শিগগিরই জ্বালানি তেলের দামে সমন্বয়

শিগগিরই জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সেই সঙ্গে আগামী বাজেটে মূল্য সংযোজন করও (ভ্যাট) সহনীয় পর্যায়ে রাখা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
আজ মঙ্গলবার ‘কেমন বাজেট চাই’ অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন অর্থমন্ত্রী। এনটিভি এবং বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির (এফবিসিসিআই) যৌথ উদ্যোগে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। রাজধানীর প্যানপ্যাসিফিক হোটেল সোনারগাঁও থেকে অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করে এনটিভি।
একই অনুষ্ঠানে আলোচকরা বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ব্যক্তিপর্যায়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি, সর্বোপরি মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়নে বিশেষ বরাদ্দ দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
দশমবারের মতো এই আয়োজনের আলোচনায় আগামী অর্থবছরের বাজেট নিয়ে অর্থমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরা হয় প্রত্যাশা এবং চ্যালেঞ্জের বিভিন্ন দিক। আশানুরূপ বিনিয়োগ না হওয়ার কারণ, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, শিল্প-বাণিজ্য, কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে বিগত দিনের বাজেটের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির পাশাপাশি আসছে বাজেটের চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরেন আলোচকরা।
জ্বালানি তেল ও ভ্যাট
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, জ্বালানি তেলের দামের ক্ষেত্রে আমি আমার ফেইলিওর স্বীকার করব। এর সমন্বয় করা হয়নি। যেটা অর্থনীতির জন্য খুব ভালো নয়। এটা করলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরো বেশি হতে পারত। তা আমরা করব।’
ভ্যাট প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘ভ্যাট কী হারে হবে। একজন বলেছেন, আজ তিন শতাংশ দেই কাল অত শতাংশ দেই। ১৫ শতাংশের কথা কিন্তু ২০১২ সাল থেকেই বলছি। আপনি বলতে পারবেন না এর জন্য আপনার প্রস্তুতি হয়নি। ২০১২ সাল থেকে আমরা আইনটি জারি করেছি। এর কার্যকারিতা এখন পর্যন্ত পুরোপুরি হয়নি। এ বছরে দেব মাত্র। আমার মনে হয় আমরা কমফোরটেবল একটা হার দিতে পারব।’
স্থানীয় শিল্পে বিকাশ
সরকার স্থানীয় শিল্প বিকাশ ও প্রসারের জন্য কাজ করছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘স্থানীয় শিল্পকে তুলে ধরা হচ্ছে এ সরকারের সবচেয়ে বড় অবদান। স্থানীয় শিল্পকে তুলে ধরা হচ্ছে।’
শিক্ষার প্রসারে জোর দেওয়া হয়েছে মন্তব্য করে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘আমরা আসলে যেটাতে জোর দিয়েছি, সেটা হচ্ছে শিক্ষার প্রসার। মানের দিকে মোটেই নজর দেওয়া হয় নাই। শিক্ষার প্রসারের একটা যৌক্তিকতা আছে এবং প্রাইমারি লেভেলে (প্রাথমিক স্তরে) এটা খুব ভালো বলা যায়।’
অর্থমন্ত্রী জানান, দেশ এখন মোবাইলে ‘সেলফ সাফিসিয়েন্ট’। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন শতভাগ এয়ারকন্ডিশন তৈরি করছি। আমরা এখন বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নিজেদের দেশে প্রস্তুত করতে পারছি। এসবই অর্জিত হয়েছে গত আট বছর ধরে।’
শেয়ারবাজার
অর্থমন্ত্রী জানান, গত তিন বছরে শেয়ারবাজারকে যথাযথ অস্তিত্বের মধ্যে আনা হয়েছে। শেয়ারবাজার বিকশিত হওয়া শুরু করেছে। এর চেয়ে বেশি সংস্কার করা বা উন্নয়ন করা কোনোদিনই সম্ভব হয়নি বাংলাদেশে।
দক্ষ জনশক্তি
দক্ষতা ও দক্ষ জনশক্তি নিয়ে অনুষ্ঠানে সংশয় প্রকাশ করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, ‘মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য যে সক্ষমতা প্রয়োজন, সে সক্ষমতাটা আমাদের রয়েছে কি না। মানবসম্পদ উন্নয়ন ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা আমাদের আকাঙ্ক্ষার সাথে সমান্তরালভাবে চলছে না। আমরা বিদেশি বিনিয়োগের কথা বলছি। ভারত ও চীনের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের চুক্তি হয়েছে। চুক্তিগুলোর অধীনে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে যে ধরনের দক্ষ জনশক্তি, যে ধরনের প্রশিক্ষণ দরকার সেগুলো কিন্তু আমাদের নেই। এখনই আমরা দেখতে পাচ্ছি বড় বড় প্রকল্পের জন্য বাইরে থেকে মানবসম্পদ আনতে হয়। কিন্তু আমরা কতদিন কতটুকু মানবসম্পদ আনব?’এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের অন্যতম। আমরা বিশেষজ্ঞ পাঠাচ্ছি বাইরে। দক্ষতা বৃদ্ধি আমাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ।
আমি গতবারের বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলাম দক্ষতা বৃদ্ধিতে আমাদের সর্বোচ্চ মনোযোগ দিতে হবে।’
অর্থমন্ত্রী জানান, এবারের বাজেটেও পরনির্ভরশীলতা কমাতে দেশের দক্ষ জনশক্তির ওপর বিশেষ নজর গেল বাজেটের মতো অব্যাহত থাকবে।
মেগা প্রকল্পের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি
অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানিয়েছেন, মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ দ্রুত হচ্ছে। বাজেটে এসব প্রকল্পের পাশাপাশি গুরুত্ব পাবে তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাতও।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলের মতো মেগা প্রকল্পের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণেও সরকার মনোযোগ দিচ্ছে।’ শিক্ষার মানোন্নয়ন, আইটি খাতে বিশেষ বরাদ্দ, নারীর ক্ষময়তায়ন ও কৃষিবান্ধব প্রযুক্তির সম্প্রসারণকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে এ সময় জানান অর্থমন্ত্রী।
আগামী বাজেটে কোনো চমক আছে কি না জানতে চাইলে হেসে দেন অর্থমন্ত্রী। হাসতে হাসতে তিনি বলেন, ‘চমক কী আছে তা তো আমি বলতে পারব না।’ বিনিয়োগের পরিবেশ
অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সরকারের সমালোচনা করে বলেন, ‘দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ নেই। আর বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকায় টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে।’
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘প্রবৃদ্ধি ছয়-সাতের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। প্রবেশপথটা (থ্রেশহোল্ড) হওয়া উচিত ছিল দুই অঙ্কের।’
আমীর খসরু বলেন, ‘আমরা কিন্তু মানবসম্পদের ব্যাপারে কিছু করতে পারিনি। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কেন হচ্ছে না সেটা আমরা সবাই জানি। দেশে আজ বিনিয়োগের পরিবেশ নাই। এবং বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকার কারণে টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জিডিপির ছয় শতাংশ চলে যাচ্ছে। মানুষ বিনিয়োগ বাইরে করতে চাচ্ছে।
দেশে করতে চাচ্ছে না। এটাকে আমাদের ঠিক করতে হবে। দেশের বিনিয়োগের পরিবেশ ঠিক করতে হবে। সেটার একমাত্র উপায় হচ্ছে স্থিতিশীলতা। স্থিতিশীলতা আসতে পারে একমাত্র রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মাধ্যমে। যেটা বাংলাদেশে আজ অনুপস্থিত। জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সংসদ হতে হবে, সরকার হতে হবে তাহলেই কেবল স্থিতিশীলতা ফিরে আসা সম্ভব।
অনুষ্ঠানে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, কেরোসিনের দাম আমরা যথেষ্ট কমাচ্ছি না। কেন কমাচ্ছি না? আমাদের সক্ষমতা কোত্থেকে আসবে? আপনি নতুন ভ্যাট দেবেন আমাদের খরচ বাড়বে। অন্য কোথাও কমিয়ে দেন। আমরা ব্যবসায় টিকে থাকতে চাই। আমরা কর দিতে চাই। বাংলাদেশকে উন্নত করতে চাই। কিন্তু আমাদের তো ব্যবসায় টিকে থাকতে হবে।’
আগামী মাসে জাতীয় সংসদে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট পেশ করার কথা রয়েছে অর্থমন্ত্রীর।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ।
অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান, এনটিভির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলহাজ্ব মোহাম্মদ মোসাদ্দেক আলীসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।