অভিমত
শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নে কিছু জরুরি বিবেচ্য
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2016/05/19/photo-1463648262.jpg)
বাংলাদেশে শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার দরকার। অপব্যবস্থার জায়গায় সুব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। এর জন্য প্রথম পর্যায়ে দরকার সর্বজনীন কল্যাণে যুক্তি অবলম্বন করে দূরদর্শী চিন্তাভাবনা, আলোচনা-সমালোচনা ও বিচার-বিবেচনা। শিক্ষানীতি এবং শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো কেমন হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে ধারণা যদি ঠিক হয়, তাহলে সে লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমে চেষ্টা চালালে সব সমস্যারই সমাধান করা যাবে। অন্যথায় যত চেষ্টাই করা হোক, অবস্থার উন্নতি হবে না। লক্ষ্য ও যাত্রাপথ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা অবলম্বন করে এগোতে হবে।
উন্নত প্রযুক্তি ও শ্রমশক্তির কল্যাণে উৎপাদন ও সম্পদ বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু নৈতিক চেতনার নিম্নগামিতার কারণে সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এবং মানুষ অমানবিকীকৃত হয়ে চলছে। এ অবস্থায় শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি রাষ্ট্রের অন্য সব ব্যবস্থারও সংস্কার দরকার।
অভীষ্ট সংস্কারের জন্য কত কালের প্রচেষ্টা লাগবে, বলা যায় না। তবে অবস্থা যাতে আরো খারাপ না হয় এবং উন্নতির শর্ত তৈরি হয়, তার জন্য কাজ করে যেতে হবে।
শিক্ষাক্ষেত্রে যে অবস্থা বিরাজ করছে এবং জনমন যেভাবে বিভক্ত হয়ে আছে, তাতে সহজে কিছু করা যাবে না। অভীষ্ট-নির্ণয়ের ও অভীষ্ট-অর্জনের জন্য যাঁরা কাজ করবেন, তাঁদের সঙ্ঘবদ্ধ দূরদর্শী ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। যেমন—
১. প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণির পরিবর্তে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত করে এর মান উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা বাতিল করতে হবে। এ দুটি পরীক্ষা প্রবর্তনের ফলে কোচিং সেন্টার, গাইড ও বুক ইত্যাদির ব্যবসায়ে স্বর্ণযুগ দেখা দিয়েছে। এগুলো বাতিল করা হলে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যেসব শক্তি যুক্ত, তারা এই পরিবর্তনের কারণে প্রকাশ্যে ও গোপনে বাধা দেবে।
২. কথিত সৃজনশীল পরীক্ষা-পদ্ধতি পরিবর্তন করে এমন পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে, যা হবে শিক্ষামুখী, জ্ঞানমুখী—যা শিক্ষার্থীদের মনে অসুসন্ধিৎসা, পাঠানুরাগ, সুনাগরিকত্ববোধ ও উন্নত জীবনের আকাঙ্ক্ষা জাগাবে। শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আনন্দের যোগ ঘটাতে হবে। বর্তমানে শিশু-কিশোররা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে শিক্ষার্থী হিসেবে; কিন্তু তার পরেই তারা বোঝা পিঠে নিয়ে পরীক্ষার্থী হয়ে যায়, শিক্ষার্থী আর থাকতে পারে না। এ অবস্থা পরিবর্তন করতে হবে। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, ইউনেস্কো ও ইউনিসেফের অন্ধ অনুসারীরা পরীক্ষা-পদ্ধতির অভিপ্রেত পরিবর্তন সাধনে বাধা দেবে। সাম্রাজ্যবাদীরা দুর্বল জাতিগুলোতে শিক্ষার উন্নতি চায় না—তারা কেবল সার্টিফিকেট দিয়ে সন্তুষ্ট রাখতে চায়। জ্ঞানেই শক্তি, বৃহৎ শক্তিবর্গ এটা বোঝে, এবং এই শক্তিকে তারা কেবল নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়। জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদের চেতনা নিয়ে, জাতীয় ঐক্য অবলম্বন করে, সাম্রাজ্যবাদী নীতি ও প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে হবে।
৩. ইংলিশ ভার্সন বিলুপ্ত করতে হবে। যারা বড় চাকরি পাওয়ার জন্য কিংবা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রে নাগরিকত্ব লাভের জন্য সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতে চান, তাঁদের জন্য ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে বাংলাদেশে পরিচালিত এ-লেভেল, ও-লেভেল পড়ার সুযোগ আছে। পশ্চিমা আরো কোনো কোনো রাষ্ট্রের সরকার বাংলাদেশে ইংরেজি মাধ্যমে স্কুল চালাচ্ছে। সেসবের পাশে ইংলিশ ভার্সনের প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশে যাঁরা আজকাল কেবল বিশ্বমান অর্জনের কথা বলেন, তাঁরা জাতীয় অস্তিত্ব ও জনজীবনের কথা একটুও ভাবেন।
৪. সারা দেশে সব শিশুকে বিদেশি ভাষা শেখানোর দরকার নেই। চাহিদা বিবেচনা করে, সংখ্যা নির্ধারণ করে নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি ও আরো কয়েকটি বিদেশি ভাষা ভালো করে শেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে সারা দেশের সব শিশুকে বিদেশি ভাষা শেখানো হয় না। বর্তমানে মূলধারার (এনসিটিবি যে ধারার পাঠ্যপুস্তক জোগান দেয়) বাংলা মাধ্যমের শিক্ষায় ইংরেজি শেখানোর যে ব্যবস্থা আছে, জনস্বার্থে তার গুরুতর পুনর্বিবেচনা দরকার। উচ্চশিক্ষার পর্যায়ে সবাইকেই অন্তত একটি বিদেশি ভাষা ভালো করে শিখতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলা ভাষা শেখার ব্যবস্থাকে উন্নত করতে হবে।
৫. মাধ্যমিক পর্যায়ে মূলধারার বাংলা মাধ্যমে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিক শাখাকে একীভূত করে এক ধারায় পরিণত করতে হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে জাতীয় ইতিহাস, পৌরনীতি ও নীতিশিক্ষাকে বাধ্যতামূলক বিষয়রূপে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মূলধারার বাংলা মাধ্যমের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার পাঠ্যসূচি, পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তক উন্নত করতে হবে। পেশামূলক শিক্ষাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে এবং তার পাঠ্যসূচিতে জাতীয় ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও নীতিশিক্ষাকে আবশ্যিক বিষয়রূপে যথোচিত স্থান দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদের নীতি অবলম্বন করতে হবে। মূলধারা খুব বেশি ত্রুটিপূর্ণ ও বিকারপ্রাপ্ত। মূলধারার শিক্ষাকে উন্নত করা হলে তার পাশে মাদ্রাসাধারাও উন্নতিতে আগ্রহী হবে। বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নিয়ে বিরোধ তীব্র হওয়ার ফলে এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ মাদ্রাসার আধুনিকীকরণে বেশি ব্যস্ত হওয়ার ফলে সৃষ্ট ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে মূলধারার বাংলা মাধ্যম বিকৃত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চলছে।
৬. মাদ্রাসাশিক্ষার ক্ষেত্রে মাদ্রাসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহলগুলোর মতামতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। যে অবস্থা চলছে তাতে বিরোধমূলক নীতি পরিহার করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি অবলম্বন করতে হবে। রাষ্ট্রের সংবিধানের আওতায় থেকে সবকিছু করতে হবে।
৭. যেসব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু করা হয়েছে, সেগুলোতে সেমিস্টারের মেয়াদ চার মাস কিংবা ছয় মাসের পরিবর্তে এক বছর করতে হবে। পরীক্ষার ফল গ্রেড পয়েন্টে প্রকাশ করা অব্যাহত রাখতে হবে। গবেষণায় গবেষকদের স্বাধীনতা বাড়াতে হবে। উচ্চশিক্ষার ২০ বছর মেয়াদি কৌশলপত্রের স্থলে জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ অবলম্বন করে নতুন উচ্চশিক্ষানীতি প্রবর্তন করতে হতো।
৮. জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদভিত্তিক কর্মনীতি নিয়ে গ্রেকো-রোমান-আমেরিকান সভ্যতার প্রগতিশীল মহান বিষয়াদিকে—দর্শন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্য, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ ইত্যাদিকে—আমাদের প্রয়োজন ও সামর্থ্য অনুযায়ী গ্রহণ করতে হবে, আর তাদের উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী বিষয়াদিকে যথাসম্ভব পরিহার করে চলতে হবে। বিশ্বায়নের কর্তৃপক্ষ (যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, ন্যাটো, জি-সেভেন, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, জাতিসংঘ) ও তার সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র সম্পর্কে পরিপূর্ণ সচেতনতা দরকার। বাইর থেকে আমাদের গ্রহণ করতে হবে নিজেদের বিবেচনায়, নিজেদের সত্তায় থেকে-নিজেদের সত্তাকে সমৃদ্ধ করার জন্য। শিক্ষাক্ষেত্রে এসব বিষয়ে পরিপূর্ণ সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে।
৯. বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রব্যবস্থার সম্ভবপর সফল পর্যায়ে রাষ্ট্রভাষারূপে প্রতিষ্ঠা করার, উচ্চশিক্ষা গবেষণা ও বিচারব্যবস্থায় বাংলা প্রচলনের, বাংলা ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞাচর্চার এবং বাংলা ভাষার সার্বিক উন্নতির লক্ষ্যে দূরদর্শী জাতীয় পরিকল্পনা ঘোষণা করে কাজ করতে হবে। বাংলা ভাষা, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর ভাষা, ধর্মীয় ভাষা ও বিদেশি ভাষা ইত্যাদি বিবেচনা করে সুষ্ঠু জাতীয় ভাষানীতি অবলম্বন করতে হবে। জাতীয় পর্যায়ে জনজীবনের বৈচিত্র্য ও ঐক্য—দুটোতেই যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ও উন্নতির নীতি অবলম্বন করতে হবে।
১০. সারা দেশে বিভিন্ন বিষয়ে পেশামূলক শিক্ষার মাধ্যমে যোগ্য, দক্ষ, উৎপাদনক্ষম, উন্নত চরিত্রবলসম্পন্ন কর্মী সৃষ্টি করতে হবে। শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে শক্তিমান রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার ও ভালোভাবে পরিচালনা করার উপযোগী শিক্ষিত লোক যাতে তৈরি হয়, সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। অধিকন্তু দর্শন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও শিল্প-সাহিত্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীল ব্যক্তিদের আত্মপ্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
আরো অনেক গুরুত্ব সমস্যা আছে, যেগুলো পর্যায়ক্রমে কর্মসূচিভুক্ত করে এগোতে হবে। কেবল চিন্তা দিয়ে হবে না, চিন্তার সঙ্গে কাজ দরকার। চিন্তা ও কাজের জন্য দরকার সংঘশক্তি। জাতীয় শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের জন্য পরিচ্ছন্ন কর্মসূচি নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আন্দোলন গড়ে ওঠার আগেই সরকার যদি এই সংস্কার প্রস্তাব গ্রহণ করে নেয় এবং এর বাস্তবায়ন আরম্ভ করে, তাহলে তা সরকার ও জনগণ সকলের জন্যই কল্যাণকর হবে। বাংলাদেশ, বাংলাদেশের জনগণের রাষ্ট্ররূপে গড়ে উঠবে কি না, তা বহুলাংশে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের ওপর নির্ভর করে।
লেখক : সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।