পরী মণি ক্যাডার নাকি আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান চক্রের সদস্য : আইনজীবী
রাজধানীর বনানী থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়ের হওয়া মামলায় চিত্রনায়িকা পরী মণির জামিন আবেদন নাকচ করে আরও এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। আজ বৃহস্পতিবার ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুর ইসলাম এই আদেশ দেন।
আজ সকাল ৮টা ২৫ মিনিটে পরী মণিকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপরে বেলা ১১টা ৩০ মিনিটে পরী মণিকে কঠোর পুলিশি নিরাপত্তায় আদালতের এজলাসে তোলা হয়। সে সময় পরী মণিকে দেখতে শত শত আইনজীবী ভিড় জমান। উৎসুক আইনজীবীদের কারণে আদালতে তিল ধারণের ঠাঁই পাওয়া যায়নি। এ সময় বিচারক বলেন, যারা যারা পরী মণিকে দেখতে এসেছেন, যদি দেখা শেষ হয় তাহলে এখান থেকে চলে যান।
বিচারক আরও বলেন, ‘আজ সিএমএম আদালতে আরও অভিনেত্রীর শুনানি থাকলে কোনো আইনজীবী বাইরে থাকবে না। সবাই এজলাসে তাদের দেখতে চলে আসবে।’
এ সময় এক আইনজীবী আদালতে শুনানির সময় স্পিকার ব্যবহারের কথা বললে, বিচারক বিরক্ত বোধ করে বলেন, ‘এ কথা কে বলেছেন? আমার সামনে যে ফ্যানটা কয়েক মাস ধরে বন্ধ। এটা মেরামত করার জন্য গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে বেশ কয়েকবার চিঠি দিয়েছি, কিন্তু এখনো মেরামত করে দেওয়া হয়নি। আর স্পিকার সে তো পরের কথা। এখন আমার বেতন থেকে যদি বলেন মেরামত করে দেওয়ার জন্য তাহলে দিব।’ এরপরে বিচারক রিমান্ড শুনানি শুরু করার জন্য রাষ্ট্রপক্ষকে বলেন।
রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি আব্দুল্লাহ আবু রিমান্ড শুনানিতে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, পরী মণির কাছ থেকে ১৮.৫ লিটার বিদেশি মদ, এলএসডি ও আইস পাওয়া গেছে। তাঁকে প্রথমে রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে। এখন সেই তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করার জন্য ও তথ্যগুলো ভেরিফাই করার জন্য পুনরায় রিমান্ডে নেওয়া প্রয়োজন।’
মাদক মামলায় রিমান্ড ও জামিন আবেদনের শুনানির সময় আদালতকে আইনজীবী বলেন, ‘পরী মণিকে কেন একটা মাদক মামলায় এতবার রিমান্ডে নিতে হবে? এ বিষয়গুলো সমাজ ও রাষ্ট্রে কী প্রভাব ফেলবে? ইতোমধ্যে বিভিন্ন মহলে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এ মামলায় এখন তাঁকে আবারও রিমান্ডে নেওয়ার পেছনে অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে।’
‘আসামিকে এর আগে দুই দফা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাঁর কাছ থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে সেসব তথ্যসূত্র বিভ্রান্ত তৈরি করছে। তাই তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কারা মাদক ব্যবসায়ী, কারা এসব আমদানি করে তাদের বিষয়ে জানা প্রয়োজন।’
এর পরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাজী গোলাম মোস্তফা আদালতকে বলেন, ‘আসামিকে এর আগে দুই দফা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাঁর কাছ থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে সেসব তথ্যসূত্র বিভ্রান্ত তৈরি করছে। তাঁকে নিয়ে সে সব জায়গায় অভিযান করা দরকার। এ ছাড়া কারা কারা মাদক ব্যবসায়ী, কারা এসব আমদানি করে, তাদের বিষয়ে জানার জন্য রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।’
এরপরে পরী মণির আইনজীবী মজিবুর রহমান শুনানিতে বলেন, ‘পরী মণি একজন নায়িকা। একজন চলচ্চিত্র নায়িকা অনেক কষ্ট করে তাঁর ক্যারিয়ার তৈরি করে। তাঁকে এভাবে বার বার রিমান্ডে নিয়ে তাঁর মানসিক শক্তি শেষ করে দেওয়া হচ্ছে। এভাবে রিমান্ড দিয়ে তাঁর ক্যারিয়ার শেষ করে দেবেন না।’
আইনজীবী আরও বলেন, র্যাব অভিযান করার সময় গর্ভমেন্টের অনুমতি নেবে। কিন্তু তারা কোনো অনুমতি নেয়নি। আমরা এর আগেও বলেছি, আবারও একই কথা বলছি। পরী মণি কি সন্ত্রাসী বাহিনীর ক্যাডার, না কি আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান চক্রের সদস্য? তিনি খুন করেনি, বড় কোনো অপরাধও করেনি। তাঁকে এভাবে রিমান্ডে নেওয়ার কী দরকার?
অ্যাডভোকেট মজিবুর রহমান বলেন, পুলিশের যদি তথ্য যাচাই-বাছাই করতে হয় তাহলে কারাগারে তদন্ত কর্মকর্তা জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে রিমান্ডের কোনো প্রয়োজন নেই। এ ছাড়া পরী মণির কাছ থেকে এলএসডি পাওয়া গেছে, তার পরিমাণ কত তা কিন্তু বলা হয়নি। চার গ্রাম আইসের যে কথা হয়েছে তার সাজা কী হবে তা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে বলা নেই। এখানে পরী মণির বিরুদ্ধে যে ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে সর্বোচ্চ কারাদণ্ড পাঁচ বছরের হবে।
আইনজীবী বলেন, পরী মণি একাধিক ছবির সঙ্গে চুক্তি করেছেন। যদি তাঁকে মুক্তি না দেওয়া হয় তাহলে তাঁর ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যাবে। এ ছাড়া প্রীতিলতা ছবি সরকারি ছবি, এটা দেশের জন্য করছে পরী মণি। তাই জামিন দেওয়া আবশ্যক।
মজিবুর রহমান বলেন, ‘পুলিশ চাচ্ছে, পরী মণিকে নিয়ে স্বীকারোক্তি জবানবন্দি করাবে। এটা যদি হয় তাহলে বিজ্ঞ আদালত আপনি রিমান্ড নাকচ করে দিবেন। তিনি বলেন, ‘তাঁকে (পরী মণি) যেভাবে গ্রেপ্তার করা হলো তাতে সারা বিশ্ব জানতে পারল, আন্তর্জাতিক কোনো চোরাচালান চক্রের সক্রিয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অথচ তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তার একটাও সত্য নয়।’
মজিবুর রহমান বলেন, ‘সে একজন চলচ্চিত্র নায়িকা, ১০টি ছবিতে তাঁর চুক্তি রয়েছে। কারাগারে থাকায় এইসব ছবির শুটিং করা যাচ্ছে না। সহ-শিল্পী, কলাকুশলী, বিনিয়োগকারী সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আপনি জানেন অগ্নিযুগের বিপ্লবী ও নারীদের আইকন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ভূমিকায় তাঁর অভিনয় করার কথা। সরকারি অনুদানের ছবি এটা, তাঁকে জামিনে মুক্তি না দিলে এই ছবির শুটিং করা যাচ্ছে না। পরী মণি পরিচিত মুখ। তাঁকে সবাই চেনে। জামিন পেলে তিনি পালাবেন না। যেকোনো শর্তে আমরা তাঁর জামিন চাই। দয়া করে রিমান্ড বাতিল করে তাঁকে জামিন দিন।’
এরপরে বিচারক শুনানি শেষে জামিন নাকচ করে পরী মণির এক দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন। আগামী তিন দিনের মধ্যে এই রিমান্ড আদেশ কার্যকরের আদেশ দেওয়া হয়।
গত ৪ আগস্ট পরী মণিকে তাঁর বনানীর বাসা থেকে আটক করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। অভিযানে নতুন মাদক এলএসডি, মদ ও আইস উদ্ধার করা হয় বলে দাবি করে র্যাব। তাঁর ড্রয়িংরুমের কাবার্ড, শোকেস, ডাইনিংরুম এবং বেডরুমের সাইড টেবিল ও টয়লেট থেকে বিপুল মদের বোতল উদ্ধার করা হয় বলেও দাবি করা হয়। পরদিন ৫ আগস্ট বিকেলে র্যাব সদর দপ্তর থেকে পরী মণি, প্রযোজক ও অভিনেতা মো. নজরুল ইসলাম রাজ ও তাঁদের দুই সহযোগী আশরাফুল ইসলাম দীপু ও মো. সবুজ আলীকে বনানী থানায় সোপর্দ করে র্যাব। এরপর র্যাব বাদী হয়ে পরী মণি ও তাঁর সহযোগী দীপুর বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করে৷ সেদিন রাত ৮টা ২৪ মিনিটে পরী মণি ও তাঁর সহযোগীকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হয়। এরপর বনানী থানার মামলায় তাঁদের সাত দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। এ সময় আসামিপক্ষে তাঁদের আইনজীবী রিমান্ড বাতিল চেয়ে আবেদন করেন। অন্যদিকে, রাষ্ট্রপক্ষ রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আদালত তাঁদের চার দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এরপর ১০ আগস্ট পরী মণি ও তাঁর সহযোগী দীপুকে আদালতে হাজিরের পর ফের পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করে মামলার তদন্ত সংস্থা সিআইডি। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আদালত তাঁদের দুই দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
দুই দফায় রিমান্ড শেষে গত ১৩ আগস্ট পরী মণি ও তাঁর সহযোগী আশরাফুল ইসলাম দীপুকে আদালতে হাজির করা হলে আদালত তাঁদের জামিন আবেদন খারিজ করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।