঁনখারপুল এলাকায় শহীদ আনাসসহ ছয়জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে এ ছয়জনকে হত্যা করে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
পঞ্চম অভিযোগ
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা এক দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে আসার সময় আশুলিয়ায় ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে ভস্মীভূত করা হয়। এ ঘটনার নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামি মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। এই আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তির আবেদন করে প্রসিকিউশন।