মসলিন পুনরুজ্জীবনে দরকার সরকারি নীতি-সহায়তা

দেড়শ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া বাংলার ঐতিহ্য ‘ঢাকাই মসলিন’ পুনরুজ্জীবিত করতে দরকার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও নীতিগত সহায়তা। এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ। তবেই মসলিন ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে।
আজ রোববার রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরে মাসব্যাপী মসলিন উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত দিনব্যাপী এক সেমিনারে এমন মত তুলে ধরেন বক্তারা। সেমিনারে বিষয় বস্তু ছিল- ‘মসলিন পুনরুজ্জীবন : নীতি ও প্রতিষ্ঠান’।
বক্তারা বলেন, বাংলার শত বছরের হারানো ঐতিহ্য মসলিন ফিরিয়ে আনার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেটি বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব। যদি বেসরকারি উদ্যোগের সঙ্গে সরকারের নীতিগত ও আর্থিক সহায়তা যোগ করা যায়। কারণ এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি ও ধীরস্থির প্রক্রিয়া। মসলিন তৈরিতে যে সুতার প্রয়োজন, তার ব্যাপক উৎপাদন করা বড় চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি মসলিন উৎপাদনের যন্ত্রপাতি সরবরাহ এবং কারিগরদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ঢেলে সাজানো দরকার। সব কিছু সফলভাবে সম্পন্ন করতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সম্ভব নয়।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দৃক ও জনপ্রিয় পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান আড়ংয়ের সহায়তায় সেমিনারের আয়োজন করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মুস্তাফিজুর রহমানের সঞ্চালনায় সেমিনারে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, বাংলাদেশ তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. ফরিদ উদ্দিন, লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক রোজেমারি ক্রিলসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গবেষক অংশ নেন।
বাংলাদেশ তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘মসলিন তৈরির নীতিগত প্রক্রিয়ার সঙ্গে তুলা উন্নয়ন বোর্ড এরই মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আমরাও চাই সরকারি-বেসরকারি যৌথ প্রচেষ্টায় প্রক্রিয়াটি এগিয়ে যাক।’
ফরিদ উদ্দিন বলেন, মসলিনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে নতুন করে পরিচয়ে তুলে ধরা সম্ভব। কারণ শুধু দেশে নয়, সারা বিশ্বে এটির একটি সমৃদ্ধ বাজার রয়েছে। তবে বাণিজ্যিক প্রক্রিয়ায় উৎপাদন করতে হলে এখনো অনেক গবেষণা করতে হবে। তবেই হারানো গৌরব পুনরুজ্জীবন সম্ভব।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, মসলিনের মতো হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে এবং রক্ষা করতে শিল্প মন্ত্রণালয় ভীষণ আগ্রহী। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রীরও নির্দেশ রয়েছে এ ব্যাপারে কাজ করতে। তিনি বলেন, ‘কারু ও হস্তশিল্পের মতো দেশীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন-বিসিকের সঙ্গে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে। তা ছাড়া জামদানি শিল্পের অধিকতর উন্নয়নে নারায়ণগঞ্জের নয়াপাড়ায় পাঁচ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি জামদানি ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিটি এবং রিসার্চ সেন্টার তৈরি করা হচ্ছে। এখন মসলিনকে যদি এর সঙ্গে যুক্ত করা যায়, তাহলে এটি হবে আমাদের জন্য একটি মাইলফলক।’
মসলিন পুনরুজ্জীবিত করতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে উল্লেখ করে অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘মসলিন তৈরিতে ব্যবহৃত কাঁচামাল সরবরাহ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তা ছাড়া একটি বড় প্রশ্ন থেকেই যায় যে কাঁচামাল তৈরিতে এখানকার আবহাওয়া কতটা অনুকূল। এ অঞ্চলের মাটির প্রকৃতিও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সুতরাং সঠিক মাটি ও আবহাওয়া খুঁজে পেতে গবেষণার দরকার। তা ছাড়া এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। আমরা চিন্তা করছি কীভাবে পিওর (খাঁটি) মসলিন তৈরি করা যায়। এরই মধ্যে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
জামাল আবদুল নাসের চৌধুরী আরো বলেন, ‘দেশের বেসরকারি বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, এনজিও, বিজ্ঞানী, গবেষক, কৃষিবিদ সবার সঙ্গে যদি শিল্প, বস্ত্র ও পাট, বনসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো একসঙ্গে কাজ করে, আমি বিশ্বাস করি আমাদের এই অভিযাত্রা সফল হবে।’
২০১৩ সালের প্রথম দিকে মসলিন ঐতিহ্য পুনরুজ্জীবনে গবেষণা শুরু করে দৃক। এ লক্ষ্যে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে অনুসন্ধান চালিয়ে ভারতের জয়পুরে খুঁজে পাওয়া যায় মসলিনের মূল উপাদান ফুটি কার্পাস তুলা। পরে গাজীপুরের শ্রীপুরের তুলা উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তায় পাইলট প্রকল্প নিয়ে চাষাবাদ শুরু করে দৃক। গত বছর প্রায় ৩০০ গাছের আবাদ হয় শ্রীপুরে। এসব গাছ থেকে তুলা সংগ্রহ করে ভারত থেকে সুতা বানিয়ে নিয়ে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। সে সুতা দিয়ে দেশীয় তাঁতে মসলিন কাপড় তৈরি করা হচ্ছে।
সর্বনিম্ন ২৫০ কাউন্ট সুতার তৈরি কাপড়কে মসলিন বলা হয়। ফুটি কার্পাস গাছের তুলা থেকে দৃক যে কাপড় তৈরি করেছে, সেটি ৩০০ কাউন্ট সুতায় তৈরি। ফলে এ মসলিনকে দেড়শ বছর আগের সেই মসলিন বললে ভুল হবে না বলেও সেমিনারে উঠে আসে।
এখন বাংলার হারিয়ে যাওয়া এ মহামূল্যবান ঐতিহ্যের সঙ্গে মানুষকে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে জাতীয় জাদুঘরে গত ৫ তারিখ থেকে শুরু হয়েছে মাসব্যাপী মসলিন উৎসব। এতে দৃকের তৈরি দুটি মসলিন প্রদর্শনীর পাশাপাশি মসলিনের অতীত ইতিহাস তুলে ধরা হচ্ছে।