পয়লা বৈশাখ নিয়ে আমাদের আপত্তি অমূলক

পয়লা বৈশাখ বাংলা মুল্লুকের নৃগোষ্ঠীর লোক উৎসব। হিন্দু-মুসলমান উভয়ের জন্য এটা প্রজেক্ট করেছে খোদ মুসলমান শাসকরা। বঙ্গাব্দের পত্তনসহ বৈশাখের লোকাচারকে উৎসাহিত করেছেন তাঁরাই। কাল পরিক্রমায় মুসলমানরা এসব রেওয়াজ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিলে এটা একচ্ছত্র সেকুলারদের অধিকারে চলে যায়। আজকের একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে পহেলা বৈশাখের চেহারা নিয়ে যেসব আপত্তি উঠছে, তার আংশিক অমূলক, বাকিটার জন্য দায়ী এসবে মুসলমানদের অনুপস্থিতি।
১. জাতীয় সংস্কৃতি থেকে বাঙালি মুসলমানের দূরত্ব তৈরি হয় দুই ফেজে। প্রথমত, ঐতিহ্যগত অতি পাতি মুসলমানি আকাঙ্ক্ষার বশবর্তী হয়ে, দ্বিতীয়ত জামায়াত চেতনার ফেরে। মুসলমানদের মধ্যে একটা অংশ আছে যারা কারবালাকেন্দ্রিক হযরত আলীপন্থীদের লোকাচারসহ বাংলার স্থানীয় পালাপার্বণের বিরোধিতা করে। কিন্তু এ দেশের মুসলমানদের জন্য বড় বিপদ ঘটে একাত্তরের অভিঘাতে। মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী তথা ইসলামপন্থী রাজনীতি এ দেশে পরাজিত হয়। পরবর্তীকালে এই পরাজয়কে তারা সাংস্কৃতিকভাবে মুসলমানদের পরাজয় আকারে তুলে ধরে। তারা একুশে ফেব্রুয়ারি, মুক্তিযুদ্ধ, পয়লা বৈশাখ প্রভৃতির মধ্যে থাকা নানান দেশজ উপাদানকে হিন্দুয়ানি বলে প্রজেক্ট করতে থাকে। এতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে ইসলামি চেতনার এক ধরনের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এই শূন্যস্থানে জাতীয় সাহিত্য-সংস্কৃতির ঠেকগুলো সেকুলারদের একচ্ছত্র অধিকারে চলে যায়। এ কথাও সত্য যে বাংলাদেশের অধিকাংশ সাংস্কৃতিক অবকাঠামোর নির্মাণ ও নবায়ন ঘটেছে সেকুলার নেতৃত্বে। এ দেশের সেকুলাররা যেহেতু হিন্দুঘেষা, তাই এসব গণপার্বণে হিন্দুধর্ম থেকে নেওয়া উপাচার বেড়েছে। আবার এ কথাও ভাবতে হবে, ইঁদুর-পেঁচা-বাঘ-সিংহ হিন্দু দেবদেবীর বাহন বলে এসব বাঙালি মুসলমানের জীবন-সংস্কৃতির বাইরের অনুষঙ্গ নয়। এসব নিয়ে আপত্তি তোলা শেষ পর্যন্ত হাস্যকর ও অতি-সেকুলার ভীতির পরিচায়ক।
এ ছাড়া ঐতিহাসিকভাবে বাঙালিরা ইসলামপন্থী পাকিস্তানের সঙ্গে সংগ্রাম করে এবং হিন্দুপন্থী ভারতের সহায়তা নিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। আরো বড় কথা, ইসলাম গ্রহণের আগে এখানকার জনগোষ্ঠী হিন্দু বা লোকধর্মের অনুসারী ছিল। সুতরাং বাংলার রন্ধ্রে রন্ধ্রে এসবের চিহ্ন থাকা স্বাভাবিক। এ দেশের লোকদেবতা ‘বনদেবী’ মুসলমানদের সংস্পর্শে ‘বনবিবি’ হয়েছে। ইসলামের আদিভূমি ইরানেও সোহরাব-রুস্তমকে নিয়ে লেখা হয়েছে মহাকাব্য। তাদের জাতীয় বীর বলে গ্রহণ করতে কোনো সমস্যা হয় নাই পারস্যবাসীর, আমাদেরও না। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় প্রতীক ও এয়ারলাইনসের নাম এখনো হিন্দুদের পৌরাণিক পাখি ‘গরুড়’ (Garuda) অথবা ব্রুনেইয়ের রাজধানীর নাম রাখা হয় ‘বন্দর শ্রী ভগবান’ (Bandar Seri Begawan)। ইসলামপূর্ব ইরানের পৌরাণিক পাখি ‘সিমুর্গ’কে (simurgh) দেখা যায় দেশটির মুদ্রাসহ প্রধান প্রধান অনুষঙ্গে। ফলে পয়লা বৈশাখের বিরুদ্ধে অভিযোগের উৎস আসলে প্রধানত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত।
২. ইসলামের সঙ্গে জনগোষ্ঠীর জাতীয় সংস্কৃতির আসলে বিরোধ নাই। থাকলে কোনো মুসলমানই আরবি ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলত না। ভাষাকে যখন ইসলাম অস্বীকার করে নাই, সংস্কৃতিকেও অস্বীকার করে না, এই সত্যটা অনেকেই বেমালুম চেপে যান। অবশ্য অতি মুসলমান ট্রেন্ডে এই প্রচেষ্টাও ছিল। মনে করা হয়েছিল আরবের বাইরের মুসলমানরা তাদের দেশীয় ভাষাতেই কথা বলবে কিন্তু লেখার হরফ হবে আরবি। ফার্সি থেকে উর্দু পর্যন্ত এই ঘটনা ঘটেছে- এরপর এটা আর কার্যকর থাকে নাই। পয়লা বৈশাখ বাঙালি জনগোষ্ঠীর জাতীয় সংস্কৃতি, এর কোনো উপাদান নিয়ে আপনার অভিযোগ-আপত্তি থাকতে পারে কিন্তু এর সাথে ইসলামের বিরোধের কথা মনগড়া। পয়লা বৈশাখ তো একটা লোক-মজমা মাত্র, ধর্মীয় আচারের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে যেসব সংস্কৃতি সাংঘর্ষিক নয়, তা ইসলাম গ্রহণ করেছে। ইহুদিরা মহররমের রোজা রাখত বলে মহানবী (সা.) সেটা বাদ দেন নাই। ইহুদিদের পবিত্র রজনী ছিল, মুসলমানদেরও আছে শবে কদর।
৩. মুসলমান শাসকদের আগমনের পর আরবি-ফার্সি শব্দের প্রাদুর্ভাবে ভারতের প্রায় সব লোকাল ভাষা পূর্ণ ভাষা হয়ে ওঠে। আরবি-ফার্সির প্রভাবেই প্রাকৃতভাষা ঋদ্ধ হয়ে রূপ নেয় বাংলা ভাষায়। কিন্তু আধুনিক বাংলা গদ্যের জন্ম হিন্দু পণ্ডিতদের হাতে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বিশেষ তত্ত্বাবধানে বাংলা ভাষা থেকে আরবি-ফার্সি শব্দ বাদ দিয়ে সেখানে বসানো হয় সংস্কৃত শব্দ। যে কারণে আজকের বাংলা ভাষাকে দেখতে সংস্কৃতির দুহিতা বলে মনে হয়। এ কারণে কি মুসলমানরা বাংলা ভাষা ত্যাগ করেছে? অবশ্য সে চেষ্টাও যে হয় নাই তা নয়।
৪. মুসলমানদের একটা অংশ মিলাদ মাহফিলের মতো মজমাকেও ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক বলে অনুৎসাহিত করে। ইসলাম যাদের হাতে বিকশিত হয়েছে সেই সুফি-পির-আউলিয়াদের অবমাননা এবং মাজার সংস্কৃতিকে অনৈসলামিক প্রতিপন্ন করা হয়েছে আগেই। খোদা হাফেজ থেকে আল্লাহ হাফেজ, নামাজ থেকে সালাত, রোজা থেকে সিয়ামের পথের শুদ্ধি অভিযানের গূঢ় ইতিহাস অবিদিত নয়। অন্যদিকে সেকুলাররাও এ দেশের জাতীয় ইতিহাসের বীর ১৮৫৭ সালের সিপাহীসহ শরীয়তুল্লাহ, তিতুমীর, দুদুমিয়াদের আড়াল করে প্রেজেন্ট করেছে সূর্যসেন-প্রীতিলতাদের। মুসলমানদের সঙ্গে জাতীয় সংস্কৃতির এই দূরত্বের চাপ দুই দিক থেকেই সমানভাবে এসেছে।
৫. জাতীয়তা বুঝাবুঝির ক্ষেত্রে মার্কসবাদীদেরও একই সমস্যা দেখা গেছে। যে কারণে একাত্তরে মাও সেতুংয়ের চীন মুক্তিযুদ্ধের প্রতি উদাসীন ছিল। জাতীয় চেতনা বুঝার সীমাবদ্ধতার কারণে এ দেশের মুসলমানদের একটা অংশও পয়লা বৈশাখের প্রতি এই ওজর-আপত্তি তুলছে। পয়লা বৈশাখে তাদের অংশগ্রহণ সমান হলে এতে ইসলামী উপাদান-উপাচারও থাকত সমানমাত্রায়। প্রশ্ন উঠত না ধর্মের অনুমোদন বা সাংঘর্ষিকতা নিয়েও।
লেখক : কবি ও সংবাদমাধ্যমকর্মী