১৯৭১
নির্মমভাবে হত্যা করা হয় শহীদ সুখরঞ্জনকে

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে পাকিস্তান বাহিনী যখন বুঝতে শুরু করে যে তাদের পক্ষে যুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়, তখন তারা দেশকে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে দুর্বল ও পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য পরিকল্পনা করতে থাকে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৪ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সহায়তায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিজ নিজ গৃহ থেকে তুলে এনে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে। তবে এর আগে কয়েকজন বুদ্ধিজীবীকে নির্মমভাবে হত্যা করে তারা।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশের যতজন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিভাগের অধ্যাপক শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার।
১৯৭১ সালে সারা দেশে পাক বাহিনী যখন হত্যাকাণ্ডে মেতে উঠেছিল, সেই সময়ের ২৬ মার্চ ভোররাতের দিকে পাক-সেনারা ঢুকে পড়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। শিক্ষকদের আবাসিক ভবনের অনেক বাসাই তখন খালি ছিল। প্রথমে যখন পাক বাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছিল, তখন তারা খালি বাসাগুলোতে লুটতরাজ করে নিয়ে যায়।
১৩ এপ্রিল আবারও পাকিস্তানি সেনারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে। সেদিন সন্ধ্যায় যুদ্ধে আহত একজন বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা ইপিআর সেনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সুখরঞ্জন সমাদ্দারের বাসায় এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ওই ইপিআর সেনাকে আশ্রয় দিলে বিপদ হতে পারে জেনেও তাঁকে আশ্রয় দেন এবং তাঁর রক্তাক্ত ক্ষতস্থান বেঁধে দিয়ে সারা রাত তাঁর সেবা করেন। পরদিন ১৪ এপ্রিল সকালে পাকিস্তানি সেনারা সুখরঞ্জন সমাদ্দারকে ধরে নিয়ে যায়। ঘাতকরা তাঁকে সেদিনই নির্মমভাবে হত্যা করে ফেলে রেখে দেয়। তাঁর বাসার গোয়ালা গুলিবিদ্ধ সুখরঞ্জনকে মাটিচাপা দেন, যা তিনি বিজয়ের পর পরিবারকে জানান। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর দেহাবশেষ তুলে এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের সামনে পুনঃসমাহিত করে।
সুখরঞ্জন সমাদ্দার ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলার ইলুহার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কার্তিক চন্দ্র সমাদ্দার ও মা প্রফুল্লবালা সমাদ্দার। তিনি ১৯৫২ সালে স্থানীয় বাইশহারী স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৫৪ সালে বরিশাল বিএম কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৭ সালে সংস্কৃতে বি.এ (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃতে এমএ পাস করেন। ১৯৫৮ সালে সুখরঞ্জন সমাদ্দার গোপালগঞ্জ কলেজে অধ্যাপনা শুরু করার এক বছর পর ১৯৫৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত (ভাষা) বিভাগে প্রভাষক নিযুক্ত হন। তিনি ছিলেন মুক্তবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার অধিকারী। নজরুলগীতি ও রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল।
সুখরঞ্জন সমাদ্দারের স্ত্রীর নাম চম্পা রানী সমাদ্দার। এ দম্পতি এক পুত্র ও দুই কন্যর জনক। পুত্র সলিলরঞ্জন সমাদ্দার চিকিৎসক, কন্য মল্লিকা সমাদ্দার ও সুস্মিতা সমাদ্দার দুজনই শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর নামানুসারে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের (টিএসসিসি) নামকরণ করেছে 'শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার ছাত্র-শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।