২২ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তদারকির দায়িত্বে ৩ জন!

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) অধীনে সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি স্কুল রয়েছে প্রায় ২২ হাজার। এসব প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে তদারকির দায়িত্বে রয়েছেন মাত্র তিনজন
কর্মকর্তা। অন্যদিকে, আট হাজার সরকারি-বেসরকারি কলেজের বিপরীতে তদারকির দায়িত্ব রয়েছে ৭৮ জনের। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মাউশিতে রয়েছে চাপা ক্ষোভ, কখনও তা হয়েছে সরব।
বৈষম্যহীন প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে মাধ্যমিক পর্যায়ের হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষার মানোন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধার দিকও টেকসইভাবে প্রদর্শিত হবে এমন কাঠামোর প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন শিক্ষাবিদরা। তারা শিক্ষা কাঠামোর গতিশীলতা আনতে মাধ্যমিক স্তরের প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্বিন্যাস জরুরি বলে মনে করেন। এর প্রেক্ষিতে পৃথক অধিদপ্তর গঠনে ২০০৩ সালে মনিরুজ্জামান শিক্ষা কমিশন সুপারিশও করে। তবে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে সেটি থমকে যায়।
শিক্ষকনেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারি মাধ্যমিকের প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষকের জন্য পদোন্নতি-যোগ্য পদ রাখা হয়েছে মাত্র চার শতাংশ। যৌক্তিক কোনো পদসোপান না থাকায় দীর্ঘ ৩২-৩৩ বছর চাকরি করেও অধিকাংশ শিক্ষককে পদোন্নতি ছাড়াই অবসরে যেতে হয়। পদোন্নতি অনিয়মিত বিধায় বেশকিছু পদ খালি পড়ে থাকে। যা পদোন্নতি বঞ্চিতদের হতাশ করার পাশাপাশি মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নে অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। সরকারি মাধ্যমিকে শিক্ষক-কর্মকর্তারা প্রাপ্য বকেয়া টাইমস্কেল, পদমর্যাদা, পদোন্নতি, পদায়নসহ চাকরির বিভিন্নক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে সরকারি মাধ্যমিকে বিদ্যমান বৈষম্য নিরসন জরুরি বলে মনে করছেন তারা। সারাদেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সংখ্যা দুই লাখ ৯৩ হাজার ২৮৯ জন ও শিক্ষার্থী সংখ্যা ৯০ লাখ ৬৩ হাজার ৪২২ জন।
মাউসির তথ্য অনুযায়ী, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউসি) আওতায় রয়েছে ৯টি বিভাগীয় কার্যালয়, ৬৪টি জেলা শিক্ষা অফিস, ৫১৬টি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস, ৬৮৬টি সরকারি কলেজ, ৭০৬টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ১০৪টি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ।
২০১৪ সালের বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্যমতে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২১ হাজার ২৩২, যার মধ্যে কলেজ এক হাজার ৫১৪। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা যথাক্রমে দুই লাখ ৯৩ হাজার ২৮৯ জন এবং ৯০ লাখ ৬৩ হাজার ৪২২ জন। ফলে বিপুল সংখ্যক শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীর জন্য কাঙ্ক্ষিত সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষা কাঠামোর গতিশীলতা আনার জন্য মাধ্যমিক স্তরের প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্বিন্যাস জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন জানুয়ারি ২০২৫ প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে- পৃথক মাধ্যমিক অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। মাধ্যমিক শিক্ষা মাউশির অধীনে থাকার কারণে শিক্ষার মান ক্রমশ কমছে। তাই আলাদা অধিদপ্তর গঠন জরুরি।
জানা যায়, ২০০৩ ও ২০১০ শিক্ষানীতিতে মাধ্যমিকের জন্য আলাদা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার সুপারিশ ছিল। গত ১৫ বছরে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। উল্টো কলেজভিত্তিক নীতির কারণে বঞ্চিত হতে হচ্ছে মাধ্যমিকের শিক্ষকদের। এ ছাড়া মাদ্রাসা ও কারিগরির জন্য আলাদা অধিদপ্তর রয়েছে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ও শিক্ষা প্রশাসনের সংস্কার পরিকল্পনায়ও স্বতন্ত্র মাধ্যমিক অধিদপ্তরের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে।

বর্তমান মাউশিকে দুই ভাগ করে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও কলেজ শিক্ষা অধিদপ্তর নামে দুটি স্বতন্ত্র অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার জন্য গত ৩ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার কাছে মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রস্তাবের সারসংক্ষেপ পাঠানো হয়। দেশের মাধ্যমিক শিক্ষাকাঠামো ব্যবস্থাপনায় গতি আনার লক্ষ্যে এই পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে সারসংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়।
সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতির ২৭ অনুচ্ছেদে মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ের জন্য পৃথক অধিদপ্তর গঠনের সুপারিশ ছিল। সেই আলোকে মাধ্যমিক শাখার জন্য মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং কলেজ পর্যায়ের জন্য উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা অধিদপ্তর করার কথা বলা হয়েছে। এর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কলেজ এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (সিইডিপি) আয়োজিত জাতীয় কর্মশালায় দেওয়া সুপারিশের ভিত্তিতে বিআইএম ফাউন্ডেশন রিসার্চ অ্যান্ড কনসালটেন্সি সার্ভিস সেন্টার (বিএফআরসিএসসি) একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করে। মাউশির আওতায় বিপুলসংখ্যক শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীর প্রত্যাশিত সেবা নিশ্চিত করতে বিদ্যমান প্রশাসনিক কাঠামোকে আরও গতিশীল করতে ওই প্রতিবেদনেও সুপারিশ করা হয়।
এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা ঢাকা অঞ্চলের আহ্বায়ক ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, সারাদেশে সরকারি মাধ্যমিক স্কুল রয়েছে সাত শতাধিক, বেসরকারি এমপিওভুক্ত স্কুল সংখ্যা সাড়ে ২১ হাজার এ ছাড়া হাজার হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুল রয়েছে। এতসব স্কুলকে তদারকির জন্য শিক্ষা অধিদপ্তরে রয়েছে মাত্র তিন জন কর্মকর্তা। এ ছাড়া সরকারি কলেজ রয়েছে সাত শতাধিক। বেসরকারি এমিপওভুক্ত কলেজ রয়েছে প্রায় সাত হাজার। শিক্ষা অধিদপ্তরে কলেজ শাখার জন্য রয়েছে প্রায় ৭৮ জন।
ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, সারাদেশে এত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করা তদারকি ও মনোযোগ দেওয়া একটি অধিদপ্তরের পক্ষে সম্ভব নয়। দুটি পৃথক অধিদপ্তর হলেই দেশে শিক্ষার মানোন্নয়ন আরও বাড়বে। পাশাপাশি মাধ্যমিক শিক্ষকদের মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি (বাসমাশিস) প্রধান সমন্বয়ক ও ঢাকা নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেবেকা সুলতানা এনটিভি অনলাইনকে বলেন, একটি পরিবার যখন অনেক বড় হয়ে যায় বাবা মা সন্তানদের পৃথক পরিবার করে দেন যেন অধিক যত্নশীল হয়ে উঠতে পারে। সারা দেশে হাজার হাজার কলেজের দিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে শিক্ষা অধিদপ্তরে যারা রয়েছেন তারা মাধ্যমিক স্কুলের দিকে মনোযোগ দিতে পারেন না। এতে করে মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকদের পদোন্নোতি, সুযোগ সুবিধা ও শিক্ষার মাননোন্নয়নে তাদের পক্ষে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। মাধ্যমিক স্কুলের একজন শিক্ষক দেখা যায় চাকুরি জীবন শেষ করেও কোন পদোন্নতি পায় না। এটা নিরসন করা উচিত।
এ বিষয়ে শিক্ষা ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক ও মাউশির মাধ্যমিক শাখার পরিচালক অধ্যাপক ড. খান মইনুদ্দিন আল মাহমুদ সোহেল সাংবাদিকদের বলেন, ক্যাডার সদস্যদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে সত্যি, তবে আমরা যেহেতু সরকারি কর্মচারী, তাই সব দিক বিবেচনায় নিতে হয়। মাননীয় শিক্ষা উপদেষ্টা বিষয়গুলো বিস্তারিত জেনে পদক্ষেপ নেবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। সব পক্ষকে নিয়ে আলোচনা করে সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।