বাংলার মুস্তারেবিন

বাঙালি সংস্কৃতি রক্ষার দোহাইয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখকে ঔপনিবেশিক মানসিকতার পরিচায়ক বলতে শোনা যায় কোথাও কোথাও। তারা বলতে চায়, ভাষা দিবস ৮ ফাল্গুন মোতাবেক পালিত হওয়া উচিৎ। যদিও ব্যাপারটায় গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই, তবু প্রসঙ্গ ওঠায় দুটো কথা বলা অমূলক হবে না। আশি-নব্বইয়ের দশকের সমাজসম্পর্কহীন বাঙাল কমিউনিস্টদের কারো কারো মুখেও নাকি এমন কথা শোনা যেত। আমার বরাবরই মনে হয়, এই মতের অনুসারীরা মূর্খ- মানব সম্প্রদায়ের বিবর্তনিক রসায়ন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়, নইলে তাদের কোনো ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে।
বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি প্রধানত গড়ে উঠেছে তিনটি বড় উপনিবেশের ওপর ভিত্তি করে। খাঁটি দেশীয় বলে কিছু আর আমাদের নেই, এ ধরনের নিখাদ জাতিসত্তা সম্ভবও নয়। ইউরোপীয় উপনিবেশের মতো আর্য ও মুসলমানরাও বহিরাগত। বাংলা ভাষায় বহিরাগত আরবি ও ফারসি ভাষার অবদান মাতৃগর্ভের মতো। ড. আহমদ শরীফসহ পণ্ডিতদের মতে, আরবি-ফারসির সান্নিধ্যে এসেই দ্বাদশ থেকে চতুর্দশ শতকে বাংলাসহ ভারতের আঞ্চলিক ভাষাসমূহ সাহিত্যের ভাষা হয়ে ওঠে। সংস্কৃত ভাষার অবদানের কথা আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না (সংস্কৃত কলেজের শল্যচিকিৎসায় আরবি-ফারসির স্থলে সংস্কৃত শব্দ প্রতিস্থাপনের বিষয়টি এ আলোচনায় প্রাসঙ্গিক নয়)। তেমনি অধুনা বাংলায় ইউরোপীয় ভাষা-সংস্কৃতির প্রদায়নও জোরদার। বাংলায় এ তিন পর্বেরই (সংস্কৃত, আরবি-ফারসি ও ইংরেজি) আগমন ঘটেছে ঔপনিবেশিক প্রক্রিয়ায়। কিন্তু প্রত্যেকের কাছ থেকেই বাংলা গ্রহণ করেছে বিপুল রসদ। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে গোটা উপনিবেশকেই বাংলা আত্মীকরণ করে নিয়েছে।
আমাদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সম্পর্কের নাম আব্বা এসেছে ফারসি থেকে, বাবাও তুর্কি। তবে মা ও আম্মার জন্ম সংস্কৃতে। মামা-মামি-ফুপা-ফুপু দেশি, কিন্তু চাচা-চাচি সংস্কৃত, খালা-খালু আরবি। স্বামী-স্ত্রী, জামাই-বউ সংস্কৃত কিন্তু নিকাহ-তালাক আরবি, আবার বিয়ে-শাদি সংস্কৃত-ফারসির সমার্থক দ্বিরুক্তি। চাউল মুণ্ডারী শব্দ, চুলা সংস্কৃত, ভাতও এসেছে সংস্কৃত থেকে, আর হিন্দি থেকে পানি এনেছে মুসলমানরা (বলা হয় ভারতে আসার আগে মুসলমানরা সংস্কৃত থেকে পানি শব্দটি গ্রহণ করেছিল)। হাট শব্দ সংস্কৃত হলেও বাজার এসেছে ফারসি থেকে। আমাদের অদ্বিতীয় খোদা ফারসি, আর প্রাণকে বুঝতে শিখেছি সংস্কৃত আত্মা দিয়ে। ন্যায়বিচারের ধারণা পেয়েছি আরবি ইনসাফ থেকে। সংঘবদ্ধ লড়াইয়ের জন্য ইনকিলাব আর মহিমান্বিত শহিদের ধারণা পেয়েছি আরবি থেকে। আমাদের জমি-জমার হিসাব আর আইন-আদালতের প্রায় সব পরিভাষাই আরবি-ফারসির। আমাদের স্কুল-কলেজ ইংরেজি হলেও বই-কলম আরবি, আবার পুস্তক সংস্কৃত। পরনের লুঙ্গি এসেছে ফারসি থেকে। বালতি-গামলা পোর্তুগিজদের। রিকশা দিয়েছে জাপানিজরা। আর, আমরা দিন গণনার হিসাব খুলেছি ব্রিটিশদের ব্যবহারিত ক্যালেন্ডার মতে; যদিও তারিখ শব্দ এসেছে আরব থেকে। আমাদের বার ও ঋতুর ধারণা বাংলা হলেও দিন, মাস ও বছরের হিসাব খ্রিস্টীয় সন মোতাবেক, ভারতীয় অব্দ জুড়ে তাকে খ্রিস্টাব্দও করা হয়েছে। আমাদের শার্ট-প্যান্ট-চেয়ার-টেবিল-অফিস-ডাক্তার-পুলিশ ইংরেজদের কাছ থেকে পাওয়া।
দীর্ঘ উপনিবেশের কারণে, বাইরের অনেক কিছুই আমাদের অংশ হয়ে গেছে, যার সবটা এখন আর কেবল ঔপনিবেশিকতার সৃষ্টিজাত চিহ্নিত করে বিযুক্ত করা সম্ভব নয়। তা জাতীয় ও সামাজিক জীবনের স্বাভাবিক গতিময়তার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক হবে। তবে এ কথাও ঠিক, ইউরোপীয় উপনিবেশ আমাদের ধরন অনেক বদলে দিয়েছে। কার্ল মার্কস যাকে বর্ণনা করেছেন, ‘ভারতের সমস্ত অতীত ঐতিহ্য, সমগ্র অতীত ইতিহাস থেকে বিচ্ছেদ’ হিসেবে। তাই ঔপনিবেশিক মানসিকতায় জর্জড়িত আমাদের মজ্জা। কিন্তু ঔপনিবেশিক মানসিকতা ও ঔপনিবেশিকতা থেকে প্রাপ্ত উপাদান সর্বদা এক নয়। যে প্রক্রিয়ায় আসুক এসব রূপান্তরকে স্বধর্মে চালিত করে নেওয়া মানবজীবনের অন্যতম ধর্ম। এটাই ঘটেছে মানবেতিহাসে। ফলে, ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে আসা হাজার উপাদান আছে যা এখন বাংলার জাতীয় প্রাণের অংশ। খ্রিস্ট্রীয় সালে দিন গণনাও আমাদের এমনই একটি রূপান্তর। যে কারণে ফাল্গুনের ৮ নয়, উপনিবেশজাত ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখই বাংলার জাতীয় চেতনার প্রতীক হয়ে উঠতে পেরেছে।
গত ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে আমাদের জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু একটি তারিখ নয়, জাতির ঐতিহাসিক রূপান্তর অধ্যায়ের প্রতীক হিসেবেও সবার হৃদয়ের গভীরে স্থান পাওয়া একটি দিন। এটি যে শুধু একটি তারিখ নয়, তা ধ্বনিতাত্ত্বিক ও লেখ্যরূপ থেকেও পরিষ্কার। আধুনিক রীতিতে তারিখ লেখার যে রীতি তৈরি হয়েছে তাতে শুধু তারিখ অর্থে দিনটি ২১ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু ভাষাশহীদ দিবস আমাদের উচ্চারণ ও লেখ্যরূপে এখনো অবিকৃত ‘‘২১শে’ বা ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এই তারিখটিকে বাংলায় রূপান্তরের সবক প্রকৃতপক্ষে সেই প্রতীকটিকেই গায়েব করার চেষ্টা। তাই, একুশে ফেব্রুয়ারির বদলে ৮ ফাল্গুনে ভাষা দিবস উদযাপনের কথা যারা বলে, তাদের বাঙালি সংস্কৃতির সাচ্চা অনুরাগী ভাবার অবকাশ আসে না। একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখ গণনাকে ঔপনিবেশিক মানসিকতা বলা এই কথিত বাঙালি সংস্কৃতিপ্রেমী গোষ্ঠীকেই আবার দেখা যায়, হিন্দুত্ববাদী রেপ্লিকা ব্যবহারের অভিযোগ তুলে ইসলামি সংস্কৃতি রক্ষার দোহাইয়ে পয়লা বৈশাখ উদযাপন বিরোধিতা করতে।এরা আসলে মুস্তারেবিন। অর্থাৎ, অবিচারের শিকার ও সংগ্রামশীল জনগোষ্ঠীর পক্ষে স্লোগান দিয়ে, তাদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে তাদের ভুল পথে পরিচালিত করাই এদের কাজ। এদের উদ্দেশ্য ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির সামনে অস্তিত্ব সংকটে ভোগা জনগোষ্ঠীকে সাংস্কৃতিক স্বার্থ রক্ষার তাগিদ দেখিয়ে অচলায়তনে ঠেলে দেওয়া। যাতে এই উপনিবেশিতরা কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে লড়বার মতো উপযুক্ততা অর্জন করতে না পারে। মুস্তারেবিনেরা এখানে যুগপৎ বাঙালি সংস্কৃতি, ইসলামি সংস্কৃতির স্বার্থ হেফাজতের কথা বলে বাঙালিত্ব ও মুসলমানিত্বের মধ্যে দূরত্ব রক্ষার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ইসলাম ও বাঙালি সংস্কৃতির অস্পষ্ট ইস্যুগুলোই সাধারণত এদের প্রকল্প হয়। ৮ ফাল্গুনবাদও এ রকম একটি চিন্তা। তাদের এই কপট ঔপনিবেশিক মানসিকতা বর্জনের ডাক শুনলে আপনাকে প্রথমেই ভুলতে হবে খ্রিস্টীয় সন মোতাবেক একাত্তরের মহাসিন্ধুর কল্লোল। ভুলতে হবে বাঙালির রাষ্ট্রবাসনার সূত্রাধার রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। বাঙালি মুসলমানের রাষ্ট্রপ্রকল্পে আঘাত করা, রাজনৈতিক চেতনা অপরিচ্ছন্ন করে দেওয়াই এদের মিশন। বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের সংকট বাড়িয়ে কূপমণ্ডুকতা নির্দেশ করাই তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক