তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে রাজধানীসহ সারা দেশ৷ প্রতিদিনই তাপমাত্রা রেকর্ড ছাড়াচ্ছে৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির পেছনে বৈশ্বিক উষ্ণতার পাশাপাশি স্থানীয় অনেক কারণও আছে৷

বিশেষ করে ঢাকা শহরের সবুজ মাঠ, খোলা জায়গা ও পুকুর খাল ধ্বংস করায় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়েও কয়েক ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি অনুভূত হচ্ছে৷ ভবন তৈরির নির্মাণ সামগ্রী এবং কাঠামোও তাপ বাড়াতে ভূমিকা রাখছে বলেও মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদরা৷  

গতকাল রোববার (১৬ এপ্রিল) বাংলাদেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ঈশ্বরদীতে ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷ এর আগের দিন শনিবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াম চুয়াডাঙ্গায়৷

গত দুইদিন ধরে ঢাকা তাপমাত্রার ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে, যা গত ছয় দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ৷ আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ঢাকা, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, পাবনা, বাগেরহাট, যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়ার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে৷ এই তাপপ্রবাহ আরও তিন-চার দিন অব্যাহত থাকবে৷ রাতে তাপ আরও বাড়তে পারে৷ দেশে কোথাও বৃষ্টিপাত নেই৷ তবে কোথায় কোথাও আকাশ হালকা মেঘাচ্ছন্ন৷

ঢাকায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়ে ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘বৈশ্বিক উষ্ণায়ন তো আছেই কিন্তু ঢাকায় বেশি গরম লাগার স্থানীয় কারণ আছে৷ একটি নগরে স্থাপনা থাকবেই৷ তার সঙ্গে সবুজ ২৫ ভাগ এবং ওয়াটার বডি ১৫ ভাগ; মোট ৪০ ভাগ জায়গা ছেড়ে দিতে হবে৷ আমরা ২০২০ সালে এক গবেষণায় দেখেছি, ঢাকার মোট ভূমির শতকরা ৮২ ভাগ কংক্রিটে আচ্ছাদিত৷ ফলে এখানে তাপমাত্রা কমানো যায় না৷ সবুজ ও ওয়াটারবডি থাকলে তিন-চার ডিগ্রি তাপ কমে যেত৷’

ড. আদিল মোহাম্মদ খান আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের পরিবেশ বিবেচনা না করে এয়ার টাইট উঁচু উঁচু ভবন তৈরি হচ্ছে৷ ভবনগুলো কাচে আচ্ছাদিত৷ এগুলো উল্টো তাপ উৎপাদন করে৷ আবার যেসব নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা হয় তা-ও তাপ উৎপাদন করে৷’

এর আশু কোনা সমাধানও নেই বলে মনে করেন এই নগর পরিকল্পনাবিদ৷ তিনি মনে করেন, এখন থেকে ভূমি ব্যবহারের নীতিমালা ও বিল্ডিং কোড ঠিক করে তা মেনে চললে ২০ থেকে ৩০ বছরে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. তৌহিদা রশীদ বলেন, ‘গ্রাম ও শহরের তাপমাত্রায় দুই-তিন ডিগ্রি পার্থক্য থাকে৷ কারণ গ্রামে গাছপালা আছে, জলাশয় আছে৷ ঢাকা শহরে অপরিকিল্পিত নগরায়ণ হয়েছে৷ ফলে তাপমাত্রা বেশি অনুভূত হয়৷ আর পরিবেশ দূষণ তো আছেই৷ নগর পরিকল্পনায় যদি পর্যাপ্ত গাছপালা, জলাশয় যোগ করা যায়, পরিবেশের উপযোগী করে যদি ভবন নির্মাণ করা যায়, তাহলে তাপমাত্রা পাঁচ ডিগ্রি পর্যন্ত কমানো যায়৷’

চলতি বছর বাংলাদেশে সার্বিকভাবে তাপমাত্রায় পরিবর্তন আসার পেছনে রয়েছে আবহাওয়াগত কারণও৷ ড. তৌহিদা রশীদ বলেন, ‘প্রশান্ত মহাসাগরের শীতল রাত থেকে এখন আমরা উষ্ণ রাতে প্রবেশ করছি৷ এটা কয়েক বছর পরপর ফিরে আসে৷ আমরা পুরোপুরি উষ্ণ রাতে প্রবেশ করি জুনের দিকে৷ তখন এই অঞ্চলে এশিয়ার পূর্বাঞ্চলে বৃষ্টি হয় না৷ বৃষ্টি হয় ব্রাজিল, পেরু, উত্তর আমেরিকা অঞ্চলে৷ ফলে আমাদের কয়েক বছর খরা ও উষ্ণতা মোকাবিলা করতে হবে৷ তার সঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতাও এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে৷’

সার্বিকভাবে এই তাপপ্রবাহ আরও তিন-চারদিন থাকবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর৷ অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ শাহানা সুলতানা বলেন, ‘গত ৫ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশে এই তীব্র তাপপ্রবাহ শুরু হয়৷ এর কারণ এপ্রিল-মার্চ মাসে সূর্য মাথার উপরে আসে। তখন পাকিস্তান, রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ ও বাংলাদেশ—এই এলাকায় সূর্য খাড়াভাবে কিরণ দেয়৷ ফলে একটি গরমের প্রবাহ তৈরি হয়৷ এই প্রবাহ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছড়িয়ে যায়৷ পাকিস্তান থেকে প্রবাহ আসে৷’

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘ঢাকায় জনবসতি, কল কারখানা ও গাড়ি বেশি, গাছপালা নেই৷ এ কারণে এখানে গরম বেশি অনুভূত হয়৷’