দৃষ্টিপাত
গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ এখন অভিভাবকহীন
শিক্ষাক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অসমতা সম্পর্কে বেগম রোকেয়া বলেছিলেন, স্বামী যখন পৃথিবী হইতে সূর্য ও গ্রহ নক্ষত্রের দূরত্ব মাপেন, স্ত্রী তখন একটা বালিশের ওয়ারের দৈর্ঘ্য প্রস্থ মাপেন! এই দুরবস্থা থেকে কতখানি বের হতে পেরেছি আমরা? এই লেখার উদ্দেশ্য গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন করছে সেটার পক্ষে কিছু যুক্তি তুলে ধরা, এর মধ্য দিয়েই পরিষ্কার হবে দেশে নারীর অবস্থান তথা গার্হস্থ্য অর্থনীতির শিক্ষাব্যবস্থা কোন পর্যায়ে রয়েছে।
গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এটি যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও ওকলাহামা স্টেট ইউনিভার্সিটির সহায়তায় ঢাকায় স্থাপিত হয়। বর্তমানে এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত একটি কলেজ।
গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে বিশ্বমানের পাঁচটি বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স চালু রয়েছে । বিষয়গুলো হলো খাদ্য ও পুষ্টি, বস্ত্র পরিচ্ছদ ও বয়ন শিল্প, শিশু বিকাশ ও সামাজিক সম্পর্ক, সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও উদ্যেক্তা, শিল্পকলা ও সৃজনশীল শিক্ষা। এই বিষয়গুলোতে প্রয়োজনীয় গবেষণা হলে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব দূরীকরণ, দেশীয় কাঁচামালের ব্যবহার বৃদ্ধি, দেশীয় উদ্যোক্তা তৈরিসহ বহুমাত্রিক উন্নয়ন সম্ভব। আমাদের বর্তমান শিক্ষা কাঠামোতে সেই পথ বন্ধ।
গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের ভর্তি পরীক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নেয় এবং এখানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের এইচএসসি ও এসএসসির ফলাফল গড়ে যেকোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ফলাফলের মতোই।এখানকার মেধাবী শিক্ষার্থীরা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় অনার্সের অনুপযোগী বইপত্র ও বহুবছরের পুরোনো নোট পড়ে কোনোমতে পড়াশুনার কাজ চালায়। ফলে শিক্ষার্থীরা এই নীরস শিক্ষা গ্রহণ করে বাকি জীবন হতাশায় কাটায়। ঢাবির ইনস্টিটিউট হলে এখানে যে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি বিষয় আছে সেগুলোর প্রয়োজনীয় গবেষণা হবে এবং শিক্ষাটা পরিপূর্ণ হবে। বর্তমানে এমফিল, পিএইচডির সুযোগ নেই, ইনস্টিটিউট হলে সুযোগ হবে। উচ্চশিক্ষিত মানুষ মানেই অধিক দক্ষ মানুষ। উচ্চশিক্ষা নিতে হলে একজন শিক্ষার্থীকে প্রকৃতির প্রকাশ্য ও লুকায়িত জ্ঞানের প্রতি সজাগ দৃষ্টি দিতে হয়, ফলে তার উদ্ভাবন ক্ষমতা বেড়ে যায়, পাশাপাশি সে ব্যক্তির দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধেরও জন্ম দেয় দেশের জন্য ভালো কিছু করার।
যে গার্হস্থ্য বিজ্ঞানকে আমরা মেয়েদের বিজ্ঞান বলছি তা যে আসলে ছেলেমেয়ে উভয়েরই বিজ্ঞান সেই সত্যকেও বাংলাদেশের মানুষ একদিন মেনে নেবে। গার্হস্থ্য বিজ্ঞানের বিকাশের লক্ষ্যে এই সত্য উদ্ভাবন করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। বর্তমানে এখানে শুধু মেয়েরা পড়ছে, ইনস্টিটিউট হলে ছেলে ও মেয়ে উভয়ই পড়বে। জ্ঞানের জগতে নারী-পুরুষ বলে কোনো কথা নেই, তা ছাড়া বিশ্বের যে কয়টি দেশে এই বিষয়গুলো পড়ানো হয় সব জায়গাতেই এগুলো নারী-পুরুষ উভয়েই পড়ছে এবং অনুষদ বা ইনস্টিটিউট হিসেবে আছে। ছেলেমেয়ে উভয়েই পড়লে গার্হস্থ্য নিয়ে মানুষের যে দৃষ্টিভঙ্গি তা পরিবর্তন হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিশুর বিকাশ ও সামাজিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থীরা যথাযথ শিক্ষা পেলে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারত। যেমন
১. শিশুদের জীবনের প্রাথমিক ভিত্তি রচিত হয় দুই বছর থেকে পাচ-ছয় বছরের মধ্যে। কাজী মোতাহার হোসেন লিখেছেন, ‘উন্নত দেশে দুই থেকে পাঁচ-ছয় বছর বয়সের শিশুর শিক্ষার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হয়।’ এইসময়ের বিকাশকে প্রারম্ভিক শৈশবের বিকাশ বলা হয়। অথচ এই সময়ের বিকাশকে কেন্দ্র করে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন দেখা যায় না। বর্তমানে সচেতন বাবা-মায়েরা চাইছেন তাঁদের সন্তানদের নির্ভরযোগ্য কোনো প্রতিষ্ঠানে দিতে কিন্তু সেই আয়োজন বাংলাদেশে নেই।
শিশুদের মানসিক অবস্থা নির্ণয় করে সেভাবে পদক্ষেপ নিলে হয়তো শিশুদের নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সহজ হতো, কিন্তু কোথায় পাব আমরা শিশু মনোবিজ্ঞানী?
শিশুদের উপযোগী শিক্ষা উপকরণ, খেলাধুলার সামগ্রীর বড় অভাব আমাদের এখানে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিদেশি উপকরণের ওপর নির্ভরশীল আমরা। মানসম্মত দিবাযত্ন কেন্দ্র, শিশু যত্নকেন্দ্র আমাদের এখানে নাই বললেই চলে।
পড়াশোনার মান উন্নয়নের জন্য ও গার্হস্থ্য অর্থনীতি শিক্ষার বিকাশের জন্য শিক্ষার্থীদের অনেক বছরের জোড়ালো দাবি এই অধিভুক্ত কলেজটিকে ঢাবির পূর্ণাঙ্গ ইনস্টিটিউট করা হোক। একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রে এর চেয়ে ন্যূনতম দাবি আর কী হতে পারে! ২০১৬ সালের ৪ অক্টোবর শিক্ষার্থীরা টানা আট ঘণ্টা ইনস্টিটিউটের দাবিতে নীলক্ষেতে অবস্থান নেয় এবং ক্লাস, পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেয়। পরে সেদিনই শিক্ষামন্ত্রী রাত ৮টার দিকে আমাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন এবং তিনি দাবির বিষয় খতিয়ে দেখার জন্য শিক্ষাসচিবকে আহ্বায়ক করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীরা যথারীতি ক্লাস,পরীক্ষায় অংশ নেয়। কিন্তু এই কমিটি ৬ মাসের মধ্যে দুটি মিটিং ছাড়া আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি এবং মিটিংয়ে আমরা আমাদের দাবির যৌক্তিকতা ও সমস্যার কথা তুলে ধরি। আমাদের দাবিকে তারা অযৌক্তিক বলেনি এবং নীতিগতভাবে আমাদের সমর্থন দিয়েছে। অবশেষে শিক্ষার্থীরা ২০১৭ সালের মার্চের ১১ তারিখে আবারও পরীক্ষা বর্জন করে এবং দাবি আদায় না হলে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেয়। যে কারণে এখনো ক্লাস,পরীক্ষা বর্জন আছে।
এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। উপাচার্য মহোদয় দাবির বিষয়ে বলেছেন এই বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া হবে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন দাবি আদায় রাতারাতি সম্ভব নয়। রাতারাতি কোনো কিছুই সম্ভব নয়, সেজন্যই আমরা ছয় মাস অপেক্ষা করেছি কিন্তু কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। এভাবে কর্তৃপক্ষ আমাদের দাবির বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে, ফলে আমরা অভিভাবকহীন একটি অবস্থার মধ্যে আছি। শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অভিভাবকত্ব অস্বীকার করার কি কোনো উপায় আছে? প্রশ্নটি করেছিলেন আহমদ ছফা।
লেখক : শিক্ষার্থী, শিশু বিকাশ ও সামাজিক সম্পর্ক বিভাগ, গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ