জিআই স্বীকৃতি পেল নেত্রকোনার ‘বালিশ মিষ্টি’

নেত্রকোনার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির নাম ‘বালিশ’। এই বালিশ মিষ্টি এ এলাকার নিজস্ব ঐতিহ্য। এটি দেখতে অনেকটা কোল বালিশের মতোই। এই মিষ্টির খ্যাতি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। এই মিষ্টি এতটাই জনপ্রিয় যে, বিভিন্ন উপন্যাস ও কবিতায়ও স্থান পেয়েছে।
এই মিষ্টি সম্প্রতি দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এই জিআই স্বীকৃতি জেলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করল। পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তরের জিআই জার্নালের প্রতিবেদনে বালিশ মিষ্টিকে দেশের ৫৮তম জিআই পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এর আগে দুর্গাপুরের বিজয়পুরের সাদামাটি জিআই স্বীকৃতি পায় ২০২১ সালে। ২০২৫ সালে আরেকটি পণ্যের জিআই স্বীকৃতি সত্যি গর্বের বিষয়।
নেত্রকোনা শহরের বারহাট্টা রোড এলাকায় আনুমানিক ১১০ বছর আগে এই মিষ্টির জন্ম। স্থানীয় মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারক গয়ানাথ ঘোষ প্রথম এই মিষ্টি তৈরি করেন। তবে শহরের সব মিষ্টির দোকানেই পাওয়া যায় এই বালিশ মিষ্টি।
গয়ানাথ ঘোষের তৃতীয় প্রজন্ম এখনও সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। বালিশ মিষ্টি এখন জেলার সামাজিক অনুষ্ঠান, উৎসব ও উপহার-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।

কেউ নেত্রকোনায় বেড়াতে এলে সবাই রসনাতৃপ্তির জন্য চিন্তা করেন বালিশ মিষ্টির কথা। কেউ খেয়ে যান আবার যাওয়ার সময় সঙ্গে করে নিয়েও যান প্রিয়জনদের জন্য।
বালিশ মিষ্টির কদর ঈদ কিংবা-পূজা, জন্মদিন কিংবা বিয়ে আপ্যায়নে চাই বালিশ। আশপাশের জেলা এমনকি প্রবাসীরা প্রবাসে যাওয়ার সময়ও নিয়ে যান এই ঐতিহ্যবাহী বালিশ মিষ্টি।
গয়ানাথ ঘোষ অনেক ধরনের মিষ্টি বানাতেন। এসব মিষ্টি কমবেশি শহরের সব দোকানিই বানাতেন। তিনি চিন্তা করলেন নতুন কিছু করার। সে চিন্তা থেকেই দুধের ছানা দিয়ে বড় করে মিষ্টির কাঠামো তৈরি করলেন। দেখতে অন্য মিষ্টির চাইতে অনেকটা বড় এবং অনেকটা কোল বালিশের মতো। এই মিষ্টি বানিয়ে লোকজনকে দেখালেন এবং খাওয়ালেন। মানুষ তখন মিষ্টির নাম জানতে চাইলে তিনি নাম নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন। পরিবারের লোজনের সঙ্গে আলোচনা করেও এই মিষ্টির নাম তাৎক্ষণিক ঠিক করতে পারলেন না। শেষে বালিশের মতো দেখতে তাই মিল দেখে এলাকার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মরহুম আব্দুস সালাম পেয়ার মিয়া এর নাম দিলেন বালিশ মিষ্টি। আস্তে আস্তে বালিশ নামে পরিচিতি পেল এই মিষ্টি। সেই থেকে আজ পর্যন্ত দেশ-বিদেশে তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে এই বালিশ মিষ্টি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই ভারতে চলে যান গয়ানাথ ঘোষ। চলে যাওয়ার সময় তা শিখে নেন তার মিষ্টি তৈরির কারিগর নিখিল চন্দ্র মোদক। জীবিত থাকা অবস্থায় তিনি বালিশ মিষ্টি তৈরির ধারা অব্যাহত রাখেন শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে। তাঁর মৃত্যুর পর তিন ছেলে বাবুল চন্দ্র মোদক, দিলীপ চন্দ্র মোদক ও খোকন চন্দ্র মোদক আজও বালিশ মিষ্টি তৈরি করে অতীত ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন। বারহাট্টা রোডে রয়েছে তাদের এই বালিশ মিষ্টি তৈরির নিজস্ব কারখানা।
বালিশ মিষ্টির মূল কারিগর বাবুল চন্দ্র মোদক জানান, বালিশ মিষ্টি তৈরি করতে প্রয়োজন মূলত তিনটি উপাদান দুধ, চিনি ও ময়দা। প্রথমে দুধ থেকে তৈরি করা হয় ছানা, ছানা ও ময়দা দিয়ে মণ্ড, আর মণ্ড দিয়ে বানানো হয় বালিশ মিষ্টি। সবশেষে চিনির শিরায় মেশানো হয় ভাজা বালিশ মিষ্টি। তৈরির সময় বালিশকে মুখরোচক করতে প্রয়োগ করা হয় বিশেষ কলাকৌশল। পরিবেশনের আগে বালিশের ওপরে এক ধরনের সুস্বাদু ঘন ক্ষীর বা দুধের মালাইয়ের প্রলেপ দেওয়া হয়। প্রথমে ১০ টাকা ও ২০ টাকায় ছোট ও বড় দুই সাইজের বালিশ তৈরি করা হতো। আর অর্ডার দিয়ে বানাতে হতো ৫০ টাকা দামের বালিশ মিষ্টি। বর্তমানে আগের সেই ১০ বা ২০ টাকা দামের বালিশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ১০০ থেকে ২০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকা দামের বালিশ। বড় মিষ্টিগুলো অর্ডার দিয়ে বানাতে হয়। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় গরমের দিনে বালিশ তিন দিন এবং শীতের দিনে সাত দিন পর্যন্ত ভালো থাকে।
বাবুল মোদক বলেন, দেশি গাভির খাঁটি দুধ ছাড়া বালিশ বানানো হলে প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায় না। আমরা স্থানীয় ব্যাপারীদের কাছ থেকে দেশি গাভির দুধ কিনে থাকি। আমরা সঠিক মান ধরে রাখার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। এই মিষ্টি তৈরির জন্য আমার সঙ্গে কয়েকজন কারিগর নিয়মিত কাজ করে।

গয়ানাথ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের তৃতীয় প্রজন্মের আরেক কর্ণধার বাবুল চন্দ্র মোদক বলেন, বালিশ মিষ্টি জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এ প্রাপ্তিতে আমরা নেত্রকোনাবাসী গর্বিত। মিষ্টির আবিষ্কারক হিসেবে ছিলেন আমার দাদা গয়ানাথ ঘোষ। পরে ১৯৬৫ সাল থেকে আমার বাবা নিখিল চন্দ্র মোদক এবং তারপর আমরা তৃতীয় প্রজন্মের তিন ভাই মিলেমিশে প্রতিষ্ঠান চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের এই বালিশ মিষ্টি জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় আমরা আনন্দিত ও গর্বিত।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন জামান বালিশ মিষ্টির জিআই স্বীকৃতি প্রাপ্তিকে অত্যন্ত আনন্দের বিষয় বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, আগে আমাদের বিজয়পুরের সাদামাটি জিআই নিবন্ধন সনদ পেয়েছে। দ্বিতীয়ত এই বালিশ মিষ্টি সনদ পাওয়ায় নেত্রকোনাবাসীর জন্য এটি একটি গর্বের বিষয়। তিনি বালিশ মিষ্টির গুণগত মান আরও উন্নত করে এটিকে জেলার ব্র্যান্ডিং করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
নেত্রকোনা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বালিশ মিষ্টির জিআই স্বীকৃতির জন্য ২০২৩ সালে আবেদন করা হয়। তখন এই পণ্যের ইতিহাস, উৎপাদন প্রক্রিয়া, উপাদান এবং এর অনন্য বৈশিষ্ট্য সংবলিত বিস্তৃত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। তৎকালীন সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা তানিয়া তাবাসসুম এই স্বীকৃতি আদায়ে সামনের সারিতে কাজ করেন। তিনি জানান, পেটেন্ট অধিদপ্তর যাচাই-বাছাই শেষে নিশ্চিত হয় যে বালিশ মিষ্টির কোনো বিকল্প উৎপাদক বা অন্য কোনো স্থান থেকে এটির দাবি নেই।