টি-টোয়েন্টির মাশরাফি : জয়ে শুরু, জয়ে শেষ
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে মাশরাফির অবসর নেওয়ার ঘোষণার পর জাতীয় দলে তাঁরই সতীর্থ মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ নিজের ফেসবুক পেজে লিখলেন, ‘আপনি একজন যোদ্ধা, যোগ্য নেতা, অধিনায়ক ও সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন। আমি দুঃখিত, কিন্তু এটাই জীবন। আপনি আমাদের দেখিয়েছেন কীভাবে একটা দলকে একটা ফ্যামিলি বানানো যায়। আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। আপনি একজন অসাধারণ মানুষ ও চমৎকার খেলোয়াড় সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ম্যাশ আমরা সবাই আপনাকে ভালোবাসি। শ্রদ্ধা কিংবদন্তি।’
মাহমুদউল্লাহর লেখনীতে যেন পুরো বাংলাদেশের সুর। গোটা বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমী জনতা যা বলতে চায়, সেটাই যেন বলে দিয়েছেন মাহমুদউল্লাহ।
মাশরাফি যেন এক ফিনিক্স পাখি। এতবার ইনজুরিতে পড়ার পর, এতবার ছুরি-কাঁচির নিচে নিজেকে সঁপে দেওয়ার পর বিশ্বক্রিকেটে আর একজনও তো খেলা চালিয়ে যাননি! বিশ্বক্রিকেটে তন্ন তন্ন করেও একজনকে পাওয়া যাবে না, যার জাদুকরি ছোঁয়ায় বদলে যায় গোটা একটা দল, পরিণত হয় একটা ফ্যামিলিতে। মাশরাফি এখানেই ব্যতিক্রম। এখানেই তাঁর চির উন্নত মম শির।
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ায় মাশরাফির জন্য সর্বত্র হাহাকার, বাজছে বিষাদের করুণ সুর। এই মাশরাফি যখন সব ধরনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরে যাবেন, তখনকার চিত্র কেমন হবে, ভাবতেই তো বুকে মোচড় দেয়!
২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলে বাংলাদেশ। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে খুলনায় সেই ম্যাচে টসে হেরে ব্যাট করতে নামে বাংলাদেশ। মাশরাফির ব্যাট থেকে এসেছিল ২৬ বলে ৩৬ রানের ঝলমলে এক ইনিংস। তাঁর ইনিংসে ছিল দুটি করে ছক্কা ও চার। পরে বল হাতেও আগুন ঝরান মাশরাফি। চার ওভারে ২৯ রান দিয়ে নেন বিধ্বংসী ব্রেন্ডন টেইলরের গুরুত্বপূর্ণ উইকেটটি। ৪৩ রানে জয় পায় বাংলাদেশ। দারুণ অলরাউন্ডিং পারফরম্যান্সের জন্য ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার ওঠে মাশরাফির হাতে।
মাশরাফির এই অলরাউন্ডিং পারফরম্যান্স নিয়ে বাংলাদেশের সদরে-অন্দরে বড্ড হায়-হুতাশ শোনা যায় কান পাতলেই। যদি ইনজুরির কালো থাবা না থাকত, যদি বিরামহীন খেলে যেতে পারতেন মাশরাফি, তবে আরো অনেক বেশি উজ্জ্বল থাকত তাঁর ক্যারিয়ার, লাভবান হতো বাংলাদেশ।
সেই ২০০৬-এর পর ২০১৭। প্রায় এক যুগ সময় পেরিয়েছে। বারবার ইনজুরিকে পরাজিত করে মাশরাফি খেলেছেন আরো ৫৪টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি। শুরুটা যেভাবে জয় দিয়ে শুরু হয়েছিল মাশরাফির, শেষটাও তাই। পার্থক্য এটাই যে, শুরুর সে ম্যাচে মাশরাফি খেলেছিলেন শাহরিয়ার নাফীসের অধীনে। আর ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচে তিনি নিজেই টাইগারদের দলপতি।
৫৫ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে মাশরাফির উইকেট ৪২টি। সেরা বোলিং ইনিংস আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে। ২০১২ সালের ২১ জুলাই বেলফাস্টে সে ম্যাচে ১৯ রানে নিয়েছিলেন চার উইকেট। পরে ব্যাট হাতে ১৩ বলে চারটি ছক্কায় ৩০ রানের বিধ্বংসী ইনিংস খেলে দলের জয়ে রেখেছিলেন দারুণ ভূমিকা। বলাই বাহুল্য, সেবারও ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার মাশরাফি ছাড়া আর কারো হাতে ওঠার অবকাশ ছিল না। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে মাশরাফির বোলিং গড় ৩৬.৩৫, স্ট্রাইক রেট ২৭.১, ইকোনমি ৮.০৪।
ব্যাট হাতেও কখনো-সখনো কার্যকর ইনিংস খেলেছেন মাশরাফি। ৫৫ ম্যাচের ৩৯ ইনিংসে ৩৭৭ রান এসেছে তাঁর ব্যাট থেকে। অপরাজিত ছিলেন ১১ ইনিংসে। সর্বোচ্চ ইনিংস ৩৬ রানের, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। তাঁর ব্যাটিং গড় ১৩.৪৬। স্ট্রাইক রেট ১৩৬.১০। এসব ইনিংসে মাশরাফি চার হাঁকিয়েছেন ২৮টি, ছক্কা ২৩টি। টি-টোয়েন্টিতে মাশরাফির ক্যাচ আছে ১০টি।
এসব পরিসংখ্যান আসলে ‘বোকার ডায়েরি’। পরিসংখ্যান কখনোই বলবে না বাংলাদেশ দলের জন্য মাশরাফি কী ছিলেন। পরিসংখ্যান কখনোই বলবে না দলের জন্য মাশরাফির ত্যাগ, বারবার হোঁচট খেয়েও উঠে দাঁড়িয়ে প্রবল বিক্রমে ছুটে চলা। পরিসংখ্যান কখনোই বলবে না বছর আড়াই আগে হারতে হারতে ছন্নছাড়া, হতাশায় নিমজ্জিত একটি দলকে কীভাবে জয়ের মন্ত্রে উজ্জীবিত করে বিশ্বক্রিকেটের সমীহ আদায় করে নিয়েছেন মাশরাফি। টি-টোয়েন্টির মাশরাফিকে মিস করবে বাংলাদেশ, এটা বলার জন্য তাই জ্যোতিষী হওয়া লাগে না।
লেখক : কার্যনির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতি, সিলেট শাখা।