সাক্ষাৎকার
জীবনের বেশির ভাগজুড়েই রয়েছে ভীতি : সিয়েৎলানা অ্যালেক্সেভিচ
বেলারুশের সাংবাদিক এবং লেখিকা সিয়েৎলানা অ্যালেক্সেভিচ এ বছরের সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন। সুইডিশ একাডেমির চেয়ারম্যান সারা দানিয়ুস আজ বাংলাদেশ সময় বিকেল ৫টায় এ বছরের সাহিত্যে নোবেল বিজয়ীর নাম ঘোষণা করেন। এ নিয়ে সাহিত্যে ১৪ জন নারী নোবেল পুরস্কার পেলেন। আর সাহিত্যে নোবেলজয়ী সাহিত্যিকের সংখ্যা ১১২ জন। এর আগে ২০১৩ সালে কানাডার ছোটগল্পকার অ্যালিস মুনরো নারী হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছিলেন।
এ বছর সাহিত্যের নোবেল পুরস্কারের জন্য প্রাথমিকভাবে ২২০ জনের তালিকা করা হয়েছিল বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান। এ বছরের মে নাগাদ সেখান থেকে পাঁচজনের নাম সংক্ষিপ্ত তালিকায় রাখা হয়।
এ বছরের সাহিত্য পুরস্কারের জন্য আরো যাঁদের নাম সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিল, তাঁরা হলেন—জাপানের হারুকি মুরাকামি, কেনিয়ার নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো, নরওয়েজিয়ান নাট্যকার জন ফসে, আয়ারল্যান্ডের জন বনভিল, মার্কিন লেখিকা জয়েস ক্যারল ওটস ও ফিলিপ রথ।
এ বছর নোবেল পুরস্কার পাওয়া সিয়েৎলানা ১৯৪৮ সালের ৩১ মে তৎকালীন ইউক্রেনে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা বেলারুশিয়ান আর মা ইউক্রেনিয়ান। সিয়েৎলানা বড় হয়েছেন বেলারুশে। সাংবাদিকতা পেশা হিসেবে নেন তিনি। সাংবাদিক হিসেবে তিনি সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ, সোভিয়েতের ভাঙন এবং চেরনোবিল দুর্ঘটনা নিয়েও অনুসন্ধানী কাজ করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়েও তারঁ গবেষণা রয়েছে।
সিয়েৎলানার উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘ভয়েসেস অব চেরনোবিল’, ‘জিংকি বয়েজ’, ‘ওয়ার’স আনওমেনলি ফেস’। ‘ভয়েসেস অব চেরনোবিল’ বইটি নিয়ে মার্কিন প্রকাশনা সংস্থা ডকি প্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বইটি লেখার সময়কার অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বিস্তারিত কথা বলেছেন। সেই সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ এনটিভি অনলাইনের পাঠকের জন্য দেওয়া হলো।
ডকি প্রেস : ‘ভয়েসেস অব চেরনোবিল’ খুবই আবেগী একটি বই। এর মাধ্যমে পাঠকের মধ্যে আপনি কি প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে চেয়েছিলেন?
সিয়েৎলানা : এত বছর পরও একটা মতামত আছে যে আমরা চেরনোবিল সম্পর্কে সবকিছুই জানি। এটা অতীতের বিষয়, তাই এটা নিয়ে কেউ আর কিছু শুনতে চায় না। কিন্তু আমার মনে হয়, এটা মোটেও ভুলে যাওয়ার মতো কোনো ঘটনা নয়, চেরনোবিলের ঘটনাবলি মানুষ কখনোই ঠিকভাবে বুঝতে পারেনি।
ডকি প্রেস : ‘ভয়েসেস অব চেরনোবিল’-এর বিষয়ে পাঠকের কাছ থেকে আপনি কোন প্রতিক্রিয়া বেশি পেয়েছেন?
সিয়েৎলানা : সবচেয়ে বেশি যে প্রতিক্রিয়া শুনতে হয় মানুষের সেটা হচ্ছে, ‘বাস্তবে কী ঘটেছিল, সেটা সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই, বিশেষ করে ব্যক্তিগতভাবে।’ কিন্তু বইটা আসলে চেরনোবিল বিস্ফোরণ নিয়ে নয়, মানে এটা কীভাবে ঘটল বা এর প্রভাব কী ছিল, মোটেও সে বিষয়ে নয়। বইটির বিষয়বস্তু ছিল, চেরনোবিল বিস্ফোরণ-পরবর্তী বদলে যাওয়া দুনিয়াকে নিয়ে। এটা সে সময়ে বিশ্বব্যবস্থায় কী প্রভাব ফেলেছিল, সেটা নিয়ে। সে সময়ের মানুষের জীবনে কী প্রভাব ফেলেছিল বা তাদের জীবনধারা কীভাবে বদলে গিয়েছিল, সেটাই এ বইয়ের মূল বিষয়।
চেরনোবিল মানুষের মধ্যে নতুন ভয় তৈরি করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট প্রশাসনের প্রতি মানুষের মধ্যে ভয় ঢুকে গিয়েছিল, অনেকেই নিজের পরিবারকে বাঁচাতে পালিয়ে যাওয়াটাকেই নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছিল। আবার অনেকেই বিস্ফোরণের পরও চেরনোবিলে থেকে গিয়েছিল শুধু দলের প্রতি, কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি নিজের আনুগত্য প্রকাশের জন্য।
বেশির ভাগ মানুষেরই চেরনোবিলের এই অংশ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর আমার মনে যেসব প্রতিক্রিয়া এসেছিল, সেগুলোই আমাকে বইটি লেখার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করেছিল। দুর্ঘটনার পর মানুষ তাদের জীবনবোধ নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে। নিজেরা কীভাবে বেঁচে থাকবে, সেটাই তাদের সে সময়ে ভাবিয়ে তুলেছিল।
ডকি প্রেস : বইটা লেখার জন্য প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে কীভাবে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন? বইটা লিখতে আপনার কত দিন লেগেছিল? যে পরিমাণ তথ্য পেয়েছিলেন, তার সবটুকু কি বইতে দিতে পেরেছিলেন?
সিয়েৎলানা : পুরো বইটাতেই প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, বিস্ফোরণের পর তাদের জীবনবোধ, তাদের বক্তব্যই উঠে এসেছে। আমার ১০ বছরের বেশি সময় লেগেছিল বইটি লিখতে। প্রথম কয়েক মাস আমি চেরনোবিলে কাটাই সাংবাদিক ও লেখকদের সঙ্গে। সেখানে অনেক দেশের সাংবাদিকরা ছিলেন এবং তাঁরা স্থানীয়দের বিভিন্ন প্রশ্ন করছিলেন। সব ধরনের প্রশ্নই তাঁরা করছিলেন। বিশেষ করে এই বিস্ফোরণের জন্য কমিউনিস্ট সরকারের ব্যর্থতা দায়ী কি না, সেটা স্থানীয়দের কাছ থেকে বারবার জানতে চাইছিলেন বিদেশি সাংবাদিকরা।
সে সময়ে কিন্তু বেলারুশ ও ইউক্রেনে জাতীয়তাবাদী এবং রুশবিরোধী চেতনা খুব মজবুতভাবে কাজ করেছিল। কারণ, চেরনোবিল ছিল একটা রুশ পরমাণুকেন্দ্র, যেটা বিস্ফোরিত হয়েছিল ইউক্রেনে। মানুষের মধ্যে এই ক্ষোভটা ছিল। স্থানীয়দের মতামত জানার জন্য আমি তাদের সাক্ষাৎকার নেই। পাঁচশর বেশি স্থানীয় মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। আর সে কারণেই ১০ বছরের বেশি সময় লেগেছ বইটা লিখতে।
সেই ৫০০ সাক্ষাৎকারের মধ্যে থেকে ১০৭ জনের সাক্ষাৎকারই আমি বইতে প্রকাশ করেছি। মানে পাঁচ ভাগের এক ভাগ মাত্র বইতে নিয়ে আসতে পেরেছি। আমার অন্যান্য বইয়ের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। প্রতিটি সাক্ষাৎকার করতে আমার চারটি টেপ খরচ হয়েছে। আমি যখন সেগুলো ট্রান্সক্রিপ্ট করলাম, প্রতিটি ১০০ থেকে ১৫০ পাতার একেকটা সাক্ষাৎকারে দাঁড়াল। সেখান থেকে কমিয়ে আমি ১০-১৫ পৃষ্ঠায় নিয়ে আসি।
ডকি প্রেস : আপনি একজন বেলারুশের লেখক এবং থাকেন প্যারিসে। আপনার কি মনে হয়, আপনি একটি নির্দিষ্ট দেশের সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করছেন নাকি লেখক হিসেবে আপনি নিজেকে স্বাধীন মনে করেন, যিনি সব দেশের বা সব সংস্কৃতির অংশ?
সিয়েৎলানা : আমি বলব, আমি একজন স্বাধীন লেখক। আমি নিজেকে একজন সোভিয়েত লেখক বলতে পারি না। ‘সোভিয়েত’ বলতে আমি বোঝাচ্ছি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পুরো সীমানাকে। স্বাভাবিকভাবেই আমি সোভিয়েত ইউটোপিয়ার অংশ। আমি নিজেকে একজন বেলারুশিয়ান লেখকও বলব না। আমার সব বইতেই আমি সোভিয়েত ইউটোপিয়া নিয়ে লিখেছি।
প্যারিসে আমি অস্থায়ীভাবে থাকছি। বেলারুশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আমি প্যারিসে আছি। আমার বইগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত হয়েছে; কিন্তু আমার নিজের দেশ বেলারুশে কোনো বই পাওয়া যায় না। গত ১০ বছরে লুকাশেঙ্কোর শাসনামলে আমার কোনো বই বেলারুশে প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু আমি আমার লেখা চালিয়ে গেছি।
ডকি প্রেস : আপনার লেখার ধরনটা আলাদা। আপনার বইয়ের ফিকশনাল পদ্ধতির সঙ্গে সাক্ষাৎকারের একটা মিশেল দেখা যায়। এটা একেবারেই মৌলিক একটা জনরা। আপনি কি আর কোনো লেখকের কথা বলতে পারবেন, যাঁরা এইভাবে লেখেন?
সিয়েৎলানা : এইভাবে গল্প লেখার চল রাশিয়ান সাহিত্যে আমার আগেও অনেকে করেছেন। মানে বিভিন্ন মানুষের মৌখিক সাক্ষাৎকার নেওয়া এবং সেগুলোকে গল্পের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া। দানিল গ্র্যানিন, অ্যালেস আদামোভিচ তাঁদের বইয়ে এভাবে লিখেছেন। আমার প্রথম পাঁচটা বইয়ে আমি এ পদ্ধতি অনুসরণ করেছি।
ডকি প্রেস : যুক্তরাষ্ট্রে আপনি কেমন সমাদর পান?
সিয়েৎলানা : যুক্তরাষ্ট্র একটা অসাধারণ দেশ, কিন্তু ৯/১১-এর পর আমি সেখানে একটা আলাদা দেশ দেখতে পাচ্ছি। ৯/১১-এর পর তারা বুঝতে পেরেছে যে এই বিশ্বব্যবস্থা কতটা ভঙ্গুর এবং প্রতিটি রাষ্ট্র আরেকটি রাষ্ট্রের ওপর কীভাবে নির্ভরশীল। অস্ট্রেলিয়ায় যদি কোনো পারমাণবিক কেন্দ্রে বিস্ফোরণ ঘটে, তাহলে এর রেডিওঅ্যাকটিভ রেইনের ফল হয়তো ভোগ করবে অন্য কোনো দেশ। আমার মনে হয়, ৯/১১-এর অভিজ্ঞতার পর মার্কিন জনগণ আমার বই গ্রহণ করতে পেরেছে।
কারণ, এই দুর্ঘটনার পর তাদের যে আবেগ বা অবস্থা, সেটা তারা আমার বইয়ে খুঁজে পেয়েছে। আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় অন্য দেশের মানুষের যন্ত্রণাকে অবহেলা করা বা এড়িয়ে যাওয়াটা খুবই বিপজ্জনক। কারণ, আমরাও সেভাবে আক্রান্ত হতে পারি। আমাদের জীবনের বেশির ভাগজুড়েই রয়েছে ভীতি। এমনকি ভালোবাসার চেয়েও আমরা ভয় নিয়েই জীবনের বেশির ভাগ সময় পার করি। আমাদের সবাইকেই বেঁচে থাকার সাহস অর্জন করতে হবে, আর তাহলেই আমার মনে হয় বেঁচে থাকাটা সার্থক হবে।
সিয়েৎলানা অ্যালেক্সেভিচের ‘ভয়েসেস অব চেরনোবিল’ বইয়ের কিছু অংশ দেওয়া হলো এখানে: