ঘূর্ণিঝড় আসবে-যাবে, উপকূল পড়ে রবে!
আসছে নতুন ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’। সব ঘূর্ণিঝড় আসার আগেই এমন সংবাদে চায়ের কাপে ঝড় ওঠে। ইয়াসের সংবাদে এখন সরগরম সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর, সোশ্যাল মিডিয়া ও সংবাদ মাধ্যমগুলো। এমন সংবাদ এলেই খোলা হয় কন্ট্রোল রুম। উপকূলীয় জেলাগুলোর জেলা প্রশাসন নড়ে-চড়ে বসে প্রতিবার। প্রস্তুত হয় আশ্রয়কেন্দ্র ও স্বেচ্ছাসেবকেরা। সেটাই তো স্বাভাবিক।
কিন্তু এমন সংবাদ তো বারবার আসে। এর আগে বহুবার এসেছে। বলতে গেলে প্রায় প্রতি বছর আসে। ঠিক যেমন করে সংবাদ এসেছিল সিডর, আইলা, মহাসেন, রোয়ানু, মোরা, নার্গিস, ফণী কিংবা আম্পানের। আজ যেমন ইয়াসের পূর্বাভাস আসছে, বিগত দিনেও সব ঘূর্ণিঝড়ের সংবাদ এভাবেই এসেছে। প্রতিবারই ঘূর্ণিঝড়ের আগ মুহূর্তে এমন করে নড়ে চড়ে উঠেছে দেশের সব মহল।
ঘূর্ণিঝড় শেষে একটি নিষ্ঠুর বাস্তবতাও আছে। কোনো মতে ঝড় শেষ হলেই শেষ হয় এসব আলোচনা। শেষ হয় সবার সব করণীয়। সেই আগের মতোই পড়ে রয় উপকূল ও উপকূলীয় জনজীবন। মনে হয়, এই ঘূর্ণিঝড়ই যেন শেষ। আর কেনোদিন ঘূর্ণিঝড় হবে না। ঘূর্ণিঝড় থেকে একবার বেঁচে যাওয়া মানেই যেন আর কোনোদিন ঝড় আসবে না দেশে।
ঝড়ের পাশাপাশি ঝড়ের মতোই আসে আমাদের মেকিকান্নাও। যখনই বিপদ ঘনিয়ে আসে, তখনই কেবল মনে পড়ে বিপদের কথা। অথচ ঝড় শেষ হলেই ভুলে যাই, উপকূলের মানুষের জীবনের এমন অস্বাভাবিকতার গল্পগুলো। সরব মিডিয়াও স্বাভাবিক সময়ের অস্বাভাবিক উপকূলকে নিয়ে দু-চারটি প্রতিবেদনও করে না।
অথচ কোথায় বাঁধ দরকার? কোথায় গাছ কাটার উৎসব চলছে? কোথায় উন্নয়নের নামে নদীর পাড় কেটে মাটি বিক্রি হচ্ছে? কোথায় কোথায় ধ্বংস করা হচ্ছে প্রাণ প্রকৃতি? এসব তো দেখা উচিত ছিল সার্বক্ষণিক। এসব নিয়ে চিন্তা থাকার কথা বছর জুড়ে।
হয়তো এখন সুন্দরবন ঘিরে আবারও মায়াকান্না শুরু হবে। অথচ ঝড় যাওয়া মাত্রই বলবে কিসের সুন্দরবন! সে থাকলেও কি, না থাকলেই বা কি! নিজে বাঁচলে বাপের নাম। ঝড় গেলে আমাদের সব কৃতজ্ঞতা ঝড়ের বাতাসের মতোই উড়ে যায়।
আজ কেন মনে পড়ছে এসব? ঘূর্ণিঝড় আসছে বলে? সারা বছর কোথায় ছিল আপনার-আমার কিংবা আমাদের এই ভাবনাগুলো?
বলুন তো কজন খবর রাখে- জলবায়ু উদ্বাস্তু মানুষগুলো কে কোথায় যাচ্ছে? কেমন আছে? কিভাবে জীবন চলছে তাদের? প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে কি কেউ যায় উপকূলীয় হতভাগাদের কাছে?
প্রশ্ন আরও আছে। বাংলাদেশের পশ্চিম উপকূলের চিংড়ি চাষিদের বারবার পথে বসিয়ে দিচ্ছে ঝড়-বন্যা নামক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তাদের জীবনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের খোঁজ কে রাখে? জলবায়ু পরিবর্তন আর প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলের জল ও জঙ্গলের বিপন্ন গ্রামগুলোর কী খবর?
ঝড়-বন্যার পরপর মানবিক সংবাদ বা তথ্যচিত্রের ব্যাপক চাহিদা থাকে দেশ-বিদেশে। তাইতো উদ্বাস্তুদের গল্প-ছবি বিদেশি পত্রিকা অবধি পৌঁছে যায়৷ জলবায়ু পরিবর্তন আর উদ্বাস্তু হওয়া মানুষগুলোকে নিয়ে গবেষণা হয়। এনজিও বা নানা সংস্থার গবেষণা প্রকল্পে চাকরি হয় অনেকের৷ কিন্তু যাদের জন্য এ গবেষণা তারা কতটুকু সুফল পাচ্ছে?
যেসব প্রতিষ্ঠান জলবায়ু, পরিবেশ ও উদ্বাস্তু মানুষদের নিয়ে কাজ করছে, গবেষণা করছে, তাদের বলছি, এ দেশের মানুষের সুন্দর সাজানো একটি নিরাপদ পরিবেশ দিতে চাইলে আগে একটি উপকূল রক্ষার মাস্টারপ্লান দিন। সরকারকে বলছি, এই সব মানুষদের জন্য ফলপ্রসূ ও দীর্ঘস্থায়ী কিছু একটা করুন৷ পাশাপাশি মিডিয়াকেও বলছি, জীবন ও জনপদের আয়না হয়ে স্বাভাবিক সময়ে কতটা অস্বাভাবিক থাকে উপকূল তা একটু তুলে ধরুন। আপনার মিডিয়ায় উপকূলের জন্য বছরজুড়ে একটু স্পেস দিন। কারণ উপকূলের বিধ্বস্ত ওই মানুষগুলোর প্রতি মিডিয়ারও কিছু কর্তব্য বর্তায়।
আম্পানের পরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে যোগ হয়েছে করোনা মহামারি৷ টানাপোড়েনে পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে উপকূলের মানুষ৷ আর টেনে নিতে পারছে না জীবন৷ ওরা আজ জীবনের কাছে প্রশ্ন করে- আর কত দিন চলবে এমন? উপকূলে আর কতটা ভারি হবে হারানো গল্পের খতিয়ান!